মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করছে। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির লড়াই আগে জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে আগে থেকে সংগ্রামরত বিদ্রোহীরাও তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ দিকে সামরিক সরকারের আক্রমণাত্মক অভিযানও আরো তীব্রতর হচ্ছে। সর্বশেষ মিয়ানমারের থ্যান্টল্যাং শহরে সামরিক বাহিনীর এক অভিযানে বহু মানুষ হতাহত হওয়াসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই অবনতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুটি চাপা পড়ছে। এমনকি যেটা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ইস্যু হিসেবে পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার অনিশ্চিত জীবন নিয়ে এখন খুব কমই ভাবিত হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বসে থাকলে চলবে না।
খবরে জানা যাচ্ছে, শহরে এক হামলায় ৩০ জন সেনা মারা গেছে। বিদ্রোহীদের এ দাবি নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করা না গেলেও শহরটিতে যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে সেটা নিশ্চিত। কারণ শহরটিতে জান্তা সরকারের বাহিনী ব্যাপক অভিযান চলাচ্ছে। বাসাবাড়িতে সক্ষম যুবকদের না পেয়ে তারা শিশুদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়ে জিম্মি করে বিদ্রোহীদের বাগে আনার কৌশল গ্রহণ করছে। জানা যাচ্ছে ইতোমধ্যে শহরে ১০ হাজার বাসিন্দা পালিয়ে গেছে। তাদের অনেকে পার্শ্ববর্তী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বেশ কিছু দিন ধরে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলছিল। সেখানে সরকারি বাহিনীর সর্বাত্মক হামলার ভয়ে শহরবাসী এভাবে পালাচ্ছে। সেনা সদস্যরা ২০টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার আগে বিদ্রোহীরা একটি সেনা ছাউনিতে আক্রমণ করে। এ দিকে সেনারা একজন যাজককে গুলি করে হত্যা করে। জানা যাচ্ছে তিনি আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন।
সু চির নেতৃত্বে গণতন্ত্রপন্থীরা একটি ছায়া সরকার আগেই গঠন করেছে। এরপর তারা জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ঘোষণা দেয়। তারা যুবকদের সংগঠিত করে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষিত যোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করেছে। সেসব হামলা ও জান্তা সরকারের অস্ত্রের ভাষায় কড়া জবাবের খবর ক্রমেই বেশি করে পাওয়া যাচ্ছে।
একই সাথে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বিদ্রোহীরাও সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণ জোরদার করেছে। এমন অবস্থায় জান্তা সরকারের মধ্যে নমনীয়তা নেই। তারা জোরেশোরে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দমন নিপীড়নের নতুন নতুন কৌশল তারা উদ্ভাবন করছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দেশটির অবস্থা আসলে আরো শোচনীয় হবে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে নতুন পরিস্থিতি প্রতিবেশী দেশ ভারতের জন্যও ভালো হবে না। মিজোরামে এই বর্মি নাগরিক আশ্রয় নিয়েছে। ভবিষ্যতে এ স্রোত আরো বাড়তে পারে।
রোহিঙ্গাসহ পুরো মিয়ানমার পরিস্থিতির এ অবনতির জন্য প্রতিবেশী শক্তিশালী দেশসহ আন্তর্জাতিক পক্ষের দায় রয়েছে। বিশেষ করে সামরিক জান্তাদের উচ্চাভিলাষী ক্ষমতা গ্রহণকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। যেভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসান কেউ না করেনি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অংশীদার বিভিন্ন ধরনের অবস্থান গ্রহণ করেছে। কেউ কেউ শুধু পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে। অস্ত্র বিক্রি ও বাণিজ্য প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে অনেকে। যে কারণে বিভিন্ন সময়ে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী আমেরিকান জোটের অবস্থাও নির্বিকার। এর ফল কিন্তু কারো জন্য ভালো হয়নি।
মিয়ানমারের বিশৃঙ্খলা ও অরাজগতার সবচেয়ে বড় শিকার প্রতিবেশী বাংলাদেশ। দেশটির সামরিক দুর্বৃত্তরা সব সময় রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের সাথে প্রতারণা করেছে। এর বিপরীতে না পেরেছে তার উপযুক্ত জবাব দিতে, না পেরেছে শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রয়াস নিতে। সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাও বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের পক্ষ হয়ে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকের আগে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশকে মর্মাহত করেছে। সীমিত সম্পদ নিয়েও বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিক মর্যাদাসহ মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়া। তিনি সে কথা উল্লেখ করেছেন।
রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যে কলহ শুরু হয়েছে তা কতকাল পরে সমাধান হবে তা জানা নেই। এখন পর্যন্ত যে লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে সেখানে বিশৃঙ্খলা আরো বাড়বে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গটি যেন হারিয়ে না যায় সে দিকে জোরালো খেয়াল রাখতে হবে। আর এ কাজটি বাংলাদেশকেই করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত চলমান বিচার প্রক্রিয়াকে সর্বাত্মক সমর্থন প্রদানের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ইস্যুটি সব সময় আমাদের জারি রাখতে হবে।