সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় সরকার
– প্রতি লিটারে ভোক্তার পকেট থেকে বাড়তি নেয়া হচ্ছে ৩৬ টাকা
– সরবরাহে ঘাটতি তৈরি করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো
সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে থেকে আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদন ব্যয়সহ প্রতি লিটারে মোট খরচ হয় যেখানে ১৩৯ টাকা, সেখানে বর্তমানে ভোক্তার কাছ থেকে নতুন মূল্য নেয়া হচ্ছে ১৭৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লিটারে বেশি নেয়া হচ্ছে ৩৬ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, দাম বাড়াতে সয়াবিন তেলের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি করেছিল কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এ জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ভোজ্যতেল আমদানি কমিয়েছে কয়েকটি কোম্পানি। এমন পরিস্থিতিতে আমদানি এবং সরবরাহের ঘাটতি দেখিয়ে সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, বাজারে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরির মাধ্যমে সরকারকে বিব্রত করতে চায় অসাধু সয়াবিন তেল সিন্ডিকেট। এ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাজার বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, দেশের বেশির ভাগ সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা থেকে। বর্তমান বাজারে যে ভোজ্যতেল বাজারজাত করা হচ্ছে তা আমদানি করা হয়েছে দেড় মাস আগে অর্থাৎ অক্টোবরের শুরুতে। ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৯৬৬ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় হয় ১১৩ টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসেবে)। ১০ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স এবং ১০ শতাংশ উৎপাদন খরচ এবং ৬ শতাংশ ঘাটতিসহ প্রতি লিটারে ব্যয় হয়েছে ২৬ টাকা। এতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের মোট উৎপাদন খরচ হয় ১৩৯ টাকা। কিন্তু বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ১৭৫ টাকা লিটারদরে। অর্থাৎ উৎপাদন খরচের চেয়ে ৩৬ টাকা বেশি দামে একজন ভোক্তার কাছে বিক্রি হচ্ছে।
তথ্যে দেখা যায় নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কেনাবেচার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) কমিয়েছে সরকার। এ সংক্রান্ত পৃথক প্রজ্ঞাপন ১৭ অক্টোবর জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে রাজস্ব বোর্ড বিদ্যমান ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। অপর প্রজ্ঞাপনে ভোজ্যতেলের উৎপাদন ও ব্যবসায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়েছে এনবিআর।
বাজারে প্রতিযোগিতা উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন দায়িত্ব পালন করে থাকে। উৎপাদন, বিতরণ, বাজারের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ সীমিত বা নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগে বিভিন্ন সময় আটটি ভোজ্যতেল কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এসব মামলা এখনো বিচারাধীন।
যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা হলো সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, মেঘনা অ্যান্ড ইউনাইটেড এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, বসুন্ধরা অয়েল রিফাইনারি মিল, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, প্রাইম এডিবল অয়েল লিমিটেড এবং গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড।
প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২ এর ১৫ ধারা এবং ১৫ (২) ধারায় মামলাগুলো দায়ের করা হয়। প্রতিযোগিতা আইনের অধীনে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে বিগত তিন বছরে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের লেনদেন বা বিক্রয়ের পরিমাণের ওপর সর্বনিম্ন ১ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জরিমানা করার বিধান রয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা আরো মনে করছেন, প্রতি বছর শীত এলেই ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে নানা রকমের ফন্দি তৈরি করে ভোজ্যতেল বা সয়াবিন তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই ধারাবাহিকতায় এবারো শীতের শুরুতে দাম বাড়াতে নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু করে এসব প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে বাজারে সয়াবিন তেল সরবরাহের ঘাটতি তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রতি লিটার তেলে দাম বেড়েছে সাত থেকে ১০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন সরকারকে বিব্রত অবস্থায় রেখে সাধারণ মানুষকে বেকায়দায় ফেলে মুনাফা করছে সয়াবিন তেল কোম্পানিগুলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জায়গা থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার বাজারে অস্থিরতা তৈরির জন্য ভোজ্যতেল নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এসব ষড়যন্ত্রকারীকে কঠোরহস্তে দমন করতে হবে বলে তারা মনে করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে সরবরাহ ঘাটতি তৈরি করে বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতি লিটার তেলের দাম বেড়েছে সাত থেকে ১০ টাকা। ভোজ্যতেলের সরবরাহ ঘাটতিতে সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। তারা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বোতলজাত করে বেশি দামে বিক্রি করছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সরকার অনুমোদিত সর্বোচ্চ খুচরামূল্য ১৬৭ টাকা হওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির সুযোগে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী নকল বোতলজাত তেল সরবরাহ করছে এবং প্রতি লিটার ২০০ টাকায় বিক্রি করছে। গতকাল ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৮৫-১৯০ টাকা।
এ দিকে বাজারে রূপালি ইলিশ নামে একটি ভোজ্যতেল কোম্পানি দেখা গেছে। যেটি আদানি-উইলমারের রূপচান্দা ব্র্যান্ডের তেলের প্যাকেজিংয়ের মতো বোতল বাজারজাত করছে। মোহাম্মদপুরের পরিবেশক রেজাউল করিম বলেন, গত এক মাস ধরে কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এমন সুযোগে অনেক নাম না জানা কোম্পানি বোতলজাত তেল বেশি দামে বিক্রি করছে। বেশ কয়েক দিন ধরে এক লিটার এবং দুই লিটারের বোতলজাত তেলের স্টক শেষ। এখন তার কাছে পাঁচ লিটার বোতলজাত তেল অবশিষ্ট রয়েছে বলে তিনি জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, বাজারে দু’টি বড় কোম্পানি (এস আলম এবং বসুন্ধরা) তেল সরবরাহ বন্ধ করেছে। এই সুযোগে অনেক ব্যবসায়ী তেল মজুদ করে রাখছে। এতে বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। সরকার দাম বাড়ালে কোম্পানিগুলো তাদের মজুদ থেকে তেল ছাড়বে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সয়াবিন তেল পরিশোধনাকারী কোম্পানিগুলো ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দাম নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিটিটিসি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দাম বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে কোম্পানিগুলো একসাথে বাজারে সঙ্কট তৈরি করে থাকে। এ সুযোগে বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হয়ে থাকে। তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় দেখা গেছে দেশের পাঁচ থেকে ছয়টি কোম্পানি সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়ার পর সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে তারা সরকারের কাছে দাম বাড়ানোর জন্য দেনদরবার শুরু করে। এবারো এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
এ দিকে ভোগ্যপণ্য সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রাশিদুল হাসান বলেন, দাম বাড়ানোর জন্য কোনো কোম্পানি কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করছে কি না তা তদন্ত করে দেখা জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এফবিসিসিআইসহ অন্যান্য সংস্থাকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, কিছু কোম্পানির সাথে বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগামী মার্চে পবিত্র রমজান মাসে ভোজ্যতেলের সম্ভাব্য সঙ্কট সম্পর্কে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় জিনিসের পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছিল।
বাংলাদেশ বছরে ২১ থেকে ২২ লাখ টন ভোজ্যতেল ব্যবহার হয়ে থাকে। এর ৯৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলেন, পূর্ববর্তী সরকার একটি অলিখিত নিয়ম তৈরি করেছিল যেখানে ভোজ্যতেল বাজারের আমদানি ও ব্যবসায় সীমিতসংখ্যক কোম্পানির আধিপত্য ছিল।
সিটি গ্রুপের জিএম বিশ্বজিৎ দত্ত নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা ঠিকভাবে এলসি করতে পারছেন না। কারণ ১০-১২টি ব্যাংক একেবারে বসে গেছে। এসব ব্যাংকে এলসি ওপেন করা যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এলসির ক্ষেত্রে সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ জন্য তেল আমদানিতে এলসির ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছাকৃতভাবে তেল আমদানি করছে না এ তথ্য সঠিক নয়। কারণ আমরা যারা ব্যবসা করি তারা সাধারণত যেখানে ব্যবসা আছে সেখানেই ছুটে যাই। এ জন্য আমরা তেল আমদানিতে যখন লাভ দেখি তখন আমদানির জন্য এলসি করে থাকি। বর্তমানে আমদানি খরচসহ অন্যান্য খরচ অনেক বেড়েছে। একই সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব স্থানীয় বাজারে পড়েছে। এজন্য ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্যে দেখা যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২৩ লাখ টন। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, চলতি বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেল আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৬৮ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে এই আমদানির পরিমাণ ছিল চার লাখ ৬০ হাজার টন। সে হিসাবে আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। কিন্তু দেশে এক মাসের তেলের চাহিদা এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৩৩ টন। এ হিসাবে দেশে যে পরিমাণে তেল মজুদ আছে তা দিয়ে আরো দুই মাস অনায়াসে চলার কথা। তারপরও আমদানিকারকরা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করছে না। এতে খুচরা পর্যায়ে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপ সয়াবিন তেল আমদানি বন্ধ করেনি। তবে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় আমদানি কম হচ্ছে। কারণ এলসি ওপেন করতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে তেল আমদানি করা হয় তারা নতুন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এতে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি জানান।