স্বদেশ ডেস্ক: পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত তরল দুধে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি শনাক্ত হওয়া নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনাÑসমালোচনার মধ্যেই জানা গেল, দেশের প্রধান মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মানদ-ে ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ পরীক্ষার কোনো নিয়মই নেই।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে তরল দুধের ক্ষেত্রে যখন ৫০ ধরনের মান পরীক্ষার কথা, তখন বিএসটিআই করে মাত্র ৯টি। এ সংস্থার পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে সংস্থার কর্তারা মুখে কুলুপ আঁটলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের মন্তব্যÑ বিএসটিআই আগের যুগেই পড়ে আছে।
এদিকে দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষায় আবার পাস্তুরিত ও খোলা তরল দুধে আরও বেশি অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের (বিএমআরসি) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক। গতকাল শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি এ তথ্য জানান। অধ্যাপক ফারুকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় প্রতিবেদকের।
তিনি বলেন, প্রথম দফায় দুধের নমুনা পরীক্ষা করে তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গিয়েছিল। এবার পাওয়া গেছে চারটি। গত সপ্তাহে পরীক্ষাটি পুনরায় করা হয়। প্রথমবারের মতো আগের ৫টি কোম্পানির ৭টি পাস্তুরিত প্যাকেটজাত দুধের নমুনা এবং খোলা দুধের ৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ১০টি নমুনাতেই উদ্বেগজনকমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। এতে অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা ছিল চারটি। এগুলো হলোÑ অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, এনরোফ্লক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও লেভোফ্লক্সাসিন।
এর মধ্যে আগেরবার ছিল না এমন অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে দুটি। তা হলোÑ অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ও এনরোফ্লক্সাসিন। ১০টি নমুনার মধ্যে তিনটিতে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে চারটি, ছয়টিতে তিনটি এবং একটিতে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে দুটি। এ পরীক্ষার ফল মানতে রাজি নয় দেশের প্রধান মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআই।
সংস্থার পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, তাদের প্যারামিটারে অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষার কোনো নিয়ম নেই। ঢাবির প্রতিবেদনকে অগ্রাহ্য করে তিনি বলেন, মার্চ মাসে নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার জুলাই মাসে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এ দীর্ঘ সময়ে পণ্যের মান নষ্ট হয়েছে বলে দাবি করেন ওই কর্মকর্তা। বিএসটিআইর এ দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারে কর্তব্যরতরা।
এর পরিচালক বলেন, জুনের ২৮, ২৯ ও ৩০ তারিখে নমুনা সংগ্রহ করে ২ জুলাই ৯ জন গবেষকের সমন্বয়ে গঠিত দল ১৯ ধরনের পরীক্ষা করেন। ৪ স্তরে বিশ্বমানের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের পরীক্ষা শতভাগ ত্রুটিমুক্ত বলে দাবি করেন তিনি। এর আগে গত ২৫ জুন সংবাদ সম্মেলন করে দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি আছে জানালে সরকারের সংশ্লিষ্ট সচিব প্রতিবেদন প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন। এমন অবস্থার মধ্যেই গতকাল দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষা শেষে তরল দুধে আরও দুই ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ভয়ঙ্কর উপস্থিতির কথা জানা গেল। রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার গৃহবধূ ইয়াসমিন। স্থানীয় একটি সুপারশপের ম্যানেজারের সঙ্গে তাদের বিক্রয়যোগ্য পাস্তুরিত তরল দুধের গুণগতমান নিয়ে গতকাল প্রশ্ন তোলেন।
ম্যানেজার বললেন, সব ব্র্যান্ডই ভালো। এ সময় ওই গৃহবধূ সম্প্রতি বিতর্কের বিষয়টি টেনে আনলেন। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে দুধ কেনা থেকে বিরত থাকলেন। শুধু ওই সুপারশপই নয়, যে কোনো ভোগ্যপণ্যের দোকান, যারা পাস্তুরিত তরল দুধ বিক্রি করেন তাদের বক্তব্য, বিক্রি কমে গেছে। তরল দুধের মান নিয়ে সরকারিÑবেসরকারি দুই সংস্থার ভিন্ন বক্তব্যে মার খেতে বসেছে দুগ্ধশিল্প।
বড় কোম্পানিগুলো মাঠ থেকে দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। বাজারে বিক্রিতেও নেমেছে ধস। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আওতাধীন সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ফুড সেফটি অথরিটি (এনএফএসএল) বাজারে তরল দুধ এবং দুগ্ধজাত সামগ্রীর নমুনা নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে। সেখানে বেশিরভাগ দুধের নমুনায় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নানা উপাদানের অস্তিত্ব খুঁজে পায় সংস্থাটি।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের গবেষকদের চালানো এক পরীক্ষার ফলও বলছে, বাজারে প্রচলিত পাস্তুরিত দুধে মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর উপস্থিতি রয়েছে। অন্যদিকে বিএসটিআই হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলেছে, তাদের অনুমোদিত পাস্তুরিত তরল দুধে কোনো ক্ষতিকারক উপাদান নেই।
তাদের দাবি, ১৪ ব্র্যান্ডের ১৮টি পাস্তুরিত দুধের নমুনা পরীক্ষা করে আশঙ্কাজনক কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের গবেষকরা আমাদের সময়কে জানান, তারা (বিএসটিআই) তো অ্যান্টিবায়োটিকই টেস্ট করেনি। তাদের লিস্টে এ পরীক্ষা নেই। তাদের রিপোর্টে কী সমস্যা আছে সেটি তারাই বলবে। কিন্তু আমাদের কাছে অ্যান্টিবায়োটিকটা জরুরি বিষয় হয়ে গেছে বাঁচার জন্য। পুষ্টিবিদ ড. নাজমা শাহীন বলেন, গরুকে বাঁচাতে হলে তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে, যা নির্দিষ্ট করা আছে।
কিন্তু মানুষের জন্য তৈরি অ্যান্টিবায়োটিকগুলো প্রাণীর দেহে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এটি তারা মানছে না। কোনো কোনো কোম্পানি নিয়ম না মেনে পশুখাদ্য প্রস্তুত করে। ব্যবসার খাতিরে তারা মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তারা বলছে অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দিলে ফিডের মধ্যে গরু মোটা হবে, তাজা হবেÑ অসুখ হবে না। এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটিই আমাদের বক্তব্য।
এটি বন্ধ করা দরকার। তিনি বলেন, সব কোম্পানির দুধ একই মানের হওয়ার কথা না। গরুর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান, ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশের পার্থক্য হবে কিছুটাÑ এটি সত্যিই। কিন্তু বিশাল পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। এখানে কোনো রহস্য থাকতে পারে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব উপাদান দুধে উপস্থিতির কথা ঢাবির গবেষকরা বলেছেন, সেগুলো মানবদেহের জন্য চরম হুমকি।
যেমন অ্যান্টিবায়োটিকগুলো রোগের উপস্থিতি ছাড়া শরীরে প্রবেশ করে তার সঠিক ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না। ফলে এগুলো খুব শক্তিশালী আকার ধারণ করে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ওই অ্যান্টিবায়োটিক সংশ্লিষ্ট রোগের আক্রমণ হলে ওষুধটি খেলেও রোগ নিরাময়ে আর কাজ করবে না।