বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০৫ অপরাহ্ন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা!

পরাগ মাঝি : ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানির বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বেযুদ্ধের শুরুটা এভাবেই। তারপর প্রায় ৬ বছরের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মান বাহিনীকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে বিশ্বযুদ্ধের।
১০ মে ১৯৪০ : পশ্চিমে জার্মানির আক্রমণ
:১০ মে ১৯৪০ এক সঙ্গে চারটি দেশ আক্রমণ করে জার্মানি। ফরাসিরা ভেবেছিল আক্রমণ আসবে ফ্রান্স-জার্মানি সীমান্তের রণরেখা ম্যাগিনোট লাইনের ওপর কিংবা বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে আরদেন হয়ে। তারা ভেবেছিল জার্মানির প্যানজার বাহিনী আরদেনের জঙ্গল ভেদ করে আসতে পারবে না। ১৪ মে নেদারল্যান্ডসের পতন ঘটায় নাৎসি বাহিনী। ১৪ মে আরদেন থেকে জার্মান বাহিনী বেরিয়ে এসে দিশেহারা মিত্র সেনাদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে প্রবল বেগে এগোতে থাকে। ফ্রান্সের ডানকার্ক বন্দর দিয়ে তড়িঘড়ি করে ফরাসি ও ব্রিটিশ বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এর মাঝে ২৭ মে বেলজিয়ামেরও পতন হয়।
১৯৪০ সালের ১০ জুন ইতালিও হিটলারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তবে তারা আক্রমণ শুরু করে ২০ জুন থেকে। ১৪ জুন প্যারিসের পতন ঘটে। এর মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নাৎসি বাহিনী।
১২ আগস্ট, ১৯৪০ : ব্যাটল অব ব্রিটেন শুরু
:এই দিনে ব্রিটিশ বিমানঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ শুরু করে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। এর আগে ফ্রান্সকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, জার্মান বাহিনী ব্রিটেন আক্রমণের দ্বারপ্রান্তে। জার্মান এয়ারফোর্স লুফৎওয়াফে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে ইউনাইটেড কিংডমের ওপর সামরিক অভিযান চালিয়েছিল তাকে ব্রিটেনের যুদ্ধ বা ব্যাটল অফ ব্রিটেন বলা হয়। মূলত ইংল্যান্ডের রয়্যাল এয়ারফোর্সকে হারিয়ে আকাশের দখল নেওয়ার জন্যই এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। ব্যাটল অফ ব্রিটেন নামটি এসেছে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের হাউজ অফ কমন্সে দেওয়া একটি ভাষণ থেকে। যেখানে তিনি বলেন, ‘ফ্রান্সের যুদ্ধ শেষ। আমি মনে করছি ব্রিটেনের যুদ্ধ এবার শুরু হতে চলেছে…।’
এই যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হয়। এই পরাজয় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাজি জার্মানির প্রথম পরাজয়। ব্যাটেল অফ ব্রিটেনে ৫৪৪ জন ব্রিটিশ ফাইটার পাইলট এবং এয়ার ক্রু নিহত হয়। অন্য দিকে, জার্মান পাইলট ও ক্রু নিহত হয়েছিল ২ হাজার ৫৮৫ জন। জার্মানদের অধিক প্রাণহানির মূল কারণ ছিল বিধ্বস্ত জার্মান বিমানগুলোর মধ্যে বোমারু বিমানের সংখ্যা বেশি ছিল। বোমারু বিমানে বেশিসংখ্যাক ক্রু দরকার হতো। ফলে জার্মানদের নিহতের সংখ্যাও ছিল বেশি। এ ছাড়া বিমান বিধ্বস্ত হলে ব্রিটিশ পাইলটরা প্যারাস্যুটের সাহায্যে নিরাপদে নিচে অবতরণ করতে পারতেন, কিন্তু জার্মান ফাইটার পাইলটদের জন্য শত্রু এলাকায় অবতরণ করা ছিল ভয়াবহ বিপজ্জনক ব্যাপার। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছিল সাধারণ মানুষের। প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক ব্রিটিশ এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়, যাদের মধ্যে অর্ধেকই ছিল লন্ডনের নাগরিক।
ব্যাটেল অফ ব্রিটেন বোমারু এবং ফাইটার মিলিয়ে লুফৎওয়াফো মোট ১ হাজার ৯৭৭টি বিমান হারায়, অন্য দিকে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স হারায় ১ হাজার ৭৪৪টি। নিজেদের ভূখ-ে যুদ্ধ করায় রয়্যাল এয়ারফোর্সের বিমানগুলো জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে খুব অল্পসময়ের মধ্যে জ্বালানি ভরে যুদ্ধক্ষেত্রে আবার ফিরে আসতে পারত। কিন্তু সেই সুবিধা জার্মান বাহিনীর ছিল না।
২২ জুন ১৯৪১ : ব্যাটল অব বারবারোসা শুরু
:১৯৪১ সালের ২২ জুন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেদিন রাত ৩টার পর হিটলারের অনুগত জার্মান বাহিনী রাশিয়া আক্রমণ শুরু করে। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন বারবারোসা। তিনটি দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ শুরু করে জার্মান বাহিনী। এই তিনটি ভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ফিল্ড মার্শাল ভব লিন, ভন বক এবং ভন রান্সডেট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ানক এই আক্রমণে ১১৭ ডিভিশন সেনা মোতায়েন করে জার্মানি। এই আক্রমণে জার্মানির পক্ষে ছিল প্রায় ৩০ লাখ সৈন্য। এ ছাড়াও ছিল ৩ হাজার ৫৮০টি ট্যাংক, ৭ হাজার ১৪৮টি আর্টিলারি গান, ১ হাজার ৮৩০টি ফাইটার প্লেন এবং সাড়ে সাত লাখ ঘোড়াও ব্যবহার করে তারা। এর আগে এত বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এমন আক্রমণ পৃথিবীর কোথাও দেখা যায়নি।
আক্রমণের তীব্রতায় রাশিয়ান রেড আর্মিকে পিছু হটতে বাধ্য করে জার্মান বাহিনী। মাত্র ১৭ দিনের মধ্যেই তারা ৩ লাখ রাশিয়ান সৈনিককে বন্দী করা ছাড়াও আড়াই হাজার ট্যাংক, ১ হাজার ৪০০ আর্টিলারি গান এবং ২৫০টি রুশ ফাইটার প্লেন বিধ্বস্ত করে জার্মানরা। দুর্বার গতিতে একে একে ইউক্রেন হয়ে রাশিয়ার ইউরোপ অংশের অনেকটা দখল করে নেয় তারা। হিটলারের লক্ষ্য ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সোভিয়েত রাশিয়াকে পরাজিত করা। রাশিয়ার আগেই ইংল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল হিটলারের। কিন্তু তিনি হঠাৎ করেই রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, রাশিয়াকে পরাজিত করলে ইংল্যান্ডকে রাজনৈতিকভাবেই বশে আনা সম্ভব। হিটলারের বাহিনী যখন রাশিয়া বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখনই ঘটে বিপত্তি। ক্রম অগ্রসরমান জার্মান বাহিনী তখন মস্কোর উপকণ্ঠে। কিন্তু ১৯৪১ এর ডিসেম্বরের প্রচ- শীত এবং রেড আর্মির প্রবল প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে যায় মস্কো অভিযান। তবে এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না হিটলার। এবার নিজেই দায়িত্ব নিলেন ইস্টার্ন ফ্রন্টের। এ দিকে খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল সোভিয়েত রাশিয়াতে অবস্থান করা জার্মান বাহিনীর তেলের রিজার্ভ। তাই হিটলার চাইছিলেন যে করেই হোক চেচনিয়ার তেলের খনিগুলো দখল করতে। তাই ইস্টার্ন জোনে সেনাবাহিনীর একটি অংশকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন চেচনিয়ার উদ্দেশ্যে। অন্য অংশকে পাঠালেন স্টালিনগ্রাদের দিকে। কিন্তু জার্মান বাহিনী যতক্ষণে চেচনিয়ায় পৌঁছল ততক্ষণে শত্রুর হাতে পড়ার আগেই তেলের খনিগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল সোভিয়েতরা। ফলে তেল সংকটে ভুগতে থাকা জার্মান সিক্সথ আর্মি স্টালিনগ্রাদের দিকে কাক্সিক্ষত গতিতে এগোতে পারছিল না। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসের ২৩ তারিখে স্টালিনগ্রাদ শহরের সীমানায় চলে আসে জার্মান আর্মি। প্রবেশের আগেই স্টালিনগ্রাদে টানা এক সপ্তাহ বোমাবর্ষণ করে তারা। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় স্ট্যালিনগ্রাদ। তারপর জার্মান পদাতিক সৈন্যরা প্রবেশ করতে শুরু করে এই শহরে। জার্মান আর্মি মনে করেছিল খুব সহজেই পতন হয়ে যাবে স্টালিনগ্রাদের। তাদের তখনো ধারণা ছিল না আসল যুদ্ধ এখনো বাকি। শহরে প্রবেশের পর প্রবল বাধার মুখে পড়ে তারা। শহরের ভগ্ন বিল্ডিংগুলো হয়ে ওঠে রাশিয়ানদের একেকটি দুর্গ। রাশিয়ান চোরাগোপ্তা গেরিলা হামলার মুখে জার্মানদের কাছে এক দুঃস্বপ্নপুরীতে পরিণত হয় স্টালিনগ্রাদ। তবে এত কিছুর পরও তারা শহরের প্রায় ৯০ ভাগ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। ১৯ নভেম্বর শহরের বাইরে রাশিয়ান রিইনফোর্সমেন্ট এসে ঘিরে ধরে জার্মান বাহিনীকে। এবার উল্টো অবরোধের শিকার জার্মানরা। অস্ত্র ও খাবারের অভাবে দুর্বল হয়ে একে একে প্রাণ হারাতে শুরু করল সিক্সথ আর্মি। স্টালিনগ্রাদে প্রায় দেড় লাখ জার্মান সৈন্য প্রাণ হারায় আর বন্দী হয় ৯৫ হাজার। প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলার পর ১৯৪৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করে জার্মান বাহিনী। এক দিকে ডিসেম্বরের প্রচ- শীত, অন্য দিকে রসদের অভাব বদলে দিয়েছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি।
৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ : পার্ল হারবার আক্রমণ
:জাপানের সেনাবাহিনী কর্তৃক মার্কিন বিমানঘাঁটি পার্ল হারবারে অতর্কিত আক্রমণের সূত্র ধরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল মঞ্চে প্রবেশ করে আমেরিকা। ১৯৪০ সালে জাপান অক্ষশক্তির দুই পরাক্রমশালী দেশ জার্মানি এবং ইতালির সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধের আগে থেকেই শত্রু ভাবাপন্ন আমেরিকাকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তারা। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলে আমেরিকার প্রধান নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে আক্রমণ করে দেশটি। জাপানিদের পক্ষে এই আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটো। হাওয়াই দখল করার মধ্য দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলে প্রভাব বিস্তার করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
সেদিন ৩৬০টি জাপানি বোমারু বিমানের হঠাৎ আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না মার্কিন নৌবাহিনী। ফলে জাপানের প্রবল আক্রমণের মুখে কোনো প্রতিরোধই সৃষ্টি করতে পারেনি তারা। আক্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমেরিকার তিন শতাধিক যুদ্ধবিমান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। আমেরিকার ৮টি যুদ্ধজাহাজের চারটিই ডুবে যায়। নিহত হয় প্রায় ২ হাজার ৪০০ নৌ সেনা। আক্রমণের পরদিনই যুদ্ধ ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
৪ জুন, ১৯৪২ : ব্যাটেল অব মিডওয়ে
:প্রথমবার পার্ল হারবার আক্রমণের ছয় মাস পর দ্বিতীয়বার আক্রমণের পরিকল্পনা করেন জাপানি অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটো। তাই পার্ল হারবারের নিকটবর্তী উপদ্বীপ মিডওয়েতে ঘাঁটি গাড়ে জাপানি সেনাবাহিনী। কিন্তু তাদের রেডিও যোগাযোগের তথ্য ফাঁস হয়ে যায় আমেরিকার কাছে। জাপানিদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে সেই অনুযায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন মার্কিন অ্যাডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিজ।
ফাঁস হওয়া তথ্যে আমেরিকা আগেই জানত কবে আক্রমণ করবে জাপান। অবশেষে আসে সেই দিন, ৪ জুন। সেদিন সকাল থেকেই শুরু হয় যুদ্ধ। পূর্বপ্রস্তুতি থাকায় এবার মারাত্মক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় জাপানিরা। প্রাথমিক যুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো জাপানিদের তেমন কোনো ক্ষতিই করতে না পারলেও খেলা পাল্টে দেয় তাদের বোমারু বিমানগুলো। মার্কিন ডাইভ বোম্বার বিমানগুলোর অতর্কিত আক্রমণে মুহূর্তেই ডুবে যায় জাপানিদের পূর্ণ শক্তির চারটি যুদ্ধজাহাজ। সেই সঙ্গে সলিল সমাধি ঘটে ৩২২টি জাপানি যুদ্ধবিমানের এবং প্রাণ হারায় প্রায় ৫ হাজার জাপানি নাবিক। জাপানিরা তাদের অন্যতম বড় যুদ্ধজাহাজ মিকুমাকে হারায় এই আক্রমণে। টানা তিন দিন ধরে চলা এই যুদ্ধে আমেরিকানরা হারিয়েছিল ১৪৭টি যুদ্ধবিমান এবং তিন শতাধিক নাবিক। মিডওয়েতে জাপানিদের এই বিশাল পরাজয় পাল্টে দেয় পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথ।
৫ জুলাই, ১৯৪৩ : ব্যাটেল অব কুর্স্ক
:গত শীতে স্টালিনগ্রাদে শোচনীয় পরাজয়ের স্মৃতি তখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে হিটলার এবং তার জার্মান বাহিনীকে। ওই যুদ্ধের বদলা এবং নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে ১৯৪৩ সালের ৫ জুলাই কুর্স্ক যুদ্ধের সূচনা করেছিল জার্মান নাৎসি বাহিনী। জুলাই এবং আগস্ট মাসে পূর্ব ফ্রন্টে সোভিয়েত রাশিয়ার কুর্স্ক নামক জায়গায় জার্মান এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনীর মধ্যে যে সামরিক সংঘর্ষগুলো হয় তাকেই সম্মিলিতভাবে কুর্স্কের যুদ্ধ বলা হয়। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্যাংক যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত এই কুর্স্ক যুদ্ধ। দুই পক্ষের মধ্যে প্রধান সংঘর্ষটি হয়েছিল প্রোখোরোভকায়। বিরাট ট্যাংক যুদ্ধ হয়েছিল ওই এলাকাটিতে। কুর্স্কের যুদ্ধে সোভিয়েত রেড আর্মি রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করেছিল। হিটলার ভেবেছিলেন, এই যুদ্ধে যে করেই হোক তিনি বিজয়ী হবেন। প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার সৈনিক মোতায়েন করেছিলেন তিনি। প্রায় ৩ হাজার ট্যাংক ছিল এই বাহিনীর কাছে। যদিও তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সোভিয়েত সৈন্য সংখ্যা ছিল ১৯ লাখেরও বেশি। জার্মানদের তুলনায় তাদের ট্যাংকও ছিল বেশি। কিন্তু আকমণাত্মক নাৎসি বাহিনীর কাছে সোভিয়েতরা প্রতিরোধ যুদ্ধে খুব বেশি সময় টিকতে পারবে না, এমনটাই ভেবেছিলেন হিটলার। আর এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারলে নাৎসি বাহিনীর মনোবল বেড়ে যেত বহুগুণে। কিন্তু প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় জার্মান নাৎসি বাহিনী। এবার পেছন থেকে তাদের ধাওয়া করে রেড আর্মি।
৬ জুন, ১৯৪৪ : ডি-ডে
:১৯৪৪ সালের জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সংঘটিত হয় ব্যাটল অফ নরম্যান্ডি। জার্মানদের কবল থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে ৬ জুন এই লড়াই শুরু করে মিত্রবাহিনী। এই বিশেষ দিনটি ইতিহাসে ‘ডি-ডে’ নামে পরিচিত।
এ দিন মার্কিন, ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান যৌথ বাহিনীর প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার সৈন্য ফ্রান্সের নরম্যান্ডি উপকূলে ৫০ মাইল দীর্ঘ একটি সৈকতে ৫ ভাগে ভাগ হয়ে অবতরণ করে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উভচর আক্রমণ বলা হয় এটিকে। এই আক্রমণটি নিয়ে অনেক আগে থেকেই জার্মান বাহিনীকে ভুলপথে পা বাড়াবার কৌশল অবলম্বন করেছিল মিত্রবাহিনী।
বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরপরই ১৯৪০ সালের মে মাসে ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দখল করে নেয় হিটলারের নাৎসি বাহিনী। একই মাসে ফ্রান্সের উত্তর উপকূল ডানকির্কে জার্মানদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় ব্রিটিশ বাহিনী। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে মিত্রবাহিনীর পক্ষে যোগ দেওয়া আমেরিকা ১৯৪৩ সাল থেকেই ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে দখলদার নাৎসি বাহিনীর ওপর একটি বড়সড় আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছিল। তবে, গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে এই আক্রমণের কথা জেনে গিয়েছিলেন হিটলার। তাই ফ্রান্সের উত্তর উপকূলের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য তিনি দায়িত্ব দেন জার্মানির অন্যতম সেরা কমান্ডার ফিল্ড মার্শাল আরউইন রোমেলকে। রোমেল নিশ্চিত ছিলেন না উপকূলের কোথায় আঘাতটি হানবে মিত্রবাহিনী। তাই প্রায় ২ হাজার ৪০০ মাইল এলাকাজুড়ে উপকূল ও পানিতে মাইন, বাংকার, কাঁটাতার এসব দিয়ে এক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন তিনি। এ ছাড়াও নাৎসি বাহিনীর সবচেয়ে চৌকস সৈন্যদের নিযুক্ত করা হয় এখানে।
অন্য দিকে অপারেশন ওভারলর্ড-এর আওতায় মিত্রবাহিনীর পক্ষে আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ডুয়েট আইজেনহাওয়ার ও ব্রিটেনের বার্নার্ড মন্টগোমারি। খবর আসে ৫ জুন থেকে ছুটি কাটাতে যাবেন বিরোধী সেনাপতি ফিল্ড মার্শাল রোমেল। আইজেন হাওয়ার এই দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে এই অপারেশন ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়।
:৬ জুন, ১৯৪৪ সালে ৫ হাজার জাহাজ এবং ১৩ হাজার এয়ারক্র্যাফটের এক সম্মিলিত বাহিনী আক্রমণ করে নরম্যান্ডি উপকূলে। তার আগেই কয়েক হাজার প্যারাট্রুপার এবং গ্লাইডার গোপনে নামানো হয় ওই অঞ্চলের ব্রিজ এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর দখল নেওয়ার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য দেশের সৈন্যরা খুব সহজেই নরম্যান্ডি উপকূল থেকে ফ্রান্সের মূল ভূখ-ে প্রবেশ করে। মার্কিন সৈন্যরা ব্যাপক প্রতিরক্ষার কবলে পড়েছিল। উপকূলে অবতরণের সময়ই তাদের প্রায় ২ হাজার সৈন্য নিহত হয়। সব মিলিয়ে সেদিন মিত্রবাহিনীর ৪ হাজারের বেশি সৈনিক মারা পড়ে এবং অসংখ্য আহত ও নিখোঁজ হয়। অন্য দিকে, নাৎসি বাহিনীর ৪ থেকে ৯ হাজার সৈন্য হতাহত হয়। সেদিন নরম্যান্ডি উপকূল দখল করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করে মিত্রবাহিনী। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় সোয়া ৩ লাখ সৈন্য এবং ১ লাখ টনেরও বেশি যুদ্ধাস্ত্র এনে জড়ো করা হয় ওই উপকূলে।
আগস্ট মাসের শেষের দিকেই ফ্রান্স পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় মিত্রবাহিনী। নরম্যান্ডি অবতরণ বা ডি-ডে কে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর জয়ের সূচনা। এই সাফল্যের পরই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। হিটলারকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয় এই পরাজয়। ধীরে ধীরে পশ্চিম দিক থেকে জার্মানির দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে মিত্রবাহিনী। অন্য দিকে স্টালিনগ্রাদ এবং কুর্স্ক যুদ্ধে বিজয়ী সোভিয়েত রাশিয়ার রেড আর্মিও পূর্বদিক থেকে এগিয়ে যায় জার্মানির দিকে। ১৯৪৫ সালের ৮ মে আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় বরণ করে নেয় নাৎসি বাহিনী। এর আগে এপ্রিলের ৩০ তারিখ আত্মহত্যা করেন নাৎসি বাহিনীর প্রধান অ্যাডলফ হিটলার।
৬ ও ৯ আগস্ট, ১৯৪৫ : হিরোশিমা ও নাগাসাকি
১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আপাত সমাপ্তি হলেও সর্বশেষ আঘাতটি হানে আমেরিকা। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামে একটি পারমাণবিক বোমা ফেলে। তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ধারণা করা হয়, ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার লোক মারা যায়। নাগাসাকিতে মারা যায় প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ। পরবর্তী সময়ে ওই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষ। ওই দুটি বোমা বিস্ফোরণে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে পুরো পৃথিবী। দ্বিতীয় বোমাটি বিস্ফোরণের ৬ দিন পর পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করে জাপান।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877