স্বদেশ ডেস্ক: প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এক সময় বাজেটের সিংহভাগ বৈদেশিক অনুদান নির্ভর ছিল। ২০০৯ সালের পর থেকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাজেট প্রণয়ন করে মানুষের আয় বর্ধন ও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পেরেছি বলেই আজকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদানের সংখ্যা মাত্র দশমিক আট শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন বাজেটের ৯০ ভাগই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে পারি। পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদাশীল হয়েছি। উন্নয়নটা আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারছি। বাজেটে প্রতিটি মানুষ উপকৃত হবে।’
আজ শনিবার একাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনার সমাপনী বক্তব্যে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
সংসদনেতা বলেন, ‘আমরা আগামী ২০২৩-২৪ সালে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীতকরণ, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৭৫০ ডলার, রপ্তানি ৭২ বিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ সরবরাহ ২৮ হাজার মেগাওয়াট ও অতি দারিদ্র্যের হার চার দশমিক পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করেছি। এবারের বাজেট এসব লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উচ্চহারে সুদ থাকলে শিল্প বিকশিত হবে না। এজন্য আমার সুপারিশ থাকবে যেন ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে রাখতে যথার্থ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এটি করা হলে দেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে সক্ষম করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এজন্য আমাদের এই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
দুর্নীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের একটি সমস্যা দুর্নীতি। অবৈধভাবে যারা ক্ষমতায় আসে তারা নিজেরাও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। সমাজে দুর্নীতিটাকে তারা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে দেয়। এটা মানুষের একটি মানসিক রোগে পরিণত হয়ে যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার নীতি হচ্ছে “জিরো টলারেন্স”। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এ লক্ষ্যে আমরা একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব বাজেটে উপস্থাপন করেছি। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ, বিনিয়োগ সহজীকরণে আমরা ওএসএফ চালু করেছি। ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর বিনিয়োগের প্রস্তাব পাচ্ছি। এগুলো কর্মসংস্থানে ব্যাপক অবদান রাখবে।’
কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক সময় মানুষের অপ্রত্যাশিত কিছু অর্থ আসে। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত অর্থটা কোনো কাজে লাগানো যায় না। তখন তাদের একটা সুযোগ দেওয়া হয়, তখন এই টাকাটা মূল ধারায় চলে আসে। তবে কোথায় গুজে রাখছে বা বিদেশে পাচার করছে কি না- এটাও একটু খতিয়ে দেখা দরকার।’
পুঁজিবাজারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থক্ষায় আমরা কোম্পানিগুলোকে ক্যাশ ডিভিডেন্ডে উৎসাহিত করার জন্য স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করেছিলাম। এ বিষয়ে ব্যবসায়ী সমাজের কেউ কেউ আপত্তি জানিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলো নগদ লভ্যাংশ দিতে পারে না। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের এমন মন্তব্যের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ আমাদের ভাবতে হবে। কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীও নগদ লভ্যাংশ প্রত্যাশা করেন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমি প্রস্তাব করছি, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনও কোম্পানি যে পরিমাণ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করবে কমপক্ষে তার সমপরিমাণ নগদ লভ্যাংশ দিতে হবে। যদি কোম্পানির ঘোষিত স্টক লভ্যাংশের পরিমাণ নগদ লভ্যাংশের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে স্টক লভ্যাংশে ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নগদ লভ্যাংশ উৎসাহিত করায় আমরা আরও প্রস্তাব করেছিলাম, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি রিটেইন আর্নিং, রিজার্ভ থাকলে অতিরিক্ত রিটেইন আর্নিং, রিজার্ভের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। এ বিষয়েও ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা কেউ কেউ আপত্তি করেছেন। সেই প্রেক্ষাপটে এই ধারাটির আংশিক সংশোধনপূর্বক আমি প্রস্তাব করছি, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি কোনো অর্থবছরে কর-পরবর্তী নিট লাভের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ রিটেইন আর্নিং, ফান্ড, রিজার্ভে স্থানান্তর করতে পারবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ ডিভিডেন্ড, স্টক ও ক্যাশ দিতে হবে। তবে কোনো কোম্পানি এমনটা করতে ব্যর্থ হলে প্রতিবছরে রিটেইন আর্নিং, ফান্ড, রিজার্ভের মোট অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত আয়কর আইনের প্রস্তাবিত ধারাগুলো আমরা বিবেচনা করব।’
মূসকের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক মূসক হার প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৫ শতাংশের নিম্নহারের উপকরণ কর রেয়াত দেওয়ার সুযোগ না থাকায় ব্যবসায়ীরা হ্রাসকৃত হারের পরিবর্তে উপকরণ কর গ্রহণ করে ১৫ শতাংশ হারে কর দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির দাবি করেছেন। হ্রাসকৃত হারের পাশাপাশি কেউ চাইলে যেন ১৫ শতাংশ কর দিয়ে রেয়াত পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে, আইনে সেই বিধান আনার প্রস্তাব করছি। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে তাঁতশিল্পে ব্যবহৃত সুতাশিল্পের ওপর পাঁচ শতাংশ মূসকের পরিবর্তে প্রতি কেজি সুতায় চার টাকা হারে সুনির্দিষ্ট করের প্রস্তাব করছি।’
তিনি বলেন, ‘দেশীয় শিল্পের প্রতিরক্ষণ, প্রণোদনা দিতে প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে শুল্কহার হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে এর ফলে দেশীয় কাগজ ও গ্যাস উৎপাদনকারী শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। দেশীয় মুদ্রণ শিল্পের প্রণোদনা দেওয়া ও বন্ড ব্যবস্থার অপব্যবহার ঠেকাতে দেশে উৎপন্ন হয় না, এমন পেপারগুলোর শুল্কহার যৌক্তিক করা হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ অত্যন্ত সময়োপযোগী। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্থ পাঠাতে ২ শতাংশ প্রণোদনার প্রস্তাবে রেমিট্যান্স পাঠানোর বর্ধিত ব্যয় লাঘব হবে। প্রবাসী কর্মীরা বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত হবেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বীমা সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তৈরি পোশাক দ্রুত বিকাশমান ও সব থেকে সম্ভাবনাময় খাত। তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে অর্থবছরে এক শতাংশ প্রণোদনার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতে তৈরি পোশাক খাত আরও বিকশিত হবে। কর্মসংস্থানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’
আর্থিক খাতে সার্বিক শৃঙ্খলা আনতে বাজেটে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে দূরদর্শী সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে সামগ্রিক অর্থনীতি স্থিতিশীল, বাজেট ঘাটতি সহনশীল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যাপ্ত, মুদ্রা বিনিময় হার বাণিজ্য সহায়ক। বাজেট ঘাটতি সবসময় পাঁচ শতাংশ ধরে রাখছি। কখনো এর থেকে কমও হয়।’
সুইস ব্যাংকের হিসাব নিয়ে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানার প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যরা বলেছেন টাকা সুইস ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। আপনার যাদের প্রশংসা করেন, যাদের কথা বেশি বলেন সুইস ব্যাংকের হিসেবের তালিকায় তাদের কথাটাই বেশি এসেছে। শুধু তা না, এমনও তথ্য এসেছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে একটা আসনের বিপরীতে তিন জনের অধিক বা দুই জনের অধিক মনোনয়ন দিয়ে যে বাণিজ্যটা করল তার টাকাগুলো কোথায় রাখল? এই খোঁজটা করলে সুইস ব্যাংকের হিসাবটা পেয়ে যাবেন।’
সংসদনেতা আরও বলেন, ‘খেলাপি ঋণের সংস্কৃতিটা কখন আসছে? যখন থেকে এই দেশে সামরিক শাসন এসেছে। এই সামরিক শাসন কীভাবে এসেছে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর। সামরিক শাসকরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে কিছু লোককে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে ব্যাংক থেকে অকাতরে ঋণ নেওয়া এবং ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতির সৃষ্টি। এটা ব্যাংকের ইতিহাস।’
তিনি বলেন, ‘যখন থেকে জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন থেকে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি শুরু। সেখান থেকে বের করে আনা অত্যন্ত কষ্টকর। তবে দেশে ধারাবহিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকলে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি চলে যেতে বাধ্য। ঋণে খেলাপি দূর করতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, নিয়ে যাচ্ছি।’
এক সাংসদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেট উত্থাপনের পর প্রত্যেকের কথা বলার অধিকার আছে। মন্ত্রীরা একমত কি না, বা সংসদ সদস্যরা একমত কি না? বাজেট যখন তৈরি হয় তখন সবার মতামতটা নেওয়া হয়। বাজেট যখন কেবিনেটে পাস হয়, পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর নিয়ে সংসদে আসে। বাজেট যেদিন উপস্থাপন করা হয় বিশেষ কেবিনেটের মাধ্যমেই বাজেট উপস্থাপন করা হয়। কাজেই সেখানে মন্ত্রীদের সকলের মতামতটা থাকে। তারপরও কথা বলার অধিকার সকলেরই আছে।’
গণফোরামের সদস্য মোকাব্বির খানের প্রশ্নের জবাবে সংসদনেতা বলেন, ‘উনি এক লাখ অটোমেশন মেশিন উপহার দেবেন। এটা আমরা গ্রহণ করলাম, উনি উপহার দেবেন। এখানে জনমত যাচাইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি যখন উপহার দিতেই চাচ্ছেন, দেশকে দেবেন, তিনি যথেষ্ট স্বচ্ছল তিনি পারবেন। দেবার মতো ক্ষমতা তার আছে।’