বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ অপরাহ্ন

প্রজাপতি-জীবন

স্বদেশ ডেস্ক:

লুসি বেল লোটের বয়স ২০ বছর। প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে-বেড়ানোর সময় এই তরুণীর। কিন্তু বিরল এক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তিনি। তার ত্বক এতোটাই নাজুক যে, সামান্য স্পর্শেই ছিঁড়ে যায়! ঠিক যেন প্রজাতির মতো। সামান্য স্পর্শেই প্রজাপতির ডানা ভেঙ্গে যায়। এই রোগে আক্রান্তদের বলা হয় ‘বাটারফ্লাই চিলড্রেন’ বা ‘প্রজাপতি শিশু’। প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়তে না পারলেও, লুসি এখন ‘প্রজাপতি জীবন’ই কাটাচ্ছেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, লুসি এপিডারমোলাইসিস বুলোসা (ইবি) নামক বিরল রোগে আক্রান্ত। এই রোগে শরীরের ত্বক সামান্যতম স্পর্শে ছিঁড়ে যেতে পারে এবং ফোস্কা পড়তে পারে। এ ধরণের রোগে আক্রান্ত মানুষ অল্পবয়সেই মারা যান।

‘অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, কখনো আমার মনে হয় কিনা বাড়তি পাওয়া জীবন কাটাচ্ছি…আমি অবশ্যই সেটা মনে করি না। কারণ এটা আমার নিজের জীবন। আর আমি সেটা সাধ্যমত ভালোভাবে ব্যবহার করে যেতে চাই।’

‘বেশিরভাগ সময়ে অনলাইনে আমি যে প্রশ্নের মুখোমুখি হই, সেটা হলো, এটা কি কষ্টকর? আর আমি তখন বলি, হ্যাঁ। ক্ষত বের করা বেশ ভালোই কষ্টকর,’ বলেন লুসি।

‘এই মুহূর্তে আমার গোড়ালিতে একটি বড় ক্ষত রয়েছে, আমি সত্যিই সেটার ব্যথা অনুভব করতে পারি।’

এই ক্ষত লুসিকে ভেতর থেকে আহত করতে পারে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কিশোরী বয়সে তার গলায় বেশ কয়েকটি অপারেশন করতে হয়েছে। কারণ তার গলার ভেতরেও এরকম ক্ষত দেখা গিয়েছিল।

রোগটি কি বংশগত?

ইবি রোগটি বংশগত। যার মানে হলো লুসি এ রোগটি পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছেন এবং সেটা ধরার কোনো উপায় নেই। রোগীরা এ থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয় না।

ধারণা করা হয়, বর্তমানে শুধু যুক্তরাজ্যে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের ইবি রোগটি রয়েছে এবং সারা বিশ্বে এই ধরণের রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ।

টেক্সাসের অস্টিন থেকে আসা লুসি বর্তমানে স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রু ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন।

তিনি বলছেন, তার ইবি রোগ প্রথম সনাক্ত করা হয় তার জন্মের সময়ে। কারণ জন্মের সময় তার শরীরের বেশ কয়েকটি জায়গায় কোনো চামড়া ছিল না।

‘যখন একজন নার্স আমার শরীর থেকে একটি মনিটরের বাটন সরিয়ে নিতে গেলেন আর শরীরের পুরো চামড়াটি উঠে এলো, তখন তারা বুঝতে পারলো কোনো একটা বড় ধরণের সমস্যা রয়েছে,” বিবিসির রেডিও ওয়ান নিউজবিটকে লুসি এ কথা জানান।

‘এটা যেন ছায়ার মতো’

‘আমার সাথে যেন আমার ছায়ার মতো বেড়ে উঠতে থাকে ইবি রোগটি,’ বলছেন লুসি।

‘যখন আমি আমার নাম জানলাম, একই সময়ে আমি এটাও জানলাম যে, আমি কী অবস্থায় রয়েছে এবং বুঝলাম যে আমি জীবনসীমায় রয়েছি।”

কিন্তু নিজের অবস্থার কারণে জীবনকে নেতিবাচকভাবে দেখার পরিবর্তে লুসি বরং ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করলেন।

এই রোগে আক্রান্তদের জন্য একজন সোচ্চার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠলেন লুসি এবং সচেতনতা তৈরিতে কাজ শুরু করলেন।

রোগটির কারণে ছোটবেলায় তাকে স্কুলে পড়াশোনা বাদ দিতে হয়েছে, যা তাকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে শিখিয়েছে।

‘আমি স্কুল ভালবাসতাম। আমি অদ্ভুত একটা বাচ্চা ছিলাম। এতটাই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, ভেবেছিলাম আমি হয়তো কখনোই আর কিছু শিখতে পারবো না। কিন্তু দেখলাম ইবি রোগ আমার শেখায় কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারলো না।’

নিজের ছবি ইন্সটাগ্রামেও পোস্ট করেন লুসি। তিনি বলছেন, এই রোগ নিয়ে টিকে থাকা অন্যান্য মানুষের সাথে সংযোগের জন্য এটা একটি বিশাল মাধ্যম।

লুসি বলেন, ‘কিশোরী বয়সটায় কঠিন সময় পাড় করতে হয়। কিন্তু এ ধরণে একটি রোগ থাকলে সময়টা আরো কঠিন হয়ে যায়।’

‘সুতরাং কোনো কিশোর-কিশোরী যদি তাদের মতো সমস্যা থাকা কাউকে মিডিয়ায় দেখতে পায়, তাহলে সেটা তাদের সাহায্য করতে পারে।’

এখন তিনি পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষজনের বার্তা পান, যাদের তার মতো একই ধরণের সমস্যা রয়েছে।

”প্রতিদিন সকালে উঠে আমি মানুষের ‘ধন্যবাদ’ বার্তা পাই, যা আমার হৃদয় পূর্ণ করে তোলে।”

‘তারা সবাই চমৎকার লোক’

লুসির এই আচরণ ইবি কম্যুনিটিতে একেবারে নতুন নয় বলে বলছেন ক্যারোলিন কলিন্স, ইবি বিষয়ক দাতব্য সংস্থা ডেবরার গবেষণা বিভাগের প্রধান।

‘আমার দেখা সবচেয়ে ইতিবাচক এবং অগ্রসর তরুণ মানুষদের মধ্যে তারা অন্যতম।’

‘যখন আমি দেখি, তাদের মধ্যে কতজন স্কুলে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, চাকরিবাকরি করছে এবং প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলেও সাধ্যমত সেরা জীবনযাপন করছে, সত্যি কথা বলতে আমি অবাক হয়ে যাযই। তারা সবাই চমৎকার মানুষ।’

কিন্তু বাস্তবতা হলো ইবি রোগটি আক্রান্তদের জীবন সংক্ষিপ্ত করে দেয়।

এখন রোগটির তিনটি ধরণ রয়েছে। লুসি রোগটির যে ধরণে ভুগছেন, ডিসট্রফিক ইবি, সেটির লক্ষণগুলো ছোট আকার থেকে অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে।

সবচেয়ে চরম হলো, জংশনাল ইবি- যা সবচেয়ে বিরল।

সামনের সপ্তাহে বিশ্বের ইবি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছেন ক্যারোলিন, যা এই ধরণের রোগের সম্মেলনে সবচেয়ে বড়। লুসিও সেখানে যোগ দিচ্ছেন।

ক্যারোলিন বলছেন, ‘গত কয়েক বছরে আমরা অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। কিন্তু এই খাতে আরো অনেক গবেষণার দরকার আছে। যেহেতু এটা বংশগত বিষয়, তাহলে হয়তো বংশগত কিছু চিকিৎসা সমাধান আমরা পেতেও পারি- যেসব চিকিৎসার জন্য সবাই স্বপ্ন দেখছেন।’

‘ইবি রোগের কিছু ধরণের ক্ষেত্রে, কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যেই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। অন্য রোগীরা হয়তো বিশ, ত্রিশ বা চল্লিশ বছর পর্যন্ত জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন।”

কিন্তু লুসির কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়া।

তাদের কাছে অনেক কাজের একটি তালিকা আছে। ‘এ বছরেই সচেতনতা তৈরিতে আমি আরো অনেক বেশি কাজ করতে চাই। অনেকগুলো ইন্টার্নশিপের জন্যই আমার আবেদন করতে হবে এবং সেই সাথে আমার মাস্টার্স ডিগ্রিটাও শেষ করতে চাই।’

‘এটা যদি আমার ওপর নির্ভর করতো, তাহলে সারাজীবন ধরে আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম।’

সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877