সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৮:৩৪ অপরাহ্ন

দেশত্যাগী সাইবার ইঞ্জিনিয়ার মর্তুজা আজম আজ বাংলাদেশীদের গর্ব

দেশত্যাগী সাইবার ইঞ্জিনিয়ার মর্তুজা আজম আজ বাংলাদেশীদের গর্ব

স্বদেশ রিপোর্ট: বাংলাদেশের ছোট্টো অজো পাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা মর্তুজা আজম – ই আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের সিনিয়র সাইবার সিকিউরিটি অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের সাইবার সিকিউরিটির প্রায় সকল প্রযুক্তিকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে এসে অটোমেটিক্যালি নিয়ন্ত্রন করার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন প্রতিষ্ঠানটির ওয়ার্ল্ড সদর দপ্তর শিকাগোর উইলিস টাওয়ারে (আমেরিকার একমাত্র ১১০ তলা টাওয়ার এটি)। পৃথিবীতে সাইবার নিরাপত্তা যখন এক মহামারী হুমকির নাম, যার হাত থেকে আপনার ফেইসবুক একাউন্ট, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেকশন ও নিরাপদ নয়। ঠিক তখনই বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার এস এম গোলাম মর্তুজা আজম শুধুমাত্র ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স – ই নয়। তিনি সাইবার সিকিউরিটি প্রদান করেছেন ম্যানহাটান বোরো প্রেসিডেন্ট অফিস, আমেরিকার ন্যাশনাল ব্রোডকাস্টিং কোম্পানি তথা ওয়ার্ল্ড এন্টারটেইনমেন্ট জায়ান্ট এনবিসি ইউনিভার্সাল (ঘইঈ টহরাবৎংধষ) এর মতো প্রতিষ্ঠানকে। আমেরিকাতে বসেও তিনি বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর উপদেষ্টা, এক্সেস টু ইনফরমেশন এর এডভাইজার, প্ল্যানিং মিনিস্টার প্রমূখ উচ্চ পর্যায়ের ব্যাক্তিবর্গের সাথে কনফারেন্স ও মিটিং অব্যাহত রেখেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায় মর্তুজা আজম বরিশালের বানারীপাড়া ইউনিয়নের আলতা গ্রামের অরণ্য ঘেরা এক পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করেন। বাড়িটিকে সিনেমায় দেখা কোনো এক ভূতের বাড়ি বললে হয়তো ভুল বলা হবেনা। একলা বাড়িতে চার ভাই আর মা বাবাকে নিয়ে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। বাবা শিক্ষকতা করতেন আর মা সন্তানদের নিয়েই কর্ম জীবন পার করছিলেন। ১৯৯৬ সালের কোনো এক রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে তাদের নীরব প্রশান্তির নীড়ে হামলা চালায় একদল নরপশু। মুহূর্তে রক্তের বন্যা বইতে শুরু করে। ক্লাস ২ তে পড়া ছোট্ট শিশু মর্তুজা আজম সিঁড়ি বেয়ে দোতলা দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে পা পিছলে নিচে পরে যায়। নিচতলায় পড়ে যাওয়ার পর সে ফ্লোরে দাঁড়াতে পারছিলোনা, বার বার পড়ে যাচ্ছিলো রক্তভেজা ফ্লোরে। মা বাবা আর ভাইয়ের রক্তে ভেজা ফ্লোরে হামাগুঁড়ি দিয়ে সামনের দরজায় এসে দেখতে পায় বস্ত্রহীন বাবাকে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে নর ঘাতকরা বিভিন্ন জায়গায় কোপাতে কোপাতে প্রায় মেরে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে প্রতিবেশীরা এসে বাবাকে, মাকে ও ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বানারীপাড়া থানা হাসপাতাল মর্তুজা আজমের বাবাকে ক্লিনিক্যালি ডেড দেখে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে প্রায় তিন দিন অচেতন থাকার পর জ্ঞান ফিরে পান তিনি। বাবার মাথায়, ঘাড়ে, কোমড়ে, হাতে, পায়ে প্রায় ২৮ টির ও বেশি বড়ো ধরনের কোপ দেয়। দুই হাতের সকল আঙ্গুলগুলো চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দেয় , আজও তিনি একজন শিক্ষক হয়েও আর কলম ধরতে পারেননা। এই কষ্ট শুধু মাত্র মর্তুজার নয়। এই কষ্ট একটা পরিবারের। শিশুদের অত্যন্ত প্রিয় একজন নিরীহ শিক্ষকের উপর বর্বরোচিত এই হামলা পুরো জাতিকে লজ্জিত করে। নরপশুরা মর্তুজা আজমের শরীরের এক ¯’ানে, তার মায়ের দুই হাতে, মেজো ভাইয়ের মাথায়, নাকে ও চোখের উপরে, কোমর ও পেটে কুপিয়ে জখম করে। দীর্ঘ কয়েক মাসের চিকিৎসার পর তার বাবা ফিরে আসেন হাসপাতাল থেকে বাসায়। না বাড়িতে নয়, ওই রাতের পর তাদের আর সেই ¯’ায়ী ঠিকানায় ফেরা হয়নি কোনোদিনই। সন্ত্রাসীদের ক্রমাগত হুমকি আর জীবনের অনিশ্চয়তা কখনোই ফিরতে দেয়নি তাদের জন্মভূমি তথা বসতবাড়িতে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিই যখন মুমূর্ষু তখন তাদের পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। জীবনকে আর জীবনের সাথে লড়াই করে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয় তা মর্তুজা আজম এবং তার পরিবার খুব ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করেন। এমন দুর্দিনেও মর্তুজা আজমের মা ধৈর্য ধারণ করে ৪ টি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। আজ যেন শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ৪ টি সন্তান শুধুমাত্র বাবা মায়ের কাছেই নয় সারা এলাকাবাসীর কাছেই ৪ টি রতœ। মর্তুজার বড়ো দুই ভাই দেশের পড়াশুনা শেষ করে আজ ইউরোপে সফল ব্যাবসায়ী। সেজো ভাই একসময়ের সনামধন্য সাংবাদিক, আইনজীবী ও ইকোনোমিস্ট। আর বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা মেট্টোতে কর্মরত। মর্তুজা আজম ও তার পরিবার বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীদের আক্রমণ ও আগ্রাসনের শিকার হন। ২০১৫ সালের ফেব্রূয়ারি মাসের ১৮ তারিখ মর্তুজার উপর গাজীপুরে জঙ্গিরা হামলা চালায়। এরপর বিবিন্ন সময় তিনি ক্রমাগত হুমকির শিকার হন। শেষপর্যন্ত তিনি মাতৃভূমির প্রতি মমত্ববোধকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হন ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন ও কর্মজীবন শুরু করেন। মর্তুজা আজম এতো অল্প সময়ে এতো বড়ো সাফল্যের পিছনে তার ঋণের কথা বলতে গিয়ে বলেন, আমি যে কত মানুষের কাছে ঋণী তা বলে শেষ করতে পারবোনা, প্রথমত আমি পরমকরুনাময় ও আমার মাতৃভূমির কাছে ঋণী, মা বাবা পরিবারের কাছে ঋণী, ছাত্রজীবনে যত খালা রান্না করেছেন তাদের কাছে ঋণী, শিক্ষকদের কাছে ঋণী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডঃ আতিউর রহমানের কাছে ঋণী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এডভাইজার আনির চৌধুরীর কাছে ঋণী এবং আমেরিকাতে এসে যত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তাদের সবার কাছে ঋণী। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মর্তুজা আজম ছিলেন মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকারী। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বিএসআইটি ও বাংলাদেশ পুলিশের ইনফরমেশন টেকনোলজির ট্রেইনার ছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের উপ¯’াপক ও সংবাদপাঠক, বাংলাদেশ টেলিভিশনের আবৃত্তিকার ও ডকুমেন্টারীর ভয়েস আর্টিস্ট, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার ইন্টার্ন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশনের একজন সফল ইন্টার্ন ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ এসেম্বলিতে ইয়াং লীডার হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন এবং প্রথম কোনো বাংলাদেশী হিসেবে ইউনাইটেড স্টেটের সিনেটে বক্তব্য ও রাখেন তিনি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে অর্জন করেন গ্রাডুয়েশন ও প্রোমাস্টারের স্বীকৃতি। বিভিন্ন ধরণের মেধা ভিত্তিক প্রতিযোগীতা, জাতিসংঘের গ্লোবাল এম্বাসেডর অ্যাওয়ার্ড তথা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স বেস্ট অ্যাওয়ার্ড সহ প্রায় ৭০ টিরও বেশি পুরস্কার ও ক্রেস্ট পান তিনি। সত্যিকারের জীবনসঙ্গিনী প্রাপ্তি এবং দেশ ও মানবতার সেবায় দুজন মিলে জীবনের বাকিটা সময় কাটানোর স্বপ্ন দেখছেন গোলাম মর্তুজা আজম।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877