বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১২:৫০ অপরাহ্ন

শিশুর অধিকার

স্বদেশ ডেস্ক:

একটি শিশু বাবার কলিজার টুকরা। মায়ের কলজেছেঁড়া ধন। চোখের শীতলতা। ভাইবোনের রতœ। বংশের গৌরব। আখিরাতের পাথেয়। এক মহান নিয়ামত। যদি তাকে সুসন্তানরূপে গড়ে তোলা যায়। পুণ্যবান ও আদর্শ সন্তান লাভের জন্য মা-বাবার ভূমিকা অপরিসীম। দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। সেই দায়িত্বগুলো যদি সুষ্ঠুভাবে আদায় করা যায়, তাহলেই আশা করা যায় সন্তান নেক হবে এবং নাজাতের উসিলা হবে। যথাযথ কর্তব্য পালনের পরও যদি সন্তান বিপথগামী হয় তাহলে মা-বাবা অবশ্যই দায়িত্বমুক্ত হবেন। আদর্শ ও নেক সন্তান গঠনে যা করণীয় তার কিঞ্চিত উল্লেখ করছি-

শিশুর জন্য আদর্শ মা নির্বাচন : শিশুর প্রথম ও প্রধান পাঠশালা হলো মা। তাই আদর্শ সন্তানের জন্য প্রয়োজন একজন দ্বীনদার ও পুণ্যবতী মা। জনৈক বিদ্বান বলেছিলেন, আমাকে একজন আদর্শ মা দাও, আমি তোমাদের একটি আদর্শ জাতি উপহার দেবো। এ কারণেই চৌদ্দ শ’ বছর আগে রাসূল সা: বলেন, ‘চারটি কারণে নারীকে বিয়ে করা হয়- তার সম্পদের জন্য; বংশ-ঐতিহ্যের জন্য; সৌন্দর্য ও ধার্মিকতার জন্য। তোমরা দ্বীনদার নারী বিয়ে করে সফল হও …’ (বুখারি-৫০৯০)। বৃক্ষগুণে ফল। তাই পুণ্যবতী নারী থেকেই চরিত্রবান সুসন্তান লাভ করা যায়। দ্বীনদারির অর্থ শুধু ইবাদত নয়, আল্লাহকে ভয় করে তাঁর যাবতীয় বিধিনিষেধ মান্য করে চলা। মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, ঘরের বউ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বগুলো পালন করে হৃদয়রাজ্য জয় করে নেয়া। পাশাপাশি বাবারও সৎচরিত্র, আল্লাহভীরু, আদর্শবান হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা পাথর থেকে পানি ও কাঁটা থেকে ফুল সৃষ্টি করতে পারেন। পারেন আবর্জনার স্তূপে পদ্মফুল ফোটাতেও। কিন্তু তার স্বাভাবিক নেজাম এমনটি নয়। তাই শিশুর জীবন-যাপন ও ধ্যান-ধারণায় মা-বাবা ও বংশের প্রভাব পড়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় মায়ের যতœ নেয়া ও আমলি জিন্দেগিও কাম্য। যুগে যুগে মনীষীরা সেই গুণবতী মায়েদের থেকেই জন্ম নিয়ে থাকেন।

নেককার সন্তান লাভের দোয়া করা : সুসন্তান আল্লাহ তায়ালার বড় নিয়ামত। এই নিয়ামতও চেয়ে আনতে হবে আল্লাহর কাছ থেকেই। কাকুতি মিনতি করে বারবার দোয়া করতে হবে। চাইতে হবে মহান রবের কাছে। হজরত ইবরাহিম আ: আল্লাহর দরবারে সুসন্তান লাভের দোয়া করেছেন- ‘হে আল্লাহ আমাকে নেক সন্তান দান করুন’ (সূরা সাফফাত-১০০)।

উত্তম সন্তান ও স্ত্রী লাভের জন্য দোয়া আল্লাহ তায়ালাই শিখিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ করেন- ‘হে আমাদের প্রভু আমাদের দান করুন চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী ও সন্তান এবং আমাদের বানান আল্লাহভীরুদের নেতা’ (সূরা ফুরকান-২৪)।
শিশুর কানে আজান-ইকামত দেয়া : পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাক্য আজান-ইকামতের বাক্যগুলো। যা শুনে শয়তানও পলায়ন করে। তাই শিশু জন্মের পরপরই ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দেয়া সুন্নত। শুরুতেই যেন শিশু শয়তানি ওয়াসওয়াসা ও স্পর্শ থেকে নিরাপদ থাকে এবং আল্লাহর একত্ববাদ ও রিসালাতের কথা কানে পড়ে। এর প্রভাব জীবনে গভীরস্পর্শী। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নিশ্চয়ই নবী সা: হাসান বিন আলী রা:-এর কানে আজান দিয়েছেন জন্মের দিন। ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত’ (শুয়াবুল ঈমান-৬/৩৯০)।

তাহনিক করা : জন্মের পর প্রথমে শিশুর মুখে লালামিশ্রিত মিষ্টি জাতীয় কিছু দেয়া। এ ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো- কোনো আল্লাহওয়ালা বুজুর্গের মুখ থেকে খেজুর বা মিষ্টান্নদ্রব্য চিবিয়ে এনে শিশুর তালুতে রাখা। হজরত আবু তালহা রা:-এর ঘরে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নবীজীর কাছে নেয়া হলে তিনি খেজুর চিবিয়ে তাহনিক করান এবং নাম রাখেন আব্দুল্লাহ। হজরত আবু মূসা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলেসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর রাসূল সা: এর কাছে নিয়ে আসি, তিনি তার নাম রাখেন ইবরাহিম, অতঃপর খেজুর দিয়ে তাহনিক করে বরকতের দোয়া করে দেন’ (বুখারি-৫০৪৫)।

সুন্দর নাম রাখা ও আকিকা করা : শিশুর ভালো নাম রাখা। জন্মের দিনেও নাম রাখা যায়। সপ্তম দিনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, নামেরও একটি ভালো-মন্দ প্রভাব রয়েছে। তাই সুন্দর অর্থবহ নাম রাখা উচিত। অনেককে দেখা যায় আনকমন ও নতুন নাম রাখতে গিয়ে এমন নাম রাখেন যা বুঝাই যায় না মুসলমান না অমুসলমান। এমন নামও রাখা উচিত নয় যা অশুভ হওয়ার ওপর ইঙ্গিত বহন করে। নবীজী সা: এমন নাম পরিবর্তন করে দিতেন। তিনি বনি মুগবিয়াকে (বিভ্রান্তকারীর সন্তান) পরিবর্তন করে বনি রুশদা (সত্যপথ প্রদর্শনকারীর সন্তান) রেখেছিলেন এবং হুজনকে রেখেছিলেন সাহল (সুচিন্তি)। আরেকটি বিষয় হলো আকিকা করা। আকিকার মাধ্যমে শিশু সব বিপদ মুসিবত থেকে রক্ষা পায়। ভূমিষ্ঠের সপ্তম দিনে আকিকা করা, নাম রাখা মাথা মুণ্ডিয়ে চুলের সমপরিমাণ রুপা বা তার মূল্য সদকা করা।
রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক শিশু (তিনটি বস্তুর সঙ্গে দায়বদ্ধ, তা হলো) জন্মের সপ্তম দিনে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে আকিকা করা, মাথা মুণ্ডন করা এবং নাম রাখা’ ( মুসনাদে আহমদ-২০১৩৯)। আকিকার ক্ষেত্রে ছেলে হলে দু’টি জন্তু আর মেয়ে হলে একটি জন্তু।

ছেলেদের খতনা করা : শিশু থাকতেই খতনা করানো উচিত। তবে সর্বোচ্চ সাত বছর বিলম্ব করা যেতে পারে। কারণ সাত বছরের পর থেকেই নামাজে অভ্যস্তির কথা বলা হয়েছে। খতনা পবিত্রতা অর্জনের সহায়ক হবে। খতনা ইসলামের একটি প্রতীক, নিদর্শন, সুন্নত। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতেও এর উপকারিতা অনেক। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘পাঁচটি কাজ মানুষের স্বভাবের সাথে সম্পৃক্ত। খতনা করা, নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা, বগলের লোম পরিষ্কার করা, নখ কাটা ও গোফ ছাঁটা’ (বুখারি-৫৮৮৯)।

সন্তানদের ভালোবাসা : শিশুরা মানব-বাগানের ফুল। সৃষ্টিকুলের সৌন্দর্য। পৃথিবীর ঝলক, চমকদার পুষ্প। ওদের হাসি-কান্না দুষ্টুমি সব কিছুই ভালো লাগে। ওদের নিষ্পাপতার ওপর অসংখ্য ফুলকলি উৎসর্গ করা যায়। শিশুদের অধিকার নিয়ে সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে ইসলাম। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের অধিকার জানে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (আবু দাউদ-৪/২৬১)।

শিশুদের আদর করা, কোলে নেয়া ও চুমু খাওয়া। এক গ্রাম্যলোক নবীজীর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলল, আপনারা শিশুদের চুম্বন করেন। আমরা শিশুদের চুম্বন করি না! এ কথা শুনে নবীজী বললেন, ‘যদি আল্লাহ তায়ালা তোমার অন্তর থেকে দয়া ও কৃপা ছিনিয়ে নেন তাহলে আমি কী করব?’
নবীজী সা: হজরত হাসান রা:-কে চুম্বন করলেন। সেখানে বসা আকরা ইবনে হাবেস রা: দেখে বললেন; আমার ১০ জন বাচ্চা রয়েছে। আমি তাদের কাউকেই চুম্বন করি না। নবীজী তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না’ (মাওয়ারিদুজ জামআন-২২৩৬)।
বৈষম্য না করা : সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে সেরা দান। যার নাই সে-ই বুঝে। ছেলেমেয়ে উভয়কেই সুসংবাদ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই উভয়ের জন্মেই খুশি হওয়া উচিত। কারো সাথে বৈষম্য করা যাবে না। এটি ইসলামের শিক্ষা নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে জাকারিয়া! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম ইয়াহইয়া। এই নাম আগে কারো রাখা হয়নি’ (সূরা মারইয়াম-৭)।

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যখন তাদের কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, মনোকষ্টে তাদের চেহারা মলিন হয়ে যায়। তাদের যে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে তার কারণে তারা আপন সম্প্রদায়ের লোকজন থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তারা ভাবে, এই সন্তান রাখবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট’ (সূরা নাহল : ৫৮-৫৯)। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবার প্রতি সুবিচার, ন্যায়ানুগ আচরণের নির্দেশ দিয়ে রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো, সন্তানদের ভেতর সুবিচার করো’ (বুখারি-২৫৮৭)।
সুশিক্ষা দেয়া : শৈশব থেকেই শিশুকে ইসলামী-মূল্যবোধ ও ধর্মীয় চেতনাবোধ শেখাতে হবে। হালাল খাওয়াতে হবে। ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝাতে হবে। সময় দিতে হবে। মানবসেবা, সময়জ্ঞান, অল্পে তুষ্টি, দান খয়রাত, অপচয়রোধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এক কথায় শিষ্টাচারিতায় অনুপম করে গড়ে তুলতে হবে। চারিত্রিক স্খলনের এই সময়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সব ধরনের ডিভাইস থেকে শিশুদের দূরে রাখা। সাত বছর হলে নামাজের আদেশ করা এবং ১০ বছর হলে বিছানা পৃথক করে দেয়া। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা আপন সন্তানদের নামাজের আদেশ করো, যখন সাত বছর হবে এবং ১০ বছর হলে নামাজের জন্য শাসন করো এবং বিছানা পৃথক করে দাও’ (আবু দাউদ-৪১৭)।

দিন দিন মানুষ বদলে যাচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় শিশু নির্যাতনের গা শিউরে ওঠা নানা সংবাদ। শিশুদের সাথে কখনোই হিংস্র আচরণ করা যাবে না। বুঝিয়ে সুঝিয়ে প্রয়োজনমাফিক শাসন করতে হবে। অতিরিক্ত চাপ ও শাসন যেমন ক্ষতিকর শাসন শিকেয় তুলে রাখাও আরো ক্ষতিকর।

লেখক :

  • মুফতি উবাইদুল্লাহ তারানগরী

শিক্ষক, জামিয়া ইবনে আব্বাস রা:, সামান্তপুর, গাজীপুর মহানগর

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877