হিজরি ১৪৪১ সন সমাগত। চান্দ্র বছরের সাথে সম্পৃক্ত হিজরি সন অনুযায়ী, মুসলমানদের সব ইবাদত বন্দেগি আবর্তিত। বহু প্রাচীনকাল থেকে সন গণনা প্রচলিত। অতীত যুগে আরবদের মধ্যে গোত্রগত বিভাজনের কারণে অনেক ধরনের সন বা বর্ষ গণনা করা হতো। তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সাল বা বর্ষ ছিল না। বিভিন্ন প্রকারের এসব সনের মধ্যে হজরত নুহ আ:-এর বন্যা সন, ইয়েমেনের খ্রিষ্টান বাদশা আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য প্রেরিত হস্তিবাহিনীর নামে আমুল ফিল, আমুল ফুজ্জার, আমুল ফতেহ, হবুতি, লুই এবং খসরু সন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আরবরা বণিক ছিল বিধায় আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রোমান সনকে অনুসরণ করা হতো। ব্যাবেলি সন চালু হয় সম্রাট বুখতে নসরের জন্ম তারিখ থেকে। মিসর ত্যাগ করে বনি ইসরাঈল যেদিন মুক্ত হয়, সে দিন থেকে তাদের সন গণনা শুরু। হজরত ঈসা আ:-এর জন্মদিন থেকে খ্রিষ্টাব্দ বা ইংরেজি সনের প্রচলন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং উজ্জয়িনীর কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্য খ্রিষ্টপূর্ব ৫২ অব্দে ভারতবর্ষে বিক্রমাব্দ প্রচলন করেন। রোমীয়, ব্যাবেলীয়, ইংরেজি, ইরানি, হিন্দুস্তানি প্রত্যেকটি সনের সূচনাতে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে।
আইয়ামে জাহেলিয়াহ বা তমসাচ্ছন্ন যুগের অবসান ঘটিয়ে মানব গোষ্ঠীকে আলোর পথে নিয়ে আসার তাগিদে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এক সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই তৌহিদের এ বাণী প্রচার করতে গিয়ে মুহাম্মদ সা:কে বহু সমস্যা ও নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। সাহাবায়ে কেরামসহ তিনি যখন দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে লাগলেন, তখন রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ আসে ইয়াসরিবের (মদিনা) উদ্দেশে হিজরত করার। তাই তিনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই (১২ রবিউল আউয়াল) মদিনার উদ্দেশে রওনা দেন প্রিয় সাহাবি হজরত আবু বকর রা:কে সাথে নিয়ে। নবী সা:-এর এ হিজরতেই ইসলামের পূর্ণতা লাভ, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র গঠন এবং মানব ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা করে। হিজরতের ১৭ বছর পর দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক রা: যখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখন কুফার গভর্নর ছিলেন হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি রা:। সে সময় প্রশাসনিক কাজের অসুবিধার কথা জানিয়ে সন ও তারিখ নির্ধারণের আবেদন করেন তিনি। সে আবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে হজরত ওমর ফারুক রা: একটি পরামর্শসভার আয়োজন করেন। সে সভাতেই প্রিয় নবী সা:-এর হিজরতের বছরকে সন গণনার বছর হিসেবে নির্ধারণের জন্য হজরত আলী রা: প্রস্তাব করলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। ইসলামী বর্ষ বা হিজরি সন গণনার তখন থেকে শুরু।
পবিত্র মহররম ইসলামী বর্ষের প্রথম মাস। এ মাস ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। মাসটি মর্যাদাবান বলে রাসূলে করিম সা: বহু হাদিস শরিফে ঘোষণা করেছেন। অনেক পবিত্র কাজ এ মাসে সম্পন্ন হয়েছে। আরবি আশারা অর্থ ১০। মহররম মাসের ১০ তারিখকে ‘আশুরা’ বলা হয়। এ দিনেই ১০ জন নবী আ:কে শুভ সংবাদ দেয়া হয়েছিল। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক মহররম, অর্থ নিষিদ্ধ। সব ধরনের যুদ্ধ-সঙ্ঘাত এ মাসে নিষিদ্ধ বলে মাসটির নাম মহররম। পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ এ মাসেই কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন রা:সহ ৭২ জন আহলে বাইতকে শহীদ করে।
জনসংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম দেশের সরকারও হিজরি নববর্ষ পালনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের নামে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে প্রশয়দান করছে। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা জোট কেউ ইসলামী নববর্ষ হিজরি সন পালনের উদ্যোগ নেয়নি। দেখা যায়নি পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করতেও। সংবাদপত্র বের করেনি বিশেষ সংখ্যা, আয়োজন নেই কোনো মিডিয়াতে বিশেষ অনুষ্ঠানের। এ অবস্থায় চট্টগ্রামে হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে বেশ কয়েক বছর ধরে যে অনুষ্ঠান হয়ে আসছে, তা নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ। বিশ্ব শান্তির দূত ও কল্যাণের প্রতীক রাসূল সা:-এর স্মৃতিবিজড়িত সন গণনার প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মহররম ছুটি ঘোষণা করে সরকারিভাবে হিজরি সন উদযাপনের ব্যবস্থা করা হোক। ২০১৫ সালে হিজরি নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনে দেয়া ১ নম্বর প্যানেল মেয়র যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছিলেন, কারো মৃত্যুবার্ষিকী পালনে সরকারি ছুটি দেয়া হলে হিজরি নববর্ষে কেন নয়!
লেখক : ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি- বিজেপি।