স্বদেশ ডেস্ক:
রাজধানীর মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনে গড়ে ওঠা বস্তিটিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ বলেন চলন্তিকা বস্তি, কেউ বলেন ঝিলপাড় বস্তি। শুক্রবার বিকালেও বস্তিটিতে ছিল হাজারো মানুষের আনাগোনা। শিশুদের হৈ-হুল্লোড়ে মুখরিত ছিল অলি-গলি। দোকানপাটে ক্রেতা সমাগম, কর্মজীবী মানুষের পদচারণায় প্রাণচাঞ্চল্য ছিল বস্তির প্রাঙ্গণ। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় লাগা আগুনের তা-বে ব্যস্ত সেই বস্তিটি এখন পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে।
প্রাণহানি না হলেও প্রাণ সচল রাখতে বস্তিবাসীর যে সহায়-সম্বল, আগুনের লেলিহান শিখায় তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আড়াই ঘণ্টার ভয়াবহ সেই অগ্নিকা-ে পুড়ে ছাই হয়ে পোড়া টিনের নিচে চাপা পড়ে আছে ৫ সহ¯্রাধিক পরিবারের স্বপ্ন। এখন ধ্বংসস্তূপে হাতড়ে বেড়াচ্ছে সব হারানো সেই মানুষগুলো, যদি কিছু অবশিষ্ট পাওয়া যায়। আর শিশুরা খুঁজছে তাদের প্রিয় বই-খাতা ও খেলনা।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়াদের এখন ঠাঁই হয়েছে ঘটনাস্থলের আশপাশে অবস্থিত পাঁচ-ছয়টি বিদ্যালয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে থাকা-খাওয়ার আপাত ব্যবস্থা হলেও সব হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। তবে ঝিলপাড় বস্তির অগ্নিকা-ের সূত্রপাতের বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। তবে বস্তিবাসীদের কেউ কেউ বলছেনÑ বস্তি উচ্ছেদের জন্য কেরোসিন দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে এ আগুন। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। বস্তির অগ্নিকা- নিয়ে সন্দেহের তীর ছুড়েছেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনও। গতকাল শনিবার বিকালে পুড়ে যাওয়া বস্তিটি পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার সঙ্গে যে বা যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেই হবে।’
তবে বিশিষ্ট এই রাজনৈতিক ও বস্তিবাসীর সন্দেহ উড়িয়ে দিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এমন মানসিকতা কারও নেই যে, আগুন লাগাবে। বস্তিতে যারা থাকেন তারাও মানুষ, যারা বস্তির বাইরে থাকেন তারাও মানুষ। সবার সঙ্গে একটি সুন্দর সম্পর্ক আছে। বস্তিবাসীদের আগুন থেকে উদ্ধার করার জন্য এলাকার মানুষই কিন্তু সহযোগিতা করছেন। আমার মনে হয় না, ইচ্ছে করে কেউ এখানে আগুন লাগিয়েছে।’ তিনি জানান, ঝিলপাড় বস্তিতে ছিল ২০ থেকে ২৫ হাজারের মতো ঘর। এতে প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার লোকের বাস ছিল। তাদের অনেকেই ঈদে গ্রামে ছিলেন। অনেকে ফিরে এসেছেন, অনেকে এখনো আসেননি। আগুনে বস্তির প্রায় সবই পুড়ে গেছে। বস্তিতে কীভাবে আগুন লেগেছে সেটা তদন্তের মাধ্যমে জানা যাবে।
গতকাল দুপুরে ফের বস্তি পরিদর্শন শেষে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আপাতত কয়েকটি স্কুলে ক্ষতিগ্রস্তদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। যতদিন ঘর তোলা না হবে, ততদিন স্কুলগুলোতেই তাদের থাকতে দেওয়া হবে। এ ছাড়া বাড়িওয়ালারাও চেষ্টা করছেন যাতে দ্রুত ঘর তুলে দেওয়া যায়। তা ছাড়া বস্তিবাসীর পুনর্বাসনের জন্য ২০১৭ সালে বাউনিয়া বাঁধে জায়গা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ইতোমধ্যে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এখানকার ১০ হাজার বস্তি পরিবারকে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর করা হবে।’ মেয়র আরও বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দেবে সিটি করপোরেশন। ইতোমধ্যে জরুরি কিছু সেবা যেমনÑ বিশুদ্ধ পানি, প্রাথমিক চিকিৎসা, খাবার ও ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
চলন্তিকা মোড়ের ঝিলপাড় বস্তিতে আগুনের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাজ করবে এ কমিটি। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (অপারেশনস) আব্দুল হালিম ও সহকারী উপপরিচালক নিয়াজ আহমেদ। গতকাল ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশনস) দেবাশীষ বর্ধন জানান, আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এ দিকে কয়েকজন বস্তিবাসীর দাবি, বস্তির উত্তর ও দক্ষিণÑ দুই দিক থেকে আগুনের সূত্রপাত। তাদের অভিযোগ, বস্তিকে যেন পুরোপুরি আগুনে গ্রাস করে সেটি নিশ্চিত করতেই দুই দিক থেকে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা পোশাকশ্রমিক দুলাল ও তার বাবা জানান, শুক্রবার সকালে ফরিদের ঘরে একবার আগুন লাগে। সেই আগুন নেভানোর পর সন্ধ্যায় আবার সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। এটা যড়যন্ত্রের আগুন। প্রায় ২২ বছর ধরে এ বস্তিতে বসবাসকারী খালেদা বলেন, ‘ঈদের সময়ে বেশিরভাগ মানুষ দেশে গেছে গা। বস্তি-মস্তি খালি, যার যার ঘরে সন্ধ্যার সময় রইছে; এমন সময় বস্তির মধ্যে আগুন লাগায়া দিছে। যেন এই বস্তিতে আগুন লাগায়া বড় বিল্ডিং করতে পারে।’
অবস্থার পারিপার্শ্বিকতার বিবেচনায় ডলি বেগম নামে এক বাসিন্দাও সন্দেহ পোষণ করে জানান, কেরোসিন দিয়ে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ঈদের কিছুদিন আগেও বস্তিতে অগ্নিকা-ের চেষ্টা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন বস্তিবাসী সুমি ও পারভিন। সুমি বলেন, ‘ঈদের কয়েকদিন আগেও ইব্রাহিমের ঘর থেকে আগুন লেগেছিল। সেবার দ্রুত দেখতে পাই এবং আমরাই আগুন নিভিয়ে ফেলি। এবার আর সেই সুযোগ আমাদের দেওয়া হয়নি। এই জমি যদি কারও লাগে আমাদের বললেই ছাইড়া দিতাম। আমরাও জানি এডা সরকারের জায়গা। যে যেমনে পারছি ঘর উডায়া থাকছি এতদিন। আমাদের ছাইড়া যাইতে বলতো, চলে যাইতাম। এমনে আগুন দিল ক্যান?’ অগ্নিকা-ের সময় কেরোসিনের গন্ধ পেয়েছেন দাবি করেন বস্তির আরেক বাসিন্দা। রাজিয়া বেগম নামে একজন বলেন, ‘গরিবকে এখানে থাকতে দেবে না বলে কেরোসিন দিয়ে সব পুড়িয়ে দিয়েছে। বস্তি উচ্ছেদের জন্যই আগুন লাগিয়ে দিয়েছে নাশকতাকারীরা।’
ঘটনার পর থেকে আগুন নেভানো থেকে শুরু করে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, ঝিলপাড় বস্তিতে লাগা আগুন ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠার পেছনে ছিল অবৈধ গ্যাসের লাইন। তিনি বলেন, ‘বস্তিতে প্রচুর অবৈধ গ্যাসের সংযোগ ছিল। এ লাইনগুলো টানা হয়েছিল প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে। যে কারণে আগুন ভয়ঙ্কর গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বস্তির অধিকাংশ ঘরই বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি। প্রায় প্রতিটি ঘরই ছিল দ্বিতল। এগুলো খুবই দাহ্য পদার্থ, আগুনের সংস্পর্শে এসে দ্রুত জ্বলে ওঠে ভস্মীভূত হয়।’
ঢাকা উত্তরের মেয়র ভয়াবহ সে অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিপরিবারের সংখ্যা ১০ হাজার বললেও ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. রেজাউল করিম জানান ভিন্ন কথা। গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে শুক্রবার রাতে লাগা আগুনে তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে আনুমানিক ৫০০ থেকে ৬০০ ঘর ছিল। আমরা কিছু ঘর এবং পরিবার সেভ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের অনুসন্ধান চলছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রথম থেকে আমাদের কাজ করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। কারণ, টিনের চালাঘর সব ধসে পড়েছে। এগুলো সরিয়ে কাজ করতে হয়েছে। আগুন নেভাতে আমাদের ২৪টি ইউনিট কাজ করেছে। কেউ নিহত হননি, তবে চারজন আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ সম্ভব হয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে উপ-পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, ‘আগুনের উৎস আমরা এখনো বের করতে পারিনি। অনুসন্ধান শেষে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে।’