বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০১:২৫ পূর্বাহ্ন

কোরবানির মহিমায় ভাস্বর হোক জীবন

কোরবানির মহিমায় ভাস্বর হোক জীবন

পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ আসন্ন। কোরবানি কী? কী তার দাবি ও শিক্ষা? এ মহাখুশির দিনে কিসের কোরবানি? কোরবানি মানে নিছক পশু জবাই না, ব্যাপকতর কোনো কোরবানির মহাদায়িত্ব মুসলমানদের স্কন্ধে রয়েছে?
বস্তুত: মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর কৃত পবিত্র কোরবানির মধ্যেই এ প্রশ্নাবলির জবাব রয়েছে।

মুসলমান মাত্রই কম-বেশি অবগত আছেন, আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহিম আ:-এর কাছ থেকে তাঁর সর্বাধিক প্রিয় বস্তুটির কোরবানি চেয়েছিলেন। মানবিক সরলতায় তিনি পশু জবাইকেই কোরবানি মনে করেছিলেন। তাই তিনি প্রথমত, ১০০ উট জবাই করেন। কিন্তু ওহি এলো, পশু জবাই হয়েছে বটে, কোরবানি হয়নি। দ্বিতীয়বার আবার ১০০ উট জবাই করলেন। কিন্তু এবারো একই অবস্থা, কোরবানি হয়নি। তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন, ভাবতে লাগলেন, আমার মাওলা আমার কাছে কী চান? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন। একসময় তিনি স্বপ্নযোগে প্রকৃত কোরবানির রূপরেখা পেয়ে গেলেন। দেখতে পেলেন, ঔরসজাত সন্তান হজরত ইসমাইল আ:কে কোরবানি করছেন। এতে তিনি বুঝে গেলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আমার কাছ থেকে আমার সর্বাধিক প্রিয় পুত্র বালক ইসমাইল আ:-এর কোরবানি চান’।

আপন প্রভু বা মাওলার সন্তুষ্টি অর্জনই হলো তাঁর জীবনের পরম চাওয়া ও পাওয়া। এ জন্য তিনি যেকোনো কোরবানি ও ত্যাগ করতেই কুণ্ঠিত ছিলেন না। মাবুদের প্রতি এই নিরঙ্কুশ মুহাব্বত ও নিবেদিত প্রাণ হওয়ার কারণেই তিনি ‘খলিলুল্লাহ্’ উপাধি পেয়েছেন।

ইবরাহিম আ: কালক্ষেপণ না করে কোরবানি করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। পিতা ইবরাহিম আ: পুত্র ইসমাইল আ:-এর কাছে গেলেন। জানালেন তাকে আল্লাহর নির্দেশ ও নিজের সিদ্ধান্তের কথা। পুত্র নিজ কানেই পিতার কথাগুলো শুনলেন। কিন্তু এতে তিনি মোটেও বিচলিত হলেন না। আল্লাহর নির্দেশ ও পিতার সিদ্ধান্তের সামনে নিজের মস্তক ঝুঁকিয়ে দিলেন নিঃসঙ্কোচে। ভক্তিভরা কণ্ঠে বললেন, ‘হে আমার আব্বাজান! আপনার প্রতি আল্লাহর আদেশ যথাযথভাবে পালন করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’

পিতা-পুত্র উভয়ে কোরবানির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। পিতা নিজ হাতে পুত্রকে জবাই করে দুনিয়ার মুহাব্বতকে কোরবানি করবেন, আর পুত্র আল্লাহর নির্দেশকে সমুন্নত রাখতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন। এতে উভয়ে লাভ করবেন আল্লাহর মহান সন্তুষ্টি। বস্তুত, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মহান হলে, তার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা নবীদের অমর শিক্ষা এবং এটাই মানুষকে সফলতার স্বর্ণচূড়ায় অধিষ্ঠিত করে।

হজরত ইবরাহিম আ:-এর অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল মহান। এর চেয়ে মহান আর কোনো লক্ষ্যই হতে পারে না। সেটি হলো, স্রষ্টার সন্তুষ্টি। মানব জীবনের সব চেয়ে বড় চাওয়া ও পরম পাওয়াও এটি। এ জন্য ইবরাহিম আ: একমাত্র বালক পুত্রকে কোরবানি করতে কুণ্ঠিত হননি। বয়োবৃদ্ধকালে আল্লাহ তায়ালা এই নিয়ামত দিয়েছিলেন তাঁকে। ঔরসজাত সন্তানের প্রতি কার না মুহাব্বত-ভালোবাসা থাকে? বিশেষ করে শেষ বয়সের সন্তানের প্রতি! এ ক্ষণস্থায়ী ভালোবাসাকে কোরবানি করে আল্লাহর চিরস্থায়ী সন্তুষ্টি ও মুহাব্বত অর্জন করতেই তিনি ইসমাইল আ:কে কোরবানি দিতে উদ্যত হলেন। পিতার হাতে তীক্ষèধার ছুরি আর পুত্র জমিনে শায়িত। একসময় পিতা-পুত্রের গণ্ডদেশে ছুরি চালাতে লাগলেন। সমস্ত পরিবেশে নেমে এলো নিস্তব্ধতার করুণ ছায়া। ইবরাহিম আ: আপন মনেই ছুরি চালাতে থাকেন। কিন্তু ছুরি তো ইসমাইল আ:-এর গলা কাটছে না! তারপরও পিতা ছুরি চালিয়ে যাচ্ছেন। এ দৃশ্য প্রকৃতি অবলোকন করেছে, তেমনি দেখেছেন সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা। তার জন্য ইবরাহিম আ:-এর এ কোরবানি।

আল্লাহ ওহি পাঠালেন, ইবরাহিম আ:! তোমার কোরবানি কবুল হয়েছে যদিও তোমার বালক পুত্র জবাই হয়নি! সে স্থলে জবাই হয়েছে জিব্রাইল আ:-এর আনীত বেহেশতি দুম্বা। পিতা-পুত্রের এ অপূর্ব ত্যাগ আল্লাহর এত বেশি পছন্দ হয়েছে যে, তিনি অমর গ্রন্থ কুরআনুল কারিমে এ ঘটনা বিবৃত করেছেন এবং সমগ্র মানব জাতিকে পরম প্রভুর তরে ত্যাগের দৃষ্টান্ত শিক্ষা দিয়েছেন। সাথে সাথে এ ঘটনার স্মারক হিসেবে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর ১০ জিলহজে পশু কোরবানির বিধান জারি করেছেন। আর সেটিই আমাদের ঈদুল আজহা।

পিতার হাতে পুত্র জবাইয়ের কোরবানি আল্লাহর ইচ্ছা নয়, তেমনি নিছক পশু জবাইও তাঁর কাম্য নয়। সেদিন ইবরাহিম আ:-এর পুত্র ইসমাইল আ: জবাই হয়ে যেতেন এবং ২০০ উট জবাইয়ের মাধ্যমে কোরবানি হতে পারত। বরং কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি বান্দার একনিষ্ঠ আনুগত্য, আল্লাহভীতি কতটুকু, তা যাচাই করেন। মানুষ আল্লাহর নির্দেশের সামনে কতটুকু মস্তকাবনত করে, তা-ই তিনি দেখে থাকেন। কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তার কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া’ (সূরা হজ, আয়াত-৩৭)।

এদিনের পশু কোরবানি বৃহৎ কোরবানির শিক্ষা দেয়। শিক্ষা দেয় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে জাগতিক সব মায়া-মুহাব্বত ত্যাগ করে আপনজন, আপনধন ও প্রাণ উৎসর্গের।

কোরবানি হলো- আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। এটি এতই ব্যাপক, যার পরিধি পূর্ণ মানব হায়াতে বিস্তৃত। প্রতিটি মুহূর্তে মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরবানির দাবি রয়েছে। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দাওয়াত ও তাবলিগ, তালিম, ওয়াজ-নসিহত, মাতা-পিতার সেবা, সন্তান-সন্তুতির প্রতিপালন, সবই কোরবানির আওতাধীন। এসব কিছুর জন্য নিজের জান-মাল-সময় ত্যাগ করতে হয় এবং এগুলো একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে থাকলে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব।

জিন্দেগির প্রতিটি মুহূর্তই ত্যাগ ও কোরবানির মহিমায় ভাস্বর। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এসব কোরবানিতে ভিন্নতা আসতে পারে। যেমন- রমজানে দিনের বেলা নিজের নফস ও উদরের চাহিদার কোরবানি করতে হবে, হজের সময় নিজের অর্থ, আত্মীয়-স্বজন ও মাতৃভূমির মুহাব্বতকে কোরবানি করতে হবে, জিলহজের ১০ তারিখে বিত্তবান মুসলমানদের পশু কোরবানি করে তার গোশত গরিব, মিসকিন ও আত্মীয়দের মধ্যে বিলাতে হবে প্রভৃতি।

রাসূলুল্লাহ সা:-এর মহান আদর্শ ও সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র জিন্দেগি এ বাস্তবতাই পেশ করে। হিজরতের নির্দেশ এসেছে, জন্মভূমি ও বাস্তুভিটার মায়া ত্যাগ করে তাঁরা হিজরত করেছেন। দ্বীনের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার ও অর্থ দান করার ডাক এসেছে, সাহাবায়ে কেরাম সোৎসাহে সাড়া দিয়ে শহীদ কিংবা গাজী হয়েছেন।

বিশ্বে মুসলমানদের বর্তমান দুরবস্থার অন্যতম কারণ, কোরবানিতে কার্পণ্য। এ কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানেরা কোণঠাসা। সমাজের এলিট শ্রেণীর মধ্যে দ্বীনের চর্চা খুবই হতাশাজনক পর্যায়ে।

ইলমের ময়দানে পর্যাপ্ত কোরবানি না হওয়ার কারণে সমগ্র বিশ্ব ইলমে ওহির নূর হতে বঞ্চিত। অমুসলিম শক্তি তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বায়নের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে মনস্তাত্ত্বিক বশংবদে পরিণত করে চলেছে। এর জন্য তারা হাজার প্রকারের পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করছে। বিলিয়ন ট্রিলিয়ন অর্থ এ খাতে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু আমাদের সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষানীতি থাকা সত্ত্বেও এর বিশ্বায়ন করা যায়নি।

জুলুম, অত্যাচার ও বাতিলের প্রতিরোধে পর্যাপ্ত কোরবানি না হওয়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে মুসলমানদের কী যে দুর্গতি। আরাকানে সামরিক জান্তা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করছে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক অভিযানে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে কত শিশু নিহত হয়েছে, এতিম হয়েছে কত সন্তান, কত নারী পাশবিকতার শিকার হয়েছে, কত সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, তার হিসাব কেউ দিতে পারবে না।

হাদিসে এসেছে, ‘যখন তোমরা ন্যায়, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তোমাদের ওপর জিল্লতি দুর্ভোগকে চাপিয়ে দেবেন।’ জিহাদের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কোরবানি না থাকার কারণে আমাদের আজকের দুর্দশা।

আজ হক, ইনসাফ ও মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আত্মত্যাগ না থাকার কারণে গোটা উম্মাহ চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। পবিত্র ফিলিস্তিন তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত! দ্বীন, মানবতা, ন্যায়-নীতি, শান্তি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রয়োজন।

আমরা যে কোরবানি আদায় করতে যাচ্ছি, তা মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর মহান সুন্নাত। আমরা তাঁর ধর্মীয় সন্তান। তিনি ঔরসজাত পুত্রকে কোরবানি করে অনাগত মুসলিম সন্তানদের জন্য ত্যাগের অমর নমুনা সৃষ্টি করেছেন। হজরত ইসমাইল আ: ও আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। পিতা-পুত্রের সমন্বিত এ কোরবানির স্মারক এ কোরবানি। তাই আমাদের ঈদের দিন পশু কোরবানির পাশাপাশি পাশবিকতার কোরবানি করে নিজেদের অন্তরাত্মাকেও পরিশুদ্ধ করতে হবে। সব ধরনের দাসত্ব পরিহার করে একমাত্র আল্লাহর সামনেই নিজেকে সঁপে দিতে হবে। ইসলামের সুমহান শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে পশুশক্তিকে নির্মূল করে মনুষ্যত্ব ও মানবতার বিজয় কেতন উড্ডীন করতে হবে। তবেই কোরবানি সফল ও সার্থক হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও শায়খুল হাদিস জামিয়া মাদানিয়া, বারিধারা, ঢাকা এবং মহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877