এক সময়ের পৃথিবীর ভূস্বর্গ হিসেবে খ্যাত কাশ্মিরের পরিস্থিতি নতুন এক ভয়ঙ্কর গন্তব্যের অভিমুখী হচ্ছে বলে মনে হয়। ভারতের বিজেপি সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন সংবলিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং এর আওতাধীন ৩৫ক অনুচ্ছেদ বাতিল করে এ বিতর্কিত অঞ্চলকে কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় নিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে কাশ্মিরের স্থিতি ও বাস্তবতাকে পাল্টে দেয়ার কৌশল বাস্তবায়নের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
এত দিন সেনা অভিযানের কারণে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন বাস্তবে কার্যকর না থাকলেও এর সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামো বিদ্যমান থাকায় এক ধরনের সুরক্ষা এই উপত্যকায় বিদ্যমান ছিল। সেই আচ্ছাদন তুলে দিয়ে কাশ্মিরকে শাসনতান্ত্রিকভাবে অরক্ষিত ও অধিকৃত ভূখণ্ডে রূপান্তর করতে চাইছে বিজেপি সরকার। ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং এর আওতাধীন ৩৫ক ধারার বিধান বলে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের সংসদের বিশেষ কিছু ক্ষমতা ছিল। অন্য রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ যেখানে পাঁচ বছর, সেখানে কাশ্মিরে বিধানসভার মেয়াদ ছিল ছয় বছর। কাশ্মিরের সরকার প্রধান ‘মুখ্যমন্ত্রী’র পরিবর্তে ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত হতেন। পররাষ্ট্র, অর্থ, যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি সব বিষয়ে রাজ্যের স্বার্থবিষয়ক কোনো আইন প্রণয়ন করতে হলে কেন্দ্রকে কাশ্মিরের সংসদের অনুমোদন নিতে হতো। কাশ্মিরের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে বিশেষত উপত্যকার জমি কেনা অথবা ভোটার হওয়া যেত না। স্থায়ী বাসিন্দা কারা হবেন, সেটি নির্ধারণ করত কাশ্মির সংসদ। সাধারণত ১০ বছর এখানে বসবাস না করলে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গণ্য করা হতো না।
কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদার ৩৭০ ও ৩৫ক অনুচ্ছেদ তুলে দেয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। কাশ্মিরের আগের মর্যাদা ছিল মূলত দেশীয় রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের মতো। আর পরিবর্তিত যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ বা রাজ্যের যে মর্যাদা রয়েছে তা থেকে আরো নিচে নামিয়ে কার্যকরভাবে কাশ্মিরকে একপ্রকার অধিকৃত ভূখণ্ডের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে লাদাখ অঞ্চলকে বিধানসভাবিহীন একজন লে. কমান্ডারের অধীনে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপ দেয়া হয়েছে। অন্য অংশ, জম্মু ও কাশ্মিরকে বিধানসভায় যুক্ত রেখে দিল্লির মতো একজন লে. কমান্ডারের অধীনে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে।
ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন
১৯৪৭ সালের পর অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভারতের সাথে জম্মু ও কাশ্মির যুক্ত হওয়ার পর থেকে এই রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’ সংক্রান্ত কিছু বিশেষ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হওয়ার সময় মুসলিম সংখ্যাগুরু রাজ্য ছিল জম্মু ও কাশ্মির। এই হিসেবে রাজ্যটি মূলত পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা। এটি ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ায় এর বিশেষ মর্যাদা যুক্ত হওয়ার শর্তটি সামনে আসে।
ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মির শুধু চারটি বিষয় ভারত সরকারের কাছে সমর্পণ করেছে। সেগুলো হলোÑ অর্থ, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্ট্র সম্পর্ক। কাশ্মিরের জন্য আলাদা সংবিধানের প্রসঙ্গ ছিল এবং ওই সংবিধান প্রণয়নের জন্য আলাদা অ্যাসেম্বলি গঠনের কথা ছিল। সে অনুযায়ী সাংবিধানিক অ্যাসেম্বলি গঠন করে আলাদা সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। কাশ্মিরের সংবিধান প্রণয়নের পর, ওই কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বিলুপ্ত করা হয়।
ভারত ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন গ্রহণ করার পর তখনকার গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন : ‘আমাদের সরকারের ইচ্ছা হলো কাশ্মিরের আইনশৃঙ্খলা বহাল হওয়া মাত্রই, রাজ্যের সংযোজনের বিষয়টি জনগণের গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করা হবে।’ মাউন্টব্যাটেন গণভোটের যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেটা ভারতের নেতারা পার্লামেন্টে বেশ কয়েকবার উত্থাপন করেছিলেন। তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুও ছিলেন। কিন্তু সেটি আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।
ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশনকে ভারতীয় সংবিধানের অংশ ঘোষণা করা হয়, যাতে ভারত সরকার ও ভারতীয় পার্লামেন্টের সাথে সাথে কাশ্মিরের ক্ষমতাও পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা থাকে। ১৯৫৪ সালে প্রেসিডেন্টের আদেশের মধ্য দিয়ে সংবিধানে ৩৫ক অনুচ্ছেদটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যেখানে জম্মু ও কাশ্মিরের নাগরিকদের বিশেষ অধিকার ও সুবিধা দেয়া হয়েছে। এটাকে ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ৩৫ক অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করার মূল উদ্দেশ্য হলো, এই রাজ্যকে অভিবাসী থেকে মুক্ত রাখা এবং বাইরের ক্রেতারা যাতে এখানকার চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা দখল করতে না পারে এবং এখানকার জাতিগত ও ধর্মীয় পরিস্থিতি যাতে বদলে দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।
সে কারণে ৩৫ক অনুচ্ছেদে কোনো নারী বাইরের কোনো পুরুষকে বিয়ে করলে তাকে কাশ্মির রাজ্যের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই নিয়মটির অধীনে এ ধরনের নারীরা রাজ্যের অধিকার হারাবে এবং তাদের উত্তরাধিকারীরাও ওই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, বাইরের কোনো ব্যক্তি রাজ্য থেকে স্থানান্তর-অযোগ্য কোনো সম্পত্তি কিনতে পারবে না, সেখানে স্থায়ী বসতি গড়তে পারবে না বা সেখানে রাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত কোনো স্কলারশিপ সুবিধা পাবে না। এই আইনের অধীনে, জম্মু ও কাশ্মির সরকার বাইরে থেকে জনবলও ভাড়া করতে পারবে না, যারা এখানকার অধিবাসী নয়।
জনসংখ্যায় ভারসাম্যে পরিবর্তন
বিবিসির এক বিশ্লেষণ অনুসারে জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদার পরিবর্তনের মূল কারণ হলো সেখানে জনসংখ্যার যে বিন্যাস রয়েছে, তাতে পরিবর্তন আনা। ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের ১৯০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে কাশ্মির ও জম্মু রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ২৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৭৮ জন। এর মধ্যে ৭৪.১৬% ছিল মুসলমান, ২৩.৭২% হিন্দু, ০.৮৯% শিখ, ১.২১% বৌদ্ধ এবং ০.০৩২% অন্যরা। বিবিসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের জম্মুতে এখন মুসলিম ৩০%, হিন্দু ৬৬% এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী ৪% বসবাস করছে। আর কাশ্মির উপত্যকায় মুসলিম ৯৫%, হিন্দু ৪% এবং ১% অন্য জনগোষ্ঠী বসবাস করে। লাদাখের জনসংখ্যার মধ্যে ৫০% বৌদ্ধ, ৪৬% মুসলিম এবং ৩% রয়েছে অন্যান্য ধর্মের অনুসারী।
কাশ্মিরে ৩৫ক অনুচ্ছেদের কারণে জনসংখ্যার এই ভারসাম্যে পরিবর্তন আনা যাচ্ছিল না। পরিবর্তনের নতুন পদক্ষেপের পেছনে মূল উদ্দেশ্য হতে পারে, এখানকার জনসংখ্যার বিদ্যমান ভারসাম্য পাল্টে দেয়া। ৩৭০ ধারার সুরক্ষা তুলে দেয়ায় এখন ভারতীয় হিন্দুরা কাশ্মিরে জায়গা কিনে বসতি স্থাপন করতে পারবেন এবং নির্বিঘেœ এখানকার ভোটারও হতে পারবেন। এত দিন অধিক হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল জম্মুতে মূল ভূখণ্ডের হিন্দু পুনর্বাসন কার্যক্রম চালিয়ে সেখানে হিন্দু-মুসলিম অনুপাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন জম্মুর পাশাপাশি মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মির উপত্যকায়ও এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া হবে। ‘সঙ্ঘ পরিবার’ ৫০ লাখ হিন্দু পরিবারকে ইতোমধ্যে জম্মু ও কাশ্মিরে পুনর্বাসনের জন্য কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে।
শুধু কি অনুচ্ছেদ ৩৭০?
কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন ও মর্যাদার জন্য একমাত্র ৩৭০ অনুচ্ছেদই ভারতের সংবিধানে সংযোজন করা হয়নি। এ ধরনের মর্যাদাপ্রাপ্ত রাজ্য আরো রয়েছে। সংবিধানের ৩৭১ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নাগাল্যান্ডের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। আর পার্লামেন্টের কোনো বিলই নাগাল্যান্ডের আইনসভায় অনুমোদিত না হলে সেটি ওই রাজ্যে প্রযোজ্য হয় না। এ ধরনের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্মসংক্রান্ত বিষয়, নাগাদের সামাজিক আচার, নাগা ঐতিহ্যগত আইন এবং আচরণবিধি, এখানকার জমি ও সম্পদের মালিকানা ও হস্তান্তর সংক্রান্ত বিষয়গুলো। এমনকি নাগাল্যান্ডের সিভিল ও অপরাধ বিচার প্রশাসনও ভারতীয় আইনের আওতামুক্ত।
তাই ভারতের পেনাল কোড, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ইত্যাদি আইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগাল্যান্ডের জন্য প্রযোজ্য নয়। একইভাবে, ৩৭১ অনুচ্ছেদের অধীনে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের জন্যও বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এর বাইরে আরো বহু রাজ্যের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আসাম (অনুচ্ছেদ ৩৭১খ), মনিপুর (অনুচ্ছেদ ৩৭১গ), অন্ধ্র প্রদেশ (অনুচ্ছেদ ৩৭১ ঘ ও ঙ), মিজোরাম (অনুচ্ছেদ ৩৭১ছ), অরুণাচল প্রদেশ (অনুচ্ছেদ ৩৭১ জ) এবং গোয়া (অনুচ্ছেদ ৩৭১ঝ)। সিকিমের ক্ষেত্রে এমনকি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ-নিষেধের কার্যকারিতা পর্যন্ত সীমিত করা আছে। এসবের মধ্যে বাতিল করা হয়েছে কেবল কাশ্মিরের মর্যাদা ও স্বায়ত্ত শাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ।
সঙ্ঘ পরিবারের মহাপরিকল্পনা
ভারতের সঙ্ঘ পরিবারের যে মহাপরিকল্পনা, তার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো কাশ্মির। এ মহাপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২৮ সাল নাগাদ ভারতকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা হবে। এ ক্ষেত্রে ‘মডেল’ ধরা হয়েছে ইসরাইলকে। ইসরাইলে ফিলিস্তিনি আরবদের বসবাস রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ইহুদি নাগরিকরা যে অধিকার ভোগ করে, সেই অধিকার পায় না আরবরা। সেখানে অ-ইহুদিদের কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা অনুসারে, আগামী এক দশকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দুত্বকে অনুসরণীয় আদর্শে পরিণত করা হবে। ইতোমধ্যে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, ভারতীয়দের প্রধান পরিচয় হবে ‘হিন্দুত্ব’। অন্য ধর্মে বিশ্বাসীরাও ভারতের নাগরিক থাকতে পারবেন। তবে তাদেরকে হিন্দুত্বের ভাবাদর্শ ও পরিচয়কে মেনে নিয়ে এখানে থাকতে হবে।
এই মহাপরিকল্পনার একটি প্রধান দিক হলো, জনমিতির পুনর্বিন্যাস। ভারতের যেসব অঞ্চলে অহিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, সেখানে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করা হবে। আর পুরো রাজ্য ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের অভ্যন্তরে যেসব অঞ্চলে অহিন্দুরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানকার জনবিন্যাসও যথাসম্ভব পাল্টে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে আসাম, পশ্চিম বঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং দক্ষিণের কয়েকটি রাজ্যকে প্রথম টার্গেট করা হয়েছে। এরপর অন্য রাজ্যগুলোকে বিবেচনায় আনা হবে।
এর বাইরে প্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ সরকারের কয়েকটি সংবেদনশীল ক্ষেত্রকেও টার্গেট করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুসারে, বিচার বিভাগে হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসীদের নিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিস, গোয়েন্দা বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রক পদগুলোতে যথাসম্ভব হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যেও মুসলিম ও সেকুলারিস্টদের প্রভাব কমিয়ে আনা বিজেপি শাসনের প্রধান লক্ষ্য। মোদি শাসনের পাঁচ বছরে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে এ কাজের একটি বড় অংশ বাস্তবায়ন করা হতে পারে। মোদির পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও দলের সভাপতি অমিত শাহের। তিনি দুই মেয়াদ শেষ করার পর যোগী আদিত্যনাথ দায়িত্ব নিতে পারেন।
বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের লক্ষ্য অর্জনে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি সামাজিক কর্তৃত্বের জন্য শিক্ষার কারিকুলাম এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নাটক-সিনেমা ইত্যাদি ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী দর্শনের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা রয়েছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে অন্য দেশের হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা এবং অহিন্দুদের নাগরিকত্ব পঞ্জি বা এনআরসির মাধ্যমে অনাগরিকে রূপান্তরের মাধ্যমে এক দিকে জনমিতি বিন্যাস; অন্য দিকে হিন্দু ও অহিন্দুদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে ভাগ করার লক্ষ্যও রয়েছে।
লক্ষ্য কি অভিন্ন?
ভারতের বিজেপি সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই কাশ্মিরকে ভারতের অঙ্গীভূত করার লক্ষ্য ছিল ভারতীয় শাসকদের। বিজেপির নতুন উদ্যোগের পর সংসদে কংগ্রেসের এমপি এবং সাবেক ইউনিয়ন মন্ত্রী কপিল সিবালের একটি বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ, রাজ্যসভায় জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা নিয়ে বিতর্কের সময় কংগ্রেস নেতা কপিল বলেছেন, ‘ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল (আরএসএসের গোপন সদস্য) কাশ্মিরকে ‘পাকিস্তানের অংশ’ হিসেবে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। সরদার প্যাটেল ধারা ৩৭০ পেশ করেন এবং আলোচনা যখন চলছিল, তখন তিনি কাশ্মির পাকিস্তানকে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। প্যাটেল মনে করতেন, জুুনাগড় অবশ্যই ভারতের সাথে আসতে হবে। জুনাগড়ের রাজা ছিলেন মুসলমান এবং তিনি পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। অন্য দিকে কাশ্মির শাসন করত হিন্দু রাজা এবং তিনি চেয়েছিলেন ভারতের সাথে যোগ দিতে। জওয়াহেরলাল নেহরুর কারণে ভারতের অংশ হয়েছে কাশ্মির।’
নেহরু ক্ষমতায় থাকতেই সামরিক অভিযান চালিয়ে জুনাগড়কে ভারতের অঙ্গীভূত করা হয়েছিল। আর কাশ্মিরি নেতা শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সাথে, ৩৭০ ধারার ব্যবস্থা ভারতীয় সংবিধানে স্থায়ীভাবে সংযুক্ত করার সমঝোতা হলেও সেটি অস্থায়ী বিধান হিসেবে রেখে দেয়া হয়। তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, যে বিধান সংবিধানে ৭ দশক ধরে বহাল থাকে সেটি আর অস্থায়ী থাকে না, স্থায়ী হয়ে যায়।
কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ব্যাপারে পি চিদাম্বরমের মতো দক্ষিণের কিছু কংগ্রেস নেতা তীব্রভাবে বিরোধিতা করলেও বিরোধী পক্ষের মূল নেতৃত্ব জোরালো কোনো ভূমিকা নেয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। রাহুল গান্ধী এই ইস্যুতে এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘একতরফাভাবে জম্মু ও কাশ্মিরকে ছিন্ন করে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কারাবন্দী করে এবং আমাদের সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় সংহতকরণকে আরো বাড়ানো যায় না। এ দেশটি তার লোকেরা তৈরি করেছে, এটি জমির কোনো প্লট নয়। কার্যনির্বাহী ক্ষমতার এই অপব্যবহারে আমাদের জাতীয় সুরক্ষার জন্য মারাত্মক প্রভাব রয়েছে।’
এর সাথে কাশ্মিরের সদ্যবিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির বক্তব্যকে বিবেচনা করা হলে দুই ধরনের বক্তব্যের পার্থক্য স্পষ্ট হবে। মেহবুবা টুইটারে বলেছেন, ‘আজকের দিনটি ভারতীয় গণতন্ত্রে অন্ধকারতম দিন হিসেবে চিহ্নিত হবে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান এবং ভারতের সাথে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত আজ কাশ্মিরিদের জন্য বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের ৩৭০ অনুচ্ছেদ একতরফাভাবে বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ও অসাংবিধানিক, যা ভারতকে জম্মু ও কাশ্মিরে পুরোপুরি দখলদার শক্তিতে পরিণত করবে।’
লক্ষ্য আজাদ কাশ্মির আর আকসাই চীনও
বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের লক্ষ্য যে শুধু ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির নয়, তা অনেকটাই স্পষ্ট করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য পুরো জম্মু-কাশ্মির ও আকসাই চীন। সবটাই ভারতের অংশ। জম্মু ও কাশ্মিরের ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশে কেন্দ্রীয় শাসন জারির পর আজাদ কাশ্মির আর আকসাই চীন দখলের প্রচেষ্টা চালানোর কথাই বলতে চেয়েছেন অমিত শাহ। পুলওয়ামার ঘটনার পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালানোর মধ্য দিয়েও সেই বার্তা একবার দিতে চেয়েছিল ভারত। কিন্তু সেই পদক্ষেপ ‘ব্যাকফায়ার’ করায় তখন আর বেশি দূর আগানো যায়নি। এখন নতুন পদক্ষেপের পর তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
এ কারণে কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারত যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা মোকাবেলায় ‘সম্ভাব্য সব কিছু করা’র ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতর ভারতীয় তৎপরতার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘ভারতঅধিকৃত কাশ্মির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড। ভারত সরকারের কোনো এক তরফা সিদ্ধান্ত এর বিতর্কিত মর্যাদা বদলাতে পারে না। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে তার স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। অধিকৃত কাশ্মির ও পাকিস্তানের জনগণের কাছে কখনো এই সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হবে না। আন্তর্জাতিক বিরোধের অংশ হিসেবে পাকিস্তান এই অবৈধ পদক্ষেপ প্রতিরোধে সম্ভাব্য সব কিছু করবে।’
পাকিস্তান যে কাশ্মির ইস্যু নিয়ে অনেক দূর যাওয়ার চেষ্টা করবে, সেটি বোঝা যায় দেশটির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ ব্যাপারে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সাথে কথা বলেছেন। পাকিস্তানের প্রচেষ্টায় কাশ্মির নিয়ে ওআইসি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মহাসচিব এক বিবৃতিতে, বিজেপি সরকার কর্তৃক কাশ্মিরের সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি, কাশ্মির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। একটি জরুরি সভাও আহ্বান করেছে ওআইসি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাশ্মির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে ওআইসি মহাসচিব বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের নির্ধারিত নীতিমালা মেনে কাশ্মির বিষয়ে একটি সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। কাশ্মিরে বিপুলসংখ্যক সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে ওআইসি উদ্বিগ্ন।
এরপর কী?
কাশ্মির ইস্যুতে এরপর কী হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এই ইস্যুতে ভারত যতটা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়বে বলে মনে করেছিল, তার চেয়ে অধিক চাপের মধ্যে পড়ছে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কোর কমান্ডারের বৈঠকে, এর আগে অনুষ্ঠিত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সভায় কাশ্মির প্রশ্নে সর্বোচ্চ গন্তব্যে পৌঁছার রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সব কিছু করার কথা বলেছেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কাশ্মিরের বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বলে যে বক্তব্য দিল্লি দিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করে গৃহীত পদক্ষেপকে অবৈধ বলে মন্তব্য করেছেন। চাপের মুখে অমিত শাহ সংসদে বলতে বাধ্য হয়েছেন, শান্তি ফিরে এলে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া হবে। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতেও একই ধরনের সুরক্ষা বহাল থাকবে কি না তা নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিজেপি সরকার কাশ্¥িরের মর্যাদা পরিবর্তনের বিষয়টি নৈমিত্তিকভাবে করেছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে কাশ্মিরের জনসংখ্যায় মুসলিম গরিষ্ঠতা থাকবে না। এরপর আজাদ কাশ্মির ও আকসাই চীন দখলের চেষ্টা করবে ভারত। তবে ভারতের সামরিক সক্ষমতা এমন পর্যায়ে নেই যে, যুদ্ধ করে চীন বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিল্লি জয়ী হবে। এরপরও বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদীদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। কাশ্মিরের পর আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবেন মোদি। ইতোমধ্যে তিনি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল এমপিদের ‘কেনার প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছেন।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবেশীদের সাথে বিজেপি সরকারের সর্বাত্মক বৈরিতায় যে সঙ্ঘাতের সূচনা ঘটেছে, তা অস্থিরতাকে দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে দিতে পারে। এটা পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে নিয়মিত যুদ্ধের পর্যায়েও চলে যেতে পারে। এ ধরনের সর্বাত্মক সঙ্ঘাতের পথ থেকে পরিস্থিতিকে আপাত শান্তির পথে আনতে পারেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আদালত যদি বিজেপি সরকারের পদক্ষেপের ওপর স্থগিতাদেশ দেন, তাহলে যুদ্ধের যে ডঙ্কা এখনই বেজে উঠেছে তা সাময়িকভাবে হলেও থামতে পারে। তা না হলে হিন্দুস্তানের ভয়াবহ যুদ্ধের যে পূর্বাভাস মনীষীদের বক্তব্যে উচ্চারিত হয়েছিল, সেদিকে পরিস্থিতি এগিয়ে যেতে পারে। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ভারতীয়রা জয়ী হতে পারবে না বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।