মুহাম্মদ মিজানুর রহমান:
হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা। পরিভাষায় হজ বলতে বোঝায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য হজের মাসের নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ ও তৎসংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে জিয়ারত ও বিশেষ কার্যাবলী সম্পাদন (কাওয়াইদুল ফিকহ)। হজ মানুষের জন্য অতি কল্যাণময় একটি ইবাদত। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ কাবাঘরকে সম্মানিত করেছেন। আর একে মানুষের কল্যাণে নির্ধারিত করেছেন’ (সূরা মায়েদা, আয়াত-৯৭)। পবিত্র কুরআনে হজরত ইবরাহিম আ: কে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেছেন, ‘তুমি মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা ছড়িয়ে দাও, যাতে করে তারা তোমার কাছে দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে আসে। আর দুর্বলরা আসে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে’ (সূরা হজ, আয়াত-২৭)।
হজরত ইবরাহিম আ:-এর পর যত নবী দুনিয়ায় এসেছেন, তাঁরা সবাই বায়তুল্লাহর জিয়ারত করেছেন, হজ পালন করেছেন। হজ পালন করার রীতি আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়ও প্রচলন ছিল, তবে তা ছিল হজের পবিত্রতা ও প্রকৃত ভাবগাম্ভীর্য ক্ষুন্ন করে মনগড়া খেল-তামাশা ও অশ্লীল চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে। সেকালে তারা উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করত। আল্লাহ জাহেলিয়াতের এই ভ্রান্ত ও মনগড়া কুসংস্কার চিরতরে বন্ধ করে হজের ইসলামী রীতি প্রবর্তন করেন। তিনি পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করলেন, ‘…যে ব্যক্তিরই এ ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর সামর্থ্য রয়েছে, সে যেন এ ঘরের হজ আদায় করে…’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৯৭)।
তাই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মুসলিম পবিত্র কাবাঘর জিয়ারতের সংকল্প নিয়ে ঘরটি তাওয়াফ করে থাকে। প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা এই মহাসম্মিলনে আরাফার ময়দানে সমবেত হন। আর আল্লাহর কাছে নিজেদের গুনাহ মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করেন। হৃদয় দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হন।
হজ বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম নিদর্শন। হজের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐহিত্য। এরই মাঝে রয়েছে শিক্ষণীয় নানা দিক। হজের তাৎপর্য উপলব্ধি করা মানুষের জন্য খুবই জরুরি একটি বিষয়। প্রতি বছর হজের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়ে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আল্লাহর দরবারে আহাজারি ও রোনাজারির মাধ্যমে অন্তর দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে যান। আর নিজেদের নাজাতের পথ খুঁজতে থাকেন। তাই ৯ জিলহজ দুপুরের পর থেকে ১০ জিলহজ ফজরের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় কিছুক্ষণের জন্য হলেও আরাফার ময়দানে অবস্থান করে। যা হজের একটি রুকন।
প্রায় চার হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম আ:, তাঁর প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল আ:-এর দ্বারা রচিত হয় মুসলিম উম্মার জন্য সাফা-মারওয়ায় সাঈ, মিনায় শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ আর কোরবানি করার নিয়ম। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সর্বযুগের নবী-রাসূল, আল্লাহর নেক্কার সত্যবাদী ও প্রিয় বান্দারা পরম আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সাথে আল্লাহর ঘর তাওয়াফের মাধ্যমে সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত নিজেকে পরিপূর্ণ উৎসর্গের মাধ্যমে রচিত হয়েছে হজ ও জিয়ারতের সুবিশাল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম আ: সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করলেও এর পর থেকে নবী-রাসূল পরম্পরায় চলে আসছে হজের বিধান। সব শেষে হজরত মুহাম্মদ সা: আল্লাহর নির্দেশে সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ অবশ্যপালনীয় ইবাদত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরটিকে তাওয়াফকারী, আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১২৫)।
হজের রীতি চালু হওয়ার আগে হজরত ইবরাহিম আ: আল্লাহর নির্দেশে স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাঈল আ:কে সাথে নিয়ে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন। যখন কাবাঘর পুনর্নির্মাণের কাজ শেষ হলো আল্লাহ হজের যাবতীয় হুকুম-আহকাম হজরত ইবরাহিম আ:কে জানিয়ে হজ পালনের নির্দেশ দিলেন। ইবরাহিম আ: স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাইল আ:কে নিয়ে সাতবার কাবাঘর তাওয়াফ করলেন। হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করলেন। এভাবে একের পর এক সম্পাদন করলেন হজের সব আহকাম।
হজের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য কল্যাণ। হজের প্রতিটি আমলের মধ্যে দু’টি বিষয়ের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এক. এটি যেন আখিরাতের সফরের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। দুই. আল্লাহর প্রতি বান্দার মহব্বত প্রকাশের এক অনন্য মাধ্যম। মানুষ যখন হজ পালনের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয় সে বাড়িঘর, ধনসম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনের মহব্বত ত্যাগ করে আল্লাহর রাহে পরকালের সফরে বের হয়। এই দীর্ঘ সফরের প্রতিটি পদে পদে সে যেন মরণের কথা স্মরণ করে। মরণে যেমন সব কিছু ছেড়ে যেতে হয়; তেমনি হজের এই দীর্ঘ সফরে একজন হাজীকে আর্থিক সম্পদ, মায়া-মহব্বত সব কিছুই ত্যাগ করতে হয়। যে যখন বিমানে চড়ে বা অন্য কোনো যানবাহনে আরোহণ করে হজের জন্য বের হয় এটি যেন তাকে মরণের পরে খাটিয়ায় সওয়ার হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একজন হাজীর শরীরে ইহরামের কাপড় পরে জড়ানো দুই টুকরো সাদা কাপড় কাফনের কাপড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন সে ‘লাব্বাইক আল্লাহুমা লাবাইক’ বলে মনে হয় সে যেন কিয়ামতের দিন আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিচ্ছে। আর যখন সাফা-মারওয়ার সাঈ করে সে যেন হাশরের ময়দানে পেরেশানি হয়ে ছুটোছুটি করছে।
কী চমৎকার শিক্ষা ও হিকমত নিহিত হজের বিধান পালনে। একজন হাজী দুনিয়াবি স্বার্থ বাদ নিয়ে শুধু আল্লাহপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ছুটে চলেন বায়তুল্লাহ জিয়ারতের উদ্দেশে। কখনো মক্কায়, কখনো আরাফায়, আবার মুজদালিফায় উপস্থিত হয়ে কান্নাকাটিতে ভেঙে পড়েন। কোথাও তার একদণ্ড দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। সবসময়ই তিনি ব্যস্ত থাকেন আল্লাহর ভালোবাসার অর্জনের মাধ্যমে অন্তরের প্রশান্তি হাসিলের জন্য। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বন-জঙ্গল, পাহাড়-নদী, সাগর পেরিয়ে বহু কষ্ট সহ্য করে পবিত্র মক্কার পথে-প্রান্তরে তিনি খুঁজে বেড়ান আল্লাহর সান্নিধ্য। হাজরে আসওয়াদ চুমু খাওয়া, মুলতাজাম জড়িয়ে ধরা, কাবার চৌকাঠ ধরে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়া, বায়তুল্লাহ শরিফের চারপাশ প্রদক্ষিণ করা সবই ইশকে ইলাহির অনুপম দৃষ্টান্ত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক