রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:১৩ পূর্বাহ্ন

ভর্তুকি বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কৌশল

ভর্তুকি বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কৌশল

স্বদেশ ডেস্ক:

মহামারী করোনা ভাইরাস ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটে এক ধরনের ঝুঁকিতে দেশের অর্থনীতি। এরই মধ্যে চলছে আগামী এক বছরের আয় ও ব্যয় নিরূপণের (বাজেট প্রণয়ন) কাজ। অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্য হতে হবে নিম্নবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে সুরক্ষা দেওয়া। ব্যয় ও আয় দুই ক্ষেত্রেই তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। মূল্যস্ফীতিকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখতে হবে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন অনেক বেশি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা চিন্তা করলে বাজেট ঘাটতি বড় বিষয় নয়। এই শ্রেণির মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ অর্থসহায়তা ও খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছেন। ফলে আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। এ লক্ষ্যে ভর্তুকি বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে মূল্যস্ফীতি- এমন কৌশল আপাতত নেওয়া হচ্ছে। কারণ আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। গরু, হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব পণ্যের দাম ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। অনেক খামার বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এ ক্ষেত্রে প্রণোদনা ও ভর্তুকি বাড়ানো হলে আবার উৎপাদন বাড়বে বলে মনে করছে সরকার। এ জন্য খাদ্যপণ্য, সার, জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যে ভর্তুকি প্রণোদনা বাড়িয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল নিয়েছে অর্থ বিভাগ। আর সেটি বাস্তবায়ন করতে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় আগামীতে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা বেশি।

অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরের রাজেটে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ দিয়েছে সরকার। করোনা মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে এখন উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে- চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, ডিম ও মাছ-মাংসের মতো প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্য। এ অবস্থায় জনজীবনে স্বস্তি দিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে সরকার। করোনা মহামারী মোকাবিলার মতো এবার দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে সার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাড়ানো হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিয়োগ বাড়াতে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা এবং কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে নতুন বাজেটে।

আগামী বাজেট সামনে রেখে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাড়ানোর একটি কাঠামো দাঁড় করেছে অর্থ বিভাগ। নতুন বাজেটে সর্বোচ্চ ভর্তুকি পাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। এ খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে ভর্তুকি দ্বিগুণ হচ্ছে এই খাতে। তবে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়ে মোট ১২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াচ্ছে বলে জানা যায়।

নতুন বাজেটে কৃষি খাতে প্রণোদনা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রণোদনা বাড়ছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে আড়াই হাজার কোটি টাকা বেড়ে মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র মতে, এলএনজির আমদানি মূল্য পরিশোধ, প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ ভর্তুকি পরিশোধ ও অন্যান্য খাতে নতুন বাজেটে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এসব খাতে ভর্তুকি বাড়ছে সাত হাজার কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এসব খাতে ভর্তুকি পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেড়ে মোট ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দাঁড়াচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ। ধরে নেওয়া হচ্ছে, নতুন কৌশল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। যদিও বিশ্ববাজারের প্রভাবে দেশের মূল্যস্ফীতির হার বর্তমান ৬ দশমিক ২২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হলে সংশোধিত বাজেটে এ হার বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও মূল্যস্ফীতির হার ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। এর পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছেন। এতে মূল্যস্ফীতির হার লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। এতে হতদরিদ্র, নিম্নআয়ের মানুষ, শিক্ষিত বেকার ও সব শ্রেণির ভোক্তাসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সংকট থেকে বের হতে পারছেন না। এসব বিষয়কে সামনে রেখে মোটা দাগে আগামী বাজেটে সংকট মোকাবিলা ছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়াতে এবারও অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হবে আগামী বাজেটে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাড়াতে এ খাতে প্রণোদনা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। আগামী বাজেটের অগ্রাধিকার খাতগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় কৌশল নির্ধারণ, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অধিক খাদ্য উৎপাদন এবং সারের ভর্তুকি অব্যাহত রাখা। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি, নিম্নআয়ের মানুষের বিনা বা স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি বাড়ানো হবে। সম্ভাব্য ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার ব্যয় ধরে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি চলতি বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩ কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটের আকার জিডিপির ১৫.৪ শতাংশ। তবে শেষ পর্যন্ত বাজেটের আকার কিছু বাড়ানো বা কমানো হতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট এমন একসময়ে দেওয়া হচ্ছে যখন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, পণ্যের চড়া দাম, একই সঙ্গে দেশের ভেতরও মূল্যস্ফীতির করাঘাতে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য মূল্যস্ফীতিকে কেন্দ্রীয় সূচক হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। অন্য সূচকগুলোকে সহযোগী হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে নিম্নআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অবস্থায় সরকারকে বাজেটে নিম্নআয়ের মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে জনবান্ধব বাজেট প্রণয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877