সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ০১:২৬ অপরাহ্ন

বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন তিনি

বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন তিনি

গাজীউল হাসান খান:

মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা ও সহিংসতা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল তাঁর। শিক্ষা, রাজনৈতিক অনুশীলন ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার কথা বলেছেন তিনি। ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি

কিংবদন্তিতুল্য লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার বয়সের বেশ কিছুটা ব্যবধান থাকলেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠতা ছিল অকৃত্রিম। অনেকটা অবিমিশ্র বলা যায়।

প্রয়াত সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর পেশাগত জীবন কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থা কোনো সময়ই নিষ্কণ্টক ছিল না। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে লন্ডনে পাড়ি জমানোর আগে ঢাকায়ই তখন তাঁকে কয়েকবার কর্মক্ষেত্র কিংবা কর্মস্থল ত্যাগ করতে হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় কাজ করে শেষ পর্যন্ত তিনি দৈনিক জনপদ বের করেন। তবে সর্বত্রই মূলধারার পাঠকের কাছে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর প্রধান আকর্ষণ ছিল তাঁর রাজনৈতিক কলাম। একুশের প্রেক্ষাপটে তাঁর রচিত অসাধারণ গান—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ যেমন তাঁকে অলিখিত অমরত্ব দিয়েছে, তেমনি তাঁর রচিত রাজনৈতিক কলামগুলো তাঁকে দিয়েছে এক যুগান্তকারী সফলতা। স্বাধীনতাপূর্ব কিংবা পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় তেমন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কলাম লেখক ছিলেন তিনি। তাঁর রচিত কলামের মাধ্যমেই একজন বোদ্ধা পাঠক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর অসাধারণ ইতিহাস সচেতনতা, সমাজনিবিষ্টতা, তথ্যজ্ঞান ও সময়োপযোগী রচনা ও উপস্থাপনার মুনশিয়ানা উপলব্ধি করতে পারেন। তাঁর সে রচনাশৈলীর প্রভাব গাফ্‌ফার চৌধুরী রচিত সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি যে একজন অত্যন্ত বড় মাপের দেশপ্রেমিক ছিলেন, সেখান থেকে তাঁর দীর্ঘদিনের প্রবাসে অবস্থান তাঁকে একটুও বিচ্যুত করতে পারেনি। তাঁর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রত্যয় কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি তাই জাতিকে তার বিপন্ন অবস্থা কিংবা বিপর্যয়ের মুখে আলোকবর্তিকা বা পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছে।

আমি আগেই বলেছি, গাফ্‌ফার চৌধুরীর পেশাগত জীবন কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থা কোনো সময়ই নিঃসংশয় বা নিষ্কণ্টক ছিল না। কিন্তু কোনো বৈরী পরিস্থিতি কিংবা সংকট এই দৃঢ়চেতা মানুষটিকে তাঁর অনুসৃত নীতি বা আরাধ্য লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। তাঁর আপসহীন কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় ঘটেছিল একটি অতি উচ্চ মানের পেশাদারি, যা বিত্ত-বৈভবগত শত লোভ-লালসা কখনো কাবু করতে পারেনি। তবে রাজনীতিগতভাবে একটি সহায়ক সময় কিংবা সুদিনের অপেক্ষায় কাল গুনেছিলেন তিনি। হয়তো বা সে সময়ের শুরু দেখলেও শেষ দেখে যেতে পারেননি গাফ্‌ফার চৌধুরী। তিনি জানতেন এটি একটি সুদূরপরাহত বিষয়, যা কাঙ্ক্ষিতভাবে সম্পন্ন হওয়ার নয়। ঢাকার মতো না হলেও লন্ডনে বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় কাজ করেছেন গাফ্‌ফার চৌধুরী। নিজেও বের করেছেন একাধিক সাপ্তাহিক কাগজ। জীবন-জীবিকার চাহিদা মেটাতে অনেক সময় সংবাদপত্র কিংবা সাংবাদিকতা জগতের বাইরেও কাজ করেছেন তিনি। আবার সুযোগ পেলেই ফিরে এসেছেন নিজের কাঙ্ক্ষিত পরিমণ্ডলে। তাঁর প্রকাশিত দুটি পত্রিকা আমার তৎকালীন ব্রিকলেনের প্রিন্টিং প্রেসে ছাপা হয়েছে। আগাগোড়া না হলেও স্বল্প সময়ের জন্য। অনেক সময় তিনি ছাপার খরচটাও ঠিকমতো দিতে পারেননি। আবার কোনো কোনো সময় অর্থের সংস্থান হলে সেধে এসে বকেয়া পরিশোধ করে গেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে আমরা দুজনই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ও জয় বাংলা পত্রিকায় নিজ নিজ অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে দৈনিক বাংলায় লিখেছেন ‘নিরুদ্দিষ্ট নয় মাস’।   ‘নিরুদ্দিষ্ট নয় মাস’ সম্প্রতি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী স্বেচ্ছায় কখনো তাঁর সাংবাদিকতার পরিমণ্ডলকে ছেড়ে যাননি। এ ব্যাপারে আমাদের কারো কারো ক্ষেত্রে পদস্খলন ও বিচ্যুতি ঘটলেও তিনি ছিলেন এ জগতের একজন স্থায়ী বাসিন্দা। সাংবাদিকতাকে পেশাগত ও কৌশলগত কারণে অত্যন্ত ভালোবাসতেন তিনি। নিজের পেশাগত দিক ছাড়াও তিনি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, গণমাধ্যমের সক্রিয় ও গঠনমূলক ভূমিকা বা অবদান ছাড়া বাংলাদেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সে কারণেই কোনো কোনো সময় তিনি নিজের সমর্থন করা সরকারের বিরুদ্ধেও লিখেছেন। প্রয়োজনে বারবার গঠনমূলকভাবে পথ দেখিয়েছেন, সমালোচনা করেছেন। তা অনেক সময় ভালো ফল দিয়েছে। তবে এখানে একটি কথা যা না বললেই নয়, আমরা গাফ্‌ফার চৌধুরীর মতো প্রতিভার পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। তাঁর মতো প্রতিভার সঠিক স্ফুরণ ঘটাতে গেলে কিংবা তাঁর চিন্তাধারার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন ছিল তাঁর পেছনে বিশাল বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা। এই সৌভাগ্যটি কর্মক্ষম অবস্থায় ভাগ্যে জোটেনি আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর। এতেও তিনি হতাশ হননি। বাংলাদেশ নিয়ে প্রবল আশাবাদী ছিলেন। তবে মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা ও সহিংসতা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল তাঁর। এর জন্য শিক্ষা, রাজনৈতিক অনুশীলন ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার কথা বলেছেন তিনি। ধর্মহীনতা নয়, ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

আজ সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আমাদের মধ্যে আর নেই। কিন্তু তিনি পথনির্দেশ দিয়ে গেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা ও জাতি গঠনে সেগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া দুঃসাধ্য নয়।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মতো একজন লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট যেকোনো জাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর মতো প্রতিভা প্রতিদিন জন্মায় না। যেকোনো জাতিকে একজন গাফ্‌ফার চৌধুরীর মতো প্রতিভার জন্য যুগ যুগ অপেক্ষা করতে হয়। যেকোনো জাতি একজন গাফ্‌ফার চৌধুরীর জন্য নিজেদের ধন্য মনে করতে পারে। তাঁর আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত রয়েছে আমাদের অনেক সাফল্যের পথ। আসুন, আমরা সেগুলো বাস্তবায়নে দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যাই।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877