আহমদ মতিউর রহমান: বুকার পুরস্কার স্বনামে ফিরছে এবং অতি সম্প্রতি ঘোষিত এ বছরের পুরস্কারের লংলিস্টেও সাহিত্যবোদ্ধা ও পাঠক পাঠিকাদের জন্য রয়েছে চমকের পর চমক। আমরা ছয় মাস আগেই জানিয়েছিলাম বুকার পুরস্কার ফিরছে স্বনামে। হয়েছেও তাই। গত ১ জুন এই পুরস্কারের দায়িত্ব নিয়েছে নতুন একটি সংস্থা। ২০০২ থেকে ম্যান গ্রুপ পিএলসি নামে একটি বড় ব্রিটিশ কোম্পানি এই পুরস্কারের স্পন্সর ছিল। তারা ৩১ মে বিদায় নিয়েছে বা ছেড়ে গেছে। সবাই জানেন, ১৯৬৯ সালে বুকার পুরস্কার যখন প্রদান শুরু হয় এর নাম ছিল বুকার ম্যাক কনেল প্রাইজ। ম্যাক কনেল গ্রুপ ছিল এর স্পন্সর বা আয়োজক। ২০০২ সালে তারা ছেড়ে দিলে ম্যান গ্রুপ দায়িত্ব নেয় এবং ম্যান বুকার প্রাইজ হিসেবে গত বছর পর্যন্ত তারা এ পুরস্কার দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পুরস্কারের অঙ্কও বাড়িয়ে ২১ হাজার পাউন্ড থেকে ৫০ হাজার পাউন্ড করা হয়। চালু করা হয় ইন্টারন্যাল ম্যান বুকার নামে আরেকটি প্রাইজ। আগে এর পেছনে ম্যাক কনেল থাকলেও সংক্ষেপে একে বুকার প্রাইজই বলা হতো। ম্যান গ্রুপের বিদায়ে তাই আমরা বলছি স্বনামে ফিরল বুকার।
কালক্রমে বুকার যুক্তরাজ্যের সাহিত্য পুরস্কার হিসেবেই থাকেনি, হয়ে উঠেছে নোবেলের পর সবচেয়ে মর্যাদাবান ও ধনী পুরস্কার। বিখ্যাত সব লেখক এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বুকারের সাথে পাঁচ বছরের জন্য যুক্ত হয়েছে সিলিকন ভ্যালি মিলিয়নিয়ার হিসেবে খ্যাত স্যার মাইকেল জোনাথন মারিটজ। আরো পরিষ্কার করে বললে মারিটজ ও তার স্ত্রী হ্যারিয়েট হেম্যানের যৌথ সংস্থা মারিটজ অ্যান্ড হেম্যান ফাউন্ডেশন পরিচালিত সংস্থা ক্র্যাংকস্টার্ক। মারিটজ টাইম ম্যাগাজিনের একজন সাবেক সাংবাদিক ও লেখক হিসেবেও সুপরিচিত। স্টিভ জবসের জীবনীকার হিসেবেও খ্যাত তিনি। এর পর একজন ফিলানথ্রপিস্ট হিসেবেও তার খ্যাতি আছে। তার সম্পদের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন পাউন্ড। তিনি পাঁচ বছরের জন্য এই পুরস্কারের স্পন্সর হয়েছেন। এবং দুটো পুরস্কারই থাকবে, অর্থমূল্যও আগের মতোই থাকবে। পরে আরো পাঁচ বছরের জন স্পন্সরশিপ নবায়নও হতে পারে।
** ২৪ জুন লন্ডনে বুকার পুরস্কারের ১৩টি বইয়ের লংলিস্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই লংলিস্ট প্রকাশের পর বলতে গেলে সাহিত্য অঙ্গনে রীতিমতো তাক লেগে গেছে। লাগবেই বা না কেন। কেননা এতে রয়েছে চমকের পর চমক। কানাডার বিখ্যাত লেখিকা সাবেক বুকার জয়ী মার্গারেট অ্যাটউডের যে বই এখনো প্রকাশিতই হয়নি তা রয়েছে এই তালিকায়। তার উপন্যাস ‘দি হ্যান্ডমেইড টেল’ এর সিক্যুয়াল আগামী সেপ্টেম্বরে প্রকাশিতব্য ‘ দি টেস্টামেন্টস’ আছে এই তালিকায়। এই বইয়ে কি আছে জানতে পাঠক পাঠিকাদের আরো দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে। এই নিয়ে ছয়বার তিনি এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন। চমক আরো আছে। বিতর্কিত লেখক ও সাবেক বুকার জয়ী সালমান রুশদি আছেন এ তালিকায়। তার বইও প্রকাশিত হবে আগামী মাসে। মার্গারেটকে এখন অন্য অনেকের সাথে রুশদির সাথেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। রুশদিও বই ‘কুইকচোট’। চিরায়ত উপন্যাস ‘ডন কুইকজোট’ এর প্রভাব এতে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অপ্রকাশিত আরো বই আছে এই তালিকায়। এসব কা- কেন ঘটেছে তা বিচারক প্যানেলই ভালো বলতে পারবেন। বিচারক প্যানেলের সভাপতি হলেন হে ফেস্টিভালের পরিচালক পিটার ফ্লোরেন্স। অবশ্য তারা ঠারেঠুরে কিছু কিছু বলেছেনও।
**এবারের লংলিস্টে রুশদি ছাড়াও রয়েছেন আরো ছয়জন ব্রিটিশ লেখক-লেখিকা। সমালোচনার মুখে মার্কিন লেখক-লেখিকা কমেছে। আছেন একমাত্র লুুসি এলম্যান। তার জন্ম আমেরিকার ইলিনয়েসে, পরে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। তার বইয়ের নাম ‘ডাকস, নিউব্যারিপোর্ট। লংলিস্টে আছে তুর্কি লেখক আলিফ শাফাক। তাই বইয়ের নাম ‘টেন মিনিটস থার্টি এইট সেকেন্ডস ইন দিস স্ট্রেঞ্জ ওয়ার্ল্ড’। আছেন আইরিশ লেখক কেভিন ব্যারি, তার বইয়ের নাম ‘নাইট বোট টু টাঞ্জিয়ার’। এটা একটা ক্রাইম ফিকশন। আর শাফাকের উপন্যাস ইস্তাম্বুলের রাতের জীবনকে উপজীব্য করে লেখা, যা নিয়েও বিতর্ক হওয়া স্বাভাবিক। তালিকায় আছেন নাইজেরিয়ার লেখক চিগোজি ওবিওমা। তার উপন্যাসের নাম ‘অ্যান অর্ক্সেস্টা অব মাইনোরিটিস ’। এটা ওডিসির ওপর ভিত্তি করে হালকা চালে লেখা। আর মেক্সিকান-আমেরিকান লেখিকা ভ্যালেরিয়া লুইসেলি মনোনীত হয়েছেন তার ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রথম বই ‘লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ’-এর জন্য। এটি একটি পরিবারের মেক্সিকো হয়ে আমেরিকায় যাওয়ার কাহিনী, যা নিয়ে দু’টি দেশের মধ্যে চলছে রাজনৈতিক টানাটানি। নতুন বা ডেব্যু লেখক হিসেবে তালিকায় আছেন নাইজেরিয়ানÑব্রিটিশ লেখক ওইংকান ব্রেইথওয়েইট এক নেতিবাচক কমিক থ্রিলার ‘মাই সিস্টার, দি সিরিয়াল কিলার’ নিয়ে। ৩১ বছর বয়সী ওইংকান এবারের তালিকায় সবচেয়ে কম বয়সী লেখক। এই বই এবারের ওমেন্স প্রাইজের জন্য শর্টলিস্টভুক্ত হয়েছিল। তালিকায় থাকা বইয়ের মধ্যে আরো আছে বার্নারডাইন ইভারিস্টোর ‘গার্ল, ওম্যান, আদার’, জন ল্যানচেস্টারের ‘দি ওয়াল’ ডেবোরাহ লেভির ‘দি ম্যান হু স এভরিথিং’ ভ্যালেরিয়া লুইসেলির ‘লস্ট চিলড্রেন’, জেনেট উইনটারসনের ফ্রাংকিসটেন ও ম্যাক্স পোর্টারের ‘অ্যানি’।
এ বছর ১৫১ বই থেকে ১৩টি বইয়ের লংলিস্ট করা হয়েছে। ফ্লোরেন্স ছাড়াও বিচারক প্যানেলে আরো আছেন সাবেক প্রকাশক ও সম্পাদক লিজ ক্যালডার, উপন্যাসিক জিয়ালু গুয়ো, লেখক আফুয়া হিলস এবং মিউজিশিয়ান জোয়ানা ম্যাকগ্রেগর। বুকার পুরস্কার ফাউন্ডেশনের লিটারারি ডিরেক্টর গ্যাবি উড সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, তারা তরুণদের কিছু উপন্যাসও বিবেচনা করেছেন যেগুলো প্রায়সই ‘বাণিজ্যিক বই’ হিসেবে তালিকার বাইরে রাখা হয়। এ কারণে এ বছরের তালিকায় কিছু বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যাবে, তার সমালোচনাও হওয়া স্বাভাবিক।
আগামী ৩ সেপ্টেম্বর এগুলোর মধ্য থেকে ছয়টি বইয়ের শর্টলিস্ট প্রকাশিত হবে। কারা সেই ভাগ্যবান সে দিনই জানা যাবে। আর পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে ১৪ অক্টোবর। সে পর্যন্ত অপেক্ষাতেই থাকতে হবে।