শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১১:০৭ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
বাবা যখন মেয়ে হত্যার বিচার চান না

বাবা যখন মেয়ে হত্যার বিচার চান না

ড. মাহবুব হাসান:

জামালউদ্দিন তার মেয়ে হত্যার বিচার চান না। টিভিতে যখন এই কথাগুলো খবর পাঠক উচ্চারণ করছিলেন, তখন তা শুনে আমার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। বলে কী! মেয়ের হত্যার বিচার চান না কেন জামালউদ্দিন?

প্রথমেই মনে পড়ল বিচারহীনতার কথা। রাজনৈতিক বক্তারা হামেশাই বলেন, এই সরকার বিচার বিভাগকেও দলীয়করণ করেছে। তাই ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চতা নেই। কিন্তু জামালউদ্দিন কেন তা মনে করবেন? তিনি তো আর রাজনীতি করেন না যে, ওই কথা বলবেন। তিনি ছাপোষা মানুষ। তার বিত্ত নেই। এ কারণেই তিনি বিচার চান না? মামলা চালাতে যে পরিমাণ টাকা লাগবে, তা তার নেই। হ্যাঁ, টাকা তো লাগেই। কোর্ট ফি থেকে শুরু করে আইনজীবীর ফি মেটাতে মেটাতে জামালউদ্দিনের মতো কর্মজীবীরা জীবন-সংসার শেষ (!) করে ফেলেন। তাই তিনি মামলা করবেন না।

জামালউদ্দিনের মেয়ে সামিয়া আফরান জামাল হত্যার শিকার হন গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহজাহানপুরে এক দুর্ধর্ষ ঘাতকের এলোপাতাড়ি গুলিতে। জাহিদুল ইসলাম টিপু নামের আওয়ামী লীগের মতিঝিল থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদককে হত্যার উদ্দেশ্যেই ঘাতক গুলি চালায়। ওই সময় সামিয়া রিকশায় বসেছিল। তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

জামালউদ্দিনের আর্থিক সঙ্গতি নেই বলেই হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করবেন না। আমরা যদি ধরে নিই তিনি মামলা করবেন, তা হলে মামলার ব্যয় তাকে বহন করতে হবেই। মামলার ফি আর উকিলের ফি ছাড়াও আরও শাখা-প্রশাখার বিষয় আছে- যেখানে টাকা ছাড়া কাজ হবে না, মামলা এগোবে না। এভাবে কত মামলা যে জমেছে আদালতগুলোয়, এর সঠিক হিসাব কি আমাদের হাতে আছে? এক-দুই সপ্তাহ আগে আদালতে মামলার জট সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পড়েছিলাম। ওই রিপোর্ট থেকে জেনেছি, ৩৮ হাজার মামলার চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়নি পুলিশ। বছরের পর বছর ধরে তারা তদন্ত রিপোর্ট জমা না দেওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ওই মামলাজট।

পুলিশ কেন তদন্ত রিপোর্ট দেয়নি বা দিচ্ছে না- এমন প্রশ্ন আমরা করতে পারি। জবাবে পুলিশের ঊর্ধ্বতনকর্তারা বলবেন, লোকবলের অভাব। কিন্তু আমরা তো দেখছি, কোনো রকম হত্যাকাণ্ড ঘটলেই পুলিশ উপস্থিত হয়ে সব রকম উপাত্ত ও মামলার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান (নমুনা) সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। দুর্ঘটনার সব রকম উপকরণ-উপাদান থাকার পরও তারা যথাসময়ে ও যথানিয়মে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন না আদালতে। ফলে যারা ওইসব মামলায় আসামি হিসেবে আটক হয়েছে, অনেকেই সন্দেহের কারণে আটক রয়েছে- তারা বছরের পর বছর জেলে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিচার না করেও যখন জেলে রাখা যায় সন্দেহভাজনকে, তখন মামলার তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার কথা চিন্তাও করে না পুলিশ। তা ছাড়া থানা বা জেলখানায় আটক আসামিদের দেখতে এলেই পুলিশকে কিছু দিতে হয়। সেটি বেআইনি হলেও কিছুই করার নেই। কারণ পুলিশ নিজেই আইনের অপব্যবহার করে, সেটি জনগণ কমবেশি জানে। বিবেচনা করলে পুলিশই এ দেশের প্রধান আইনভঙ্গকারীÑ যারা সন্দেহ করে নিরপরাধ লোকদের আটক করে। এর পর মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের অনেকেই ছেড়ে দেয়। সেগুলো কখনই পুলিশের ডায়েরিতে নথিভুক্ত হয় না। আবার নথিভুক্ত অনেক আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের (মামলা) তদন্ত সম্পন্ন করা হয় না। হলেও তা আদালতে জমা দেওয়া হয় না। আসলে ওইসব মামলার তদন্ত রিপোর্ট কেন্দ্র করে প্রতিদিনই পুলিশ কোটি কোটি টাকা আসামির পরিবারের পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়।

ট্রাফিক পুলিশের হাতেও অনেক নাজেহালের ঘটনা ঘটে প্রতিদিন। তা সবাই জানেন। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন উকিলর। এ এক বিশাল চক্র। এই চক্র আইনকে হাতিয়ার করে এ অবৈধ, অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজ করে চলেছে। কেন জামালউদ্দিন মেয়ে হত্যার বিচার চান না, তা কি বোঝা গেল? না, এখনো পুরোপুরিভাবে বোঝা যায়নি? যাবে না- যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি তুলে ধরা না হবে।

আমরা শুনে আসছি, বিচারের বাণী নাকি নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। কারণ যথাসময়ে বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় ন্যায়বিচার পায় না। আবার বিচারহীনতার জন্যও অনেকে কাঁদেন। বিচারহীনতা মানে আদালত ঠিকভাবে বিচার করতে পারছেন না- এমনটি নয়। আদালতে বিচার দীর্ঘসূত্রতা হলেও তা বিচারহীনতারই নামান্তর। একটি মামলার রায় দিতে যদি বছরের পর বছর লেগে যায়, তা হলে বিচারপ্রার্থী কি ওই মামলার ন্যায়বিচার পান? মামলা চালাতে বাদীর সহায়-সম্পদ ব্যয় করতে হয়। মামলার ফি, উকিলের ফি, অফিসের কেরানিকুলের দাবি মেনে নিয়ে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের ঘুষের বিষয়টি উহ্য রেখেই এটি বলা যায়- দেশে বিচারহীনতারই প্রবাহ চলছে। এই ধারা শুধরানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? না, পাচ্ছি না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে বিদ্যমান আইন সংস্কার জরুরি। কারণ আইনগুলো ন্যায়বিচারের জন্য এক ধরনের বাধা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের এ আইনগুলো জনস্বার্থ রক্ষার জন্য সৃষ্টি হয়নি। এ কারণেই আইন সংস্কার, নতুন আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। ন্যায়বিচার কায়েম করতে চাইলে সর্বত্রই এ সংস্কার করতে হবে। আর আদালতের ভাষ্য হচ্ছে, আমাদের লোকবল কম হওয়ায় সব মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না বা যায় না। এটিও সত্য। এর মানে নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ১৭ কোটি মানুষের দেশের জন্য নিম্ন আদালতে কত বিচারক লাগবে বা থাকা উচিত, সেটি কি বিচার বিভাগ ও আইন মন্ত্রণালয় হিসাব করেছে? শূন্যপদে লোক নিয়োগের কথা বললেই উত্তর আসে, সরকারের অর্থ সংকট আছে। তাই যোগ্য জনবল নিয়োগ করা যাচ্ছে না।

প্রতিবছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের নামি-বেনামি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অনেক আইনের ছাত্র বেরিয়ে চাকরি বাজারের সম্মুখে জমা হচ্ছে। কিন্তু তারা চাকরি পায় না, পাচ্ছে না। এভাবে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষিত যুবকরাও চাকরির বাজারে জমে উঠছে। গোটা দেশে লাখো উচ্চশিক্ষিত যুবক বেকার হয়ে দেশের জন্য ভারবাহী হচ্ছে। তাদের জন্য জব মার্কেটে জবের সুযোগ নেই বা সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে না। জব মার্কেট সম্প্রসারিত করা হচ্ছে না তেমনভাবে। অনেক নতুন নতুন সাবজেক্ট যেমন খোলা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তেমনি তারা কি জানেন জব মার্কেটে তাদের জন্য কত জব আছে বা জব ক্রিয়েট করা হচ্ছে? না, এ রকম তথ্য-উপাত্ত আমরা পাই না। সরকারি পরিকল্পনায় জব মার্কেটের তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। কেবল গালভরা বাণী তারা উদগিরণ করেন- আমরা এই করেছি, সেই করেছি। সরকারকে এই ধ্যান থেকে বেরিয়ে দেশের বেকার যুবকদের জন্য চাকরির বাজার বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষাকে জব মার্কেট উপযোগী করে তুলতে হবে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য সেক্টরওয়াইজ পরিকল্পনা করে এর বাস্তবায়ন করতে হবে।

এই করতে হবে, করা উচিত কথাগুলো বলা যতটা সহজ ও সরল, এ জন্য পরিকল্পনা করা এবং ওই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে যে পরিমাণ অর্থ ও বিনিয়োগ প্রয়োজন এবং সময় দরকার- সেটিও আমাদের ভাবতে হবে। সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরি ও প্রাযুক্তিক শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং সমাজের প্রয়োজন মনে রেখে চাকরির বাজারের কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই রকম পরামর্শ অবশ্য সরকারি দপ্তরের কাছে আছে। ওই পরামর্শ কাজে লাগবে তখনই- যখন প্রয়োজনকে বাস্তব করে তোলার পরিকল্পনা নেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায় বেশি। বেসরকারি ক্ষেত্রে জব মার্কেটের সম্প্রসারণে রূপরেখা প্রতিফলিত হতে দেখলেই বোঝা যাবে সরকারের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চেতনার রূপটি।

দুই.

মানুষের জীবন কাঠামো এমনই- একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোত। মানুষ বলে কান টানলে মাথা আসেই। এই সত্য বিবেচনায় রাখলে আমাদের সমালোচনা সরকারকে বিবেচনা করতে হবে আগামীর পরিকল্পনার একটি সহযোগ হিসেবে।

জামালউদ্দিনের মামলা না করার সিদ্ধান্তই আমাদের পৌঁছে দিয়েছে জব মার্কেটের প্রকৃত চেহারার খবর। যে পাঠ্যসূচি জীবনের সামাজিক অগ্রগতির জন্য তেমন একটি আর্নিং সোর্স হিসেবে গড়ে ওঠে না, ওই শিক্ষা প্রকৃত উপকারী শিক্ষা নয়। আমাদের একই সঙ্গে শিক্ষা দিতে হবে ন্যায় ও নৈতিকতারও। কারণ আজ আমাদের সমাজ থেকে ন্যায়বোধ, কল্যাণ চিন্তা ও নৈতিকতার ছায়াও যেন হারিয়ে গেছে। আমাদের সমাজ-সংসারে সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনৈকিতার রমরমা চলছে। অন্যায়কেই যেন আমরা বরণ করে নিয়ে চলছি। মহানগর ঢাকার সড়কের যানজট সৃষ্টির মূলে অনৈতিক ও অবৈধভাবে যানবাহনের চলাচল। ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং ধৈর্য ও ন্যায়কে সমুন্নত করে চলার বোধ যেন আমাদের গাড়িচালকরা হারিয়ে ফেলেছে। সরকার বেঁধে দেওয়া বাসভাড়া বাসের কন্ডাক্টর ও চালকরা কোনোভাবেই মেনে নিতে চায় না। অর্থাৎ মহানগরের কর্মজীবী ও সাধারণ মানুষ ওই অনৈতিক, অবৈধদের হাতে নাজেহাল হচ্ছে।

যে লোকটি টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধে জিড়িয়ে পড়েছে, সে কেন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের বাইরে এক ঘৃণ্য অপরাধের অন্ধকার পথে নেমেছে- এর সামাজিক কারণও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সমাজ থেকে অপরাধ ও অপরাধীদের এই পরিণামহীন জীবনের অবসান করতে হলে সরকারকে এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে। একজন অপরাধী আইনের চোখেই কেবল অপরাধী নয়, সমাজের চোখে সে এক ভয়ঙ্কর অপরাধী। সমাজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আমাদের অপরাধপ্রবণতার কারণও যে দায়ী, সেটি বুঝতে হবে। এর সমাধানের ভেতর দিয়েই কেবল হত্যার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। সব হত্যার পেছনেই থাকে কোনো না কোনো রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতের কারণ।

ড. মাহবুব হাসান : কবি ও সাংবাদিক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877