বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১০:২৯ পূর্বাহ্ন

পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা

পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা

মাসুম মুরাদাবাদী:

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, সেসময় বিশ্বের অনেক মানুষেরই এ কথা জানা ছিল যে, এমন একটি দেশের বিরুদ্ধে এ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলা হয়েছে, যারা অনেক আগেই পারমাণবিক অস্ত্র থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের মাথায় যে যুদ্ধোন্মোদনা চেপে বসেছে, তা তাকে কোথায় যে নিয়ে যাচ্ছে!

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ আক্রমণ বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। আর এতে সবচেয়ে বড় শঙ্কা হচ্ছে পারমাণবিক যুদ্ধের। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভও সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে এ যুদ্ধ পারমাণবিক ও ধ্বংসাত্মক হবে।’ আল্লাহ না করুন, যদি এ যুদ্ধ সেই পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে বিশ্ব কতটা বীভৎস রূপ নেবে, তার শুধুু কল্পনাই করা যেতে পারে। প্রকাশ থাকে যে, রুশ আগ্রাসনের মোকাবেলারত ইউক্রেন জাতিসঙ্ঘ ও রাশিয়ার তত্তাবধানে হওয়া একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী নিজেদের সম্পূর্ণরূপে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করে ফেলেছে অনেক আগেই। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মাঝে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে ইউক্রেন যে কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছিল, সে ব্যাপারে এখন বহু ইউক্রেনীয় নাগরিকের ধারণা, এটা তাদের দেশের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় ধরনের ভুল ছিল।

প্রেসিডেন্ট পুতিন যে সময় ইউক্রেনকে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন, সে সময় তার এ কথাও বেশ ভালো করেই জানা ছিল যে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার খোদ তার জন্যও ততটাই ধ্বংসাত্মক হবে, যতটা হবে ইউক্রেন ও অবশিষ্ট দুনিয়ার জন্য। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ আগ্রাসন ও ধ্বংসাত্মক অভিযান বর্তমানে গোটা বিশ্বকে মারাত্মক অস্থিরতায় ডুবিয়ে রেখেছে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে ইউরোপের দেশগুলোতে, যারা রুশ আগ্রাসনের মোকাবেলার জন্য ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে রুশ প্রেসিডেন্ট যখন তার পারমাণবিক বাহিনীকে ‘হাই অ্যালার্ট’-এ রাখার নির্দেশ দেন, তখন ওই সব লোকের পশম দাঁড়িয়ে যায়, যারা পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত। নিঃসন্দেহে পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্বের ধ্বংসযজ্ঞের সর্বশেষ অস্ত্র, যার প্রতিক্রিয়া আজও জাপানের দুইটি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দেখা যায়।

বর্তমানে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান পুতিনের ‘সামরিক অভিযান’-এর প্রভাব ভারতের ওপরও পড়েছে। ইউক্রেনে এক ভারতীয় ছাত্রের মৃত্যু সেখানে অধ্যয়নরত কয়েক হাজার ভারতীয় ছাত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ ইউক্রেন আগেই এ শঙ্কার কথা বিশ্ববাসীকে অবহিত করেছিল এবং বহু দেশ তাদের নাগরিকদের ইউক্রেন থেকে ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকার যেহেতু বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তাই ইউক্রেনে আটকে পড়া নিজেদের তরুণদের চেয়ে এই ভোটের চিন্তা বেশি ছিল, যা তার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ আগ্রাসনের ফলে বহু সাধারণ নাগরিক মারা গেছে। এর মধ্যে প্রচুর অল্পবয়সী শিশুও রয়েছে। ইউক্রেনের অসংখ্য সেনা রুশ আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। শহরগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞের মর্মন্তুদ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে মিসাইল হামলা ও ভারী বোমাবর্ষণের ফলে মারাত্মক ধ্বংস সাধিত হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট রুশ আগ্রাসনকে প্রকাশ্য সন্ত্রাস বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘পুতিন আমাদের দেশের স্থিতিশীলতা তছনছ করে দিতে চাচ্ছেন। এ জন্য রাজধানী ক্রমেই হুমকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।’ ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও প্রায় ১৫ লাখ জনসংখ্যার শহর খারকিভ থেকে প্রাপ্ত ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, আবাসিক এলাকাগুলোতে বোমাবর্ষণ হচ্ছে। ভারী বর্ষণে ভবনগুলো একের পর এক কেঁপে উঠছে। আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছে। ঘরবাড়ি, স্কুল ও হাসপাতালগুলোতে বোমাবর্ষণের হৃদয় মোচড়ানো ছবিগুলো প্রকাশ্যে আসা সত্তে¡ও রুশ বাহিনী আবাসিক এলাকাগুলোতে হামলার কথা অস্বীকার করেছে। রাশিয়া এটা বারবার অস্বীকার করছে যে, তারা ইউক্রেনের নিরপরাধ নাগরিককে লক্ষ্যবস্তু বানায়নি। কিন্তু ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর থেকে প্রাপ্ত বহু মর্মন্তুদ ছবি এই দাবি উড়িয়ে দিচ্ছে। রুশ আগ্রাসনের ফলে লাখ লাখ ইউক্রেনীয় অধিবাসী দেশ ছেড়েছে। শরণার্থীবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের এজেন্সিপ্রধান এই পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যদি রাশিয়ার সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকে, তাহলে ইউক্রেনে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানো নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। উল্লেখ্য, ইউক্রেনে এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে, যাদের জন্য পানিটাও সহজলভ্য নয়। কেননা বোমাবর্ষণে পানি সরবরাহের লাইন, বিদ্যুৎ সরবরাহসহ মৌলিক সেবাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ছয় লক্ষাধিক মানুষ ইউক্রেন থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে গেছে। এদের মধ্যে অর্ধেকই গেছে পোল্যান্ডে। সীমান্তের ওপারে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। কিছু মানুষ কয়েক দিন ধরে এই সীমান্ত পার হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটা এমন এক মানবিক বিপর্যয়, যার সম্পর্কে আক্রমণকারী অজ্ঞাত নয়।

জাতিসঙ্ঘের তাৎক্ষণিক বৈঠকে উভয়পক্ষকে দ্রুত যুদ্ধবিরতি ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করার আবেদন করা হয়। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বলেন, রুশ পারমাণবিক বাহিনীকে ‘হাই অ্যালার্ট’-এ রাখা লোমহর্ষক বিষয়। প্রকাশ থাকে যে, উচ্চপদস্থ সেনাকর্মাকর্তাদের সাথে মিটিংয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও মিলিটারি স্টাফের প্রধানকে পারমাণবিক বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখতে নির্দেশ দেন। টিভিতে প্রচারিত বক্তব্যে পুতিন বলেন, ‘পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, শুধু তাই নয়, বরং ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশগুলোর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাও আমাদের দেশ সম্পর্কে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছেন।’

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ ওই কঠিন নিষেধাজ্ঞার পরই দিয়েছেন, যার ফলে রুশ অর্থনৈতিক অবরোধের মুখোমুখি হয়েছে এবং পশ্চিমে একেবারে একা হয়ে গেছে। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্রও এ বিষয়টিতে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনকে পরাজিত করতে নিষিদ্ধ রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইউক্রেনের ঘটনাবলির ওপর নজর রাখছে। যদি পুতিন ও তার সরকারকে যুদ্ধাপরাধে যুক্ত পাওয়া যায়, তাহলে তাদের মারাত্মক ফল ভোগ করতে হবে। অথচ এ কথা সবাই জানেন যে, পারমাণবিক হামলা শিশুদের খেলনা নয়। কিন্তু আমেরিকা, পশ্চিমা দেশসমূহ ও ন্যাটোর হুমকির পর রাশিয়া যেভাবে আগ্রাসী মনোভাব অবলম্বন করেছে, তাতে শঙ্কা আরো বেড়ে গেছে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত তো এমনটাই মনে হচ্ছিল যে, যদি যুদ্ধ বেধেই যায়, তাহলে বেশি দিন চলবে না। কিন্তু রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুতগতিতে নাজুক হচ্ছে, তাতে সামনে কী হবে তা অনুমান করা সহজ নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ভয়ঙ্কর ফল বিশ্ব আগেই ভোগ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা জাপানের দু’টি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে এর আবশ্যিক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। ওই ধ্বংসযজ্ঞের মর্মন্তুদ স্মৃতি আজো লোম খাড়া করে দেয়। এটা প্রথম পারমাণবিক অভিজ্ঞতা ছিল, যার দ্বারা পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠেছিল। বিগত ৭৫ বছরে বিশ্বের কয়েকটি দেশ যে ধরনের মারাত্মক পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়েছে, তার দ্বারা যে ধ্বংসযজ্ঞ হতে পারে, তাও কল্পনা করা অসম্ভব। বর্তমানে শুধু এক রাশিয়ার কাছেই রয়েছে প্রায় ছয় হাজার পারমাণবিক অস্ত্র। আমেরিকার কাছে রয়েছে তার থেকে কিছুটা কম। চীন তার কাছে ৩৫০ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে দাবি করে। ফ্রান্স, ব্রিটেন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতেও পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তির প্রকাশও কম ভয়ঙ্কর নয়। বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, যার কাছে যত বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, সে নিজেকে ততটাই নিরাপদ মনে করছে। কিন্তু এটা নিছক খামখেয়ালিপনা। কেননা পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্বের জন্য পরিপূর্ণ ধ্বংসের অস্ত্র।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ৬ মার্চ, ২০২২ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877