স্বদেশ ডেস্ক:
জনপ্রশাসনে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি কার্যক্রম শুরু হলেই ছড়াছড়ি দেখা যায় আধা-সরকারিপত্রের (ডিও)। পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে জনপ্রশাসন সচিব ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কাছে একের পর এক ডিও লেটার আসতে থাকে মন্ত্রী, এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে। ডিও লেটারের এই ছড়াছড়ি মূলত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিবের পদোন্নতি নিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ ‘কর্মব্যস্ত’ দপ্তরে পদায়ন পেতেও কর্মকর্তারা ডিও লেটারের পেছনে ছুটছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর-অধিদপ্তরে পদায়ন পেতে ডিও লেটার যেন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ডিওর চাপে জনপ্রশাসনের ঊর্ধ্বতনরা অনেকটাই বিরক্ত। প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রীতির কারণে প্রশাসনের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এই রীতি থেকে বের হতেই হবে। কারণ এটি সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগে এমপি-মন্ত্রী কিংবা সচিবের কাছে ডিও লেটারের জন্য ধর্ণা দিলে সেটি স্পষ্টই বিধিমালার লঙ্ঘন। কারণ তারা নিজেদের পদোন্নতি, পদায়ন কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাউকে দিয়ে সুপারিশ করাতে পারেন না। যদি কেউ নিজের স্বার্থে ডিও লেটার নেন, তা হলে সেটি যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ ডিও লেটার নিয়ে পদোন্নতির ঘটনা প্রশাসনের ভাবমূতি নষ্ট করছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। তবে কোনো মন্ত্রী-সচিব যদি কোনো দপ্তরের স্বার্থে কোনো দক্ষ কর্মকর্তাকে নিতে চান, সেটি দূষণীয় নয়।
জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি সম্প্রতি সচিবরাও তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য ডিও লেটার দিচ্ছেন, এটিকে কীভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটি কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘ডিও লেটারের রীতি প্রশাসনের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এটি বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে। নির্দেশনায় বলা থাকবে, কেউ ডিও লেটার আনলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিও লেটারের রীতি চলতে থাকলে যেসব কর্মকর্তা ডিও লেটার সংগ্রহ করতে পারবেন না, তারা কি পদোন্নতি পাবেন না?’
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ মাসেই দেওয়া হতে পারে অতিরিক্ত সচিব পদের পদোন্নতি। এর পর আসবে যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতি। এসব পদোন্নতি ঘিরে জনপ্রশাসনে ডিও লেটারের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। তবে সব ডিও লেটার আমলে নেন না পদোন্নতি সংশ্লিষ্টরা।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ভাষ্য, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী ডিও নেওয়া নিষিদ্ধ। তবু অনেকে ডিও নেন, তদবির করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সব যোগ্যতা সাপেক্ষেই পদোন্নতি ও পদায়ন হয়। জনপ্রশান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজমের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
কয়েকটি ডিও লেটার
বেশ কয়েকটি ডিও লেটারের অনুলিপি দৈনিক আমাদের সময়ের হাতে পৌঁছেছে। বিসিএস টেলিযোগাযোগ ক্যাডারের ১৩ ব্যাচের (৭৭৭৪) মুহাম্মদ আবদুল হান্নানকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিতে জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিবকে ডিও দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ডিওতে তিনি লিখেছেনÑ হান্নান বর্তমানে আইএমইডিয়ে মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত। তিনি এর আগে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অতিরিক্ত সচিব হলে জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন বলে বিশ^াস করি। এমতাবস্থায় মুহাম্মদ আবদুল হান্নানকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির বিষয়টি সদয় বিবেচনার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।’
সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের মুহাম্মদ এনাম চৌধুরীকে (৬৬৩৫) যুগ্মসচিব পদোন্নতি দিতে জনপ্রশাসন সচিবকে ডিও দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছেÑ বর্তমানে সঞ্চয় অধিদপ্তরে পরিচালক (প্রশাসন) পদে কর্মরত এনাম সৎ, দক্ষ, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী কর্মকর্তা। তিনি পদোন্নতি পেলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। উপসচিব এনাম ডিও লেটারের পাশাপাশি নিজেও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব বরাবর আবেদনও করেছেন। পদোন্নতি না পেয়ে মানসিক কষ্ট ও সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নওগাঁ-৪ আসনের সাংসদ মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের যুগ্মসচিব দেওয়ান মো. আব্দুস সামাদের (৬১১৮) জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে ডিও লেটার দিয়েছেন। সামাদকে দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা উল্লেখ করে এমপি ইমাজ লিখেছেনÑ ‘তিনি (সামাদ) একজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ^াসী কর্মকর্তা। তাকে অতিরিক্ত সচিব করা হলে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন বলে আমি দৃঢভাবে বিশ^াস করি।’
বিসিএস কৃষি ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের উপসচিব ড. বিলকিস বেগমকে (৭৯২০) যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিতে জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিবকে অনুরোধ জানিয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি লিখেছেনÑ ‘ড. বিলকিস যুগ্মসচিব পদের যোগ্যতা অর্জন করেছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও জানি। বর্তমানে তিনি পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ ঢাকা মহানগর শাখার মহিলাবিষয়ক সম্পাদক।’
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (যুগ্মসচিব) মো. আলিম উদ্দিনকে অতিরিক্ত সচিব করতে চিঠি দিয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কবির বিন আনোয়ার।
পদোন্নতি পেতে আবেদন
পূর্বে পদোন্নতিবঞ্চিত কয়েক কর্মকর্তা পদোন্নতি পেতে জনপ্রশাসন সচিবকে তাদের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন দিয়েছেন। ১৩তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা যুগ্মসচিব পদোন্নতি চেয়ে আবেদনে লিখেছেনÑ ‘গত ২৯ অক্টোবর ২০তম ব্যাচ থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ফলে আমি মানসিক, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছি।’
আরেক কর্মকর্তা তার বিষয়ে পুনরায় গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরির আবেদন করেছেন। জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিবকে লেখা আবেদনে তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে এখন পর্যন্ত কখনো কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনে জড়িত ছিলাম না। আমি ও আমার পরিবার সর্বদা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করি। পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে ধারণা করছি, কোনো সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত গোপনীয় প্রতিবেদনে আমাকে নিয়ে অসত্য মন্তব্য থাকতে পারে।’ এমতাবস্থায় গোপন প্রতিবেদন পুনরায় আনতে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
কর্মব্যস্ত দপ্তরে যেতেও ডিও
কর্মকর্তারা জানান, অনেকে পদোন্নতি পাওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ কর্মব্যস্ত দপ্তরে পদায়ন নিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তাদের কেউ কেউ ডিও লেটারের পেছনেই দৌড়াচ্ছেন। আবার কেউ কেউ প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের মৌখিক তদবিরে পদায়ন নিচ্ছেন কিংবা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তদবির কিংবা ডিও লেটারের অভাবে অনেকে ভালো দপ্তরে পদায়ন পাচ্ছেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।