স্বেদেশ ডেস্ক:
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ১০ দিন পার হয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনবাস অঞ্চলের রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সহায়তা ও নিরাপত্তার অজুহাতে দেশটিতে রুশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণের নির্দেশ দেন পুতিন।
জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুসারে, যুদ্ধের ফলে ১২ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
যুদ্ধে মোট কত লোক হতাহত হয়েছে তাও এখনো স্পষ্ট নয়।
যুদ্ধ শুরুর সাতদিন পর গত ২ মার্চ ইউক্রেনের জরুরি সেবা সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, রুশ আগ্রাসনে দেশটিতে দুই হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
তবে এই সংখ্যাটি ‘অনুমান করে নেয়া’ বলে জানায় সংস্থাটি।
অপরদিকে ৪ মার্চ জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার দফতর এক বিবৃতিতে জানায়, ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত সাতদিনে ইউক্রেনে তিন শ’ ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। অপরদিকে আহত হয়েছেন ছয় শ’ ৭৫ জন।
৩ মার্চ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এক টেলিভিশন ভাষণে দাবি করেন, যুদ্ধে রাশিয়ার নয় হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হয়েছে।
তবে যুদ্ধে কত ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত হয়েছে, তা জানাননি তিনি।
অপরদিকে ২ মার্চ রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যুদ্ধে রাশিয়ার চার শ’ ৯৮ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। বিপরীতে ইউক্রেনের নিহত হয়েছে দুই হাজার আট শ’ ৭০ সৈন্য।
যুদ্ধের শুরুতেই ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ দখল করেছিলো রুশ বাহিনী। কিন্তু ২৭ তারিখ ভোরে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহরটি রুশ সৈন্যরা দখল করলেও সন্ধ্যার আগেই সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয় ইউক্রেনীয় বাহিনী।
পরে ২ মার্চ দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন শহর দখলে নেয় রুশ সৈন্যরা। বর্তমানে রাশিয়ার দখলে থাকা এটিই ইউক্রেনের একমাত্র শহর।
এদিকে কিয়েভ, খারকিভ লক্ষ্য করে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলছে। কিয়েভের দিকে এগিয়ে আসা বিশাল একটি রুশ সাঁজোয়া যানের বহর পথে থেমে রয়েছে।
এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর নগরী মারিওপোল অবরুদ্ধ করে রেখেছে রুশ সৈন্যরা। তারা আরেকটি বন্দর নগরী ওডেসার দিকে এগোচ্ছে। রাশিয়া এই দুইটি শহর দখল করতে পারলে ইউক্রেন সমুদ্র যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
শুক্রবার কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষের পর জাপোরিজা পরমাণু জ্বালানি কেন্দ্র দখলে নেয় রুশ সৈন্যরা। এর আগে রুশ হামলায় এই জ্বালানি কেন্দ্রে আগুন লেগে যায়। তবে পরে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় দমকল কর্মীরা।
ইউক্রেনের বৃহত্তম এই পরমাণু জ্বালানি কেন্দ্রে এমন হামলা সারাবিশ্বেই ভয়াবহ এক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারতো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
অপরদিকে ইউক্রেনের পরিত্যক্ত চেরনোবিল পরমাণু জ্বালানি কেন্দ্রও দখলে নিয়েছে রাশিয়া। ১৯৮৬ সালে এই জ্বালানি কেন্দ্রেই ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটেছিলো।
যুদ্ধের পর থেকেই রাশিয়ার বাণিজ্য, সম্পদ, বিমান ও বিভিন্ন ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।
এর ফলে দেশটির বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ভ্রমণ বাধার মুখে পড়েছে।
এদিকে রাশিয়ায় ‘যুদ্ধের খবর’ সেন্সর করে নতুন এক আইন চালু করার জেরে দেশটিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। একইসাথে বিবিসি, ডয়চে ভেলেসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচার রাশিয়ায় নিষিদ্ধ হয়েছে।
একইসাথে দেশটিতে ফেসবুক নিষিদ্ধ ও টুইটারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরেই অব্যাহতভাবে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ওভিডি-ইনফোর তথ্য অনুসারে পুলিশ শুক্রবার পর্যন্ত রাশিয়ায় আট হাজার দুই শ’ ৩৯ বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে।
যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দুই দফা শান্তি আলোচনা হয়েছে। শান্তি আলোচনায় দুইপক্ষই ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। তবে সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষিত জায়গায় পাঠাতে ‘মানবিক করিডর’ তৈরিতে রাজি হয়েছে দুই দেশ।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিদ্রোহী ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এর জেরে ২১ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহীদের দুই রাষ্ট্র ‘দোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক’ ও ‘লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক’কে স্বীকৃতি দিয়ে শান্তি রক্ষায় ওই অঞ্চলে সৈন্য পাঠায় রাশিয়া।
পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সহায়তার লক্ষ্যে রুশ স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীকে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার অভিযানের নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশপন্থী সরকারের পতনের পর রাশিয়া দেশটিতে আগ্রাসন চালিয়ে ক্রিমিয়া অঞ্চলটি দখল করে নেয়। পাশাপাশি মস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব ইউক্রেনে বিপুল অঞ্চল দখল করে নেয় বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
পূর্ব ইউক্রেনে রুশপন্থী বিদ্রোহীরা দুই রাষ্ট্র ‘দোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক’ ও ‘লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে এই সংঘর্ষ বন্ধে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় ২০১৪ সালে বেলারুশের মিনস্কে ইউক্রেন ও রাশিয়া এক চুক্তি করে।
মিনস্ক চুক্তি অনুযায়ী এই অঞ্চলে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি, বন্দি বিনিময় ও দোনবাস অঞ্চল থেকে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সরে যাওয়ার বিষয় যুক্ত ছিলো। দোনবাস অঞ্চল থেকে রুশপন্থী বিদ্রোহীরা সরে গেলে ইউক্রেনের ওই অঞ্চলে গণভোটের ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু পরস্পরের প্রতি সহিংসতার অভিযোগের জেরে এই চুক্তি আর বাস্তবায়িত হয়নি।
এরই মধ্যে ২০২০ সালে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ন্যাটো সামরিক জোটের ‘ইনহ্যান্সড অপারচুনিটি পার্টনার’ পদ পেলে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয়। নিজ দেশের সীমান্তে ন্যাটোর সম্প্রসারণের শঙ্কায় রাশিয়া ইউক্রেনের যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক জোটে যোগ দেয়ার বিরোধিতা করে আসছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য সমাবেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের পর উত্তেজনা নতুন করে বাড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় এক লাখ সৈন্য ইউক্রেন সীমান্তে মোতায়েন করেছে মস্কো।
যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, ইউক্রেনে হামলার জন্যই রাশিয়া ওই সৈন্য সমাবেশ করেছে। কিন্তু রাশিয়া ওই সময় এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, সামরিক বাহিনীর মহড়ার অংশ হিসেবে ওই সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি, আলজাজিরা