স্বদেশ ডেস্ক: বাংলাদেশে ডায়াবেটিস, থায়রয়েড সমস্যা, দৈহিক স্থূলতা, পিসিওএস, প্রজনন সমস্যা, বৃদ্ধিজনিত সমস্যা ইত্যাদি হরমোন ও মেটাবলিক রোগের কোটি কোটি রোগী রয়েছে। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক রোগীর বিশেষজ্ঞ সেবাদানের জন্য নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক। বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির তথ্য মতে, দেশে মাত্র ১৭৯ জন হরমোন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। অন্যদিকে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। অর্থাৎ ৫৫ হাজার ৮৬৫ জন রোগীর বিপরীতে চিকিৎসক মাত্র একজন। এই স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দেওয়া এক প্রকার অসম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে পরিপূর্ণ কাঠামো তৈরি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এ জন্য বিপুল অর্থসম্পদ প্রয়োজন। তারা বলছেন, দেশে ১৭৯ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। ফলে ডায়াবেটিস/ থায়রয়েডজনিত রোগের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন সদ্য পাস করা জুনিয়র চিকিৎসক ও জেনারেল ‘প্র্যাক্টিশনার’। এতে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশে আজ পালিত হচ্ছে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগী। কিন্তু অত্যন্ত স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসক এবং সঙ্কুুচিত সেবাব্যবস্থা সুচিকিৎসার প্রধান অন্তরায়। সারাদেশে ডায়াবেটিক সমিতির হাসপাতাল থাকলেও বারডেম হাসপাতালের মতো সুযোগ-সুবিধা কোথাও নেই। এমনকি সরকারি পর্যায়ের সব মেডিক্যাল কলেজেও ‘এন্ডোক্রাইনোলজি’ বা হরমোন বিভাগ নেই। ফলে সারাদেশের রোগীদের ডায়াবেটিস চিকিৎসা পেতে ঢাকায় আসতে হয়। এখানে এসেও মাসের পর মাস অপেক্ষা করে পাওয়া যায় না কাক্সিক্ষত চিকিৎসকের পরামর্শ। এভাবেই সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শের অভাবে ধীরে ধীরে ডায়াবেটিস রোগীরা
জটিল নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বিশ্বে ৪২২ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ছিলেন। আক্রান্তদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শুধু ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যুহার বেড়েছে ৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ডায়াবেটিসের কারণে ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
শাম্মি আখতার নামের এক ডায়াবেটিস রোগী আমাদের সময়কে বলেন, তার ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর চিকিৎসকের সিরিয়াল পেতেই দুই সপ্তাহ সময় লেগেছে। অথচ এই সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারায় নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। আরেক রোগী নাদিরা জেসমিন জানান, প্রধান সমস্যা হলো, এর ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষদের ইনসুলিন নিতে বেশ বেগ পেতে হয়। আবার ইনসুলিন না নিলে ন্যূনতম স্বাভাবিক জাীবনযাপন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ইনসুলিনের দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিসের এই ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধে ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির জটিলতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার (যেমন-স্ট্রোক, হৃদরোগ, অন্ধত্ব, কিডনি সমস্যা) করতে, এমনকি পরবর্তী বংশধরদের ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রতিহত করতে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) মতে, ২০১৭ সালে সারাবিশ্বে ৪২ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত ছিল। কিন্তু ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৭০ কোটিতে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ৮০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ধারণা করা হয়, ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে এক কোটি ৫০ লাখ। আইডিএফ-এর সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশের শতকরা ৭ থেকে ৮ ভাগ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে দেশের বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এক লাখ মানুষের (ডায়াবেটিস আছে কিনা যারা জানেন না) স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। সেখানে ২৫ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাস্তবে বাংলাদেশের চিত্র ভয়াবহ। জন্মগত কিংবা বংশগত কারণ যাই থাকুক জীবনযাত্রার পরিবর্তন এই ভয়াবহতার অন্যতম কারণ। যে দ্রুতগতিতে এই রোগ বাড়ছে, তাতে পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। বেশিরভাগ প্রভাব পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলোতে।
ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস ও সমিতির ৬৬তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সমিতির অন্যান্য অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত অধিভুক্ত সমিতিগুলোও এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- বারডেমের কার পার্কিংয়ের নিচ থেকে টেনিস ক্লাবের ফটক পর্যন্ত সেøাগানসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান; বারডেম মিলনায়তনে আলোচনাসভা; বারডেম ক্যাম্পাস, এনএইচএন ও বিআইএইচএস-এর বিভিন্ন কেন্দ্রসংলগ্ন স্থানে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে হার্ট ক্যাম্প।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম আমাদের সময়কে বলেন, সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০ রোগীর মধ্যে ৬১ দশমিক ৩ জনই জানে না যে, তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে। অথচ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা খুবই জরুরি। তাই দেশের সব মানুষের ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা দরকার। কারণ পরীক্ষা না হলে তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, দেশে এ সংক্রান্ত চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। তাই আজ বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে এন্ডোক্রাইন সোসাইটি একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে। যেই চুক্তির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসককে বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে, যাতে দেশের মানুষের চিকিৎসাসংক্রান্ত জটিলতা না থাকে।
প্রসঙ্গত, ইনসুলিন নামের এক প্রকার হরমোনের অভাব হলে কিংবা উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে গেলে রক্তের গ্লুকোজ শরীরের বিভিন্ন কোষে প্রয়োজনমতো ঢুকতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতিকেই ডায়াবেটিস বলে। ডায়াবেটিস রোগটি একবার হলে সারাজীবন থাকে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অন্ধত্ব, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোক ও পঙ্গুত্বের মতো কঠিন রোগের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।