বদরুদ্দীন উমর: বেশ কিছুদিন থেকেই কয়েকজন মাদ্রাসা অধ্যক্ষের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। এর থেকে উদ্বেগজনক বিষয় আর কী হতে পারে?
রাফি নামে এক মাদ্রাসাছাত্রীকে অধ্যক্ষ ধর্ষণের চেষ্টা করার পর তাকে পুড়িয়ে হত্যা করার লোমহর্ষক বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, এই অধ্যক্ষ শুধু ধর্ষকই নয়, হত্যাকারীও বটে। এ হত্যাকা-ের জন্য সে ওই মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে ব্যবহার করেছিল। অর্থাৎ নিজে এই অপকর্ম অন্য ছাত্রছাত্রীদের থেকে আড়াল করার পরিবর্তে সে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে নিজের অপরাধের শরিক হিসেবে নিযুক্ত করেছিল। এতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি পরে ধরা পড়ার পর সেই অধ্যক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক ছাত্রছাত্রী এখন জেলে আছে এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা করা হয়েছে।
কিন্তু শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষদের এ ধরনের অপরাধমূলক কাজের রিপোর্ট প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায় এর থেকে বোঝা যায় যে, কতিপয় মাদ্রাসার শিক্ষক, বিশেষত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছাত্রী ধর্ষণ ও হত্যাকা-ে এখন লিপ্ত হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা দেশে ১০ বছর আগে চিন্তা করাও যেত না।
সম্প্রতি জুলাই ঢাকার দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারে কয়েকজন মাদ্রাসা অধ্যক্ষ ও মাদ্রাসার শিক্ষকের ধর্ষণ ও হত্যার ওপর এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চুয়াডাঙ্গা পুলিশ এখানে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ ও একজন মাদ্রাসার শিক্ষককে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে গ্রেফতারের পর তাদেরকে রিমান্ডে নেয়ার জন্য আদালতের অনুমতি চেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা চুয়াডাঙ্গা মাদ্রাসার একজন সেকেন্ড গ্রেড ক্লাসের ছাত্র আবীর হোসেনকে হত্যা করেছে। অধ্যক্ষ আবু হানিফ ও অ্যাসিস্ট্যান্ট শিক্ষক তামিম হোসেন অন্য তিনজন শিক্ষককে হত্যার জন্য অভিযুক্ত করে, তাদেরকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
মাদ্রাসার সন্নিকটে একটি ইটের ভাটা থেকে আবীর হোসেনের লাশ খ-িত অবস্থায় পাওয়া যায়। তিনজন শিক্ষককে ছেড়ে দিয়ে পুলিশ চুয়াডাঙ্গার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অধ্যক্ষ আবু হানিফ ও তামিম হোসেনকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেন। চুয়াডাঙ্গার এসপি সংবাদপত্রকে বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, হত্যার আগে ছাত্রটির ওপর যৌন নির্যাতন করা হয় তাহলে শুধু ছাত্রী নয়, মাদ্রাসার ছাত্ররাও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের যৌন আক্রমণ ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সমাজে এর থেকে ভয়াবহ ব্যাপার আর কী হতে পারে?
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে আগত আবীর হোসেন ছয় মাস আগে চুয়াডাঙ্গা মাদ্রাসায় নুরানি (সেকেন্ড গ্রেড) ক্লাসে ভর্তি হয়। গত ২৩ জুলাই রাতে আবীর তার ছাত্রাবাস থেকে নিখোঁজ হয় এবং স্থানীয় লোকজন পরদিন তার লাশ খুঁজে পান। কিন্তু এ দিনের পত্রিকায় শুধু এই ঘটনার রিপোর্টটিই নয়, অন্য রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। ৬০ বছর বয়স্ক এক লোক গত ২৬ জুলাই একটি ছয় বছরের মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। সে মেয়েটিক তার বাড়িতে কোনোরকম প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায় এবং পরে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ ঘটনা ঘটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বাগমারা পাড়ায় দুপুরের দিকে। শফিকুল ইসলাম নামে এই ধর্ষক ওই এলাকারই বাসিন্দা।
মেয়েটি কোনোমতে তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পালিয়ে আসে এবং তার মাকে এ ঘটনার কথা জানায়। পরে তার মা এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর পুলিশ স্টেশনে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আহত মেয়েটিকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর থেকেই বোঝা যায়, দেশে আজ কোনো মানুষই নিরাপদ নয়। শুধু মেয়ে নয়, ছেলেরাও ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শুধু মাদ্রাসার শিক্ষক নয়, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ধর্ষকদের সমান উপস্থিতি আছে। অর্থাৎ মাদ্রাসার শিক্ষকদের ধর্ষণকা- কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়।
সমগ্র সমাজে আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, ধর্ষণ এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে দৈনন্দিন ও নিয়মিত ব্যাপার। এখানে বলা দরকার, এ ধরনের সব ঘটনা যে পুলিশে রিপোর্ট হচ্ছে এবং এর বিবরণ যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে এমন নয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব নয়। কাজেই যেসব ঘটনার রিপোর্ট বের হয়, সম্ভবত তার থেকে বেশিসংখ্যক এ ধরনের ঘটনা দেশজুড়েই আজ ঘটছে। বিগত ৮-১০ বছরে বাংলাদেশে ধর্ষণ, খুনসহ নানা রকম অপরাধ এত বড় আকারে ঘটেছে এবং তা এত বিস্তৃত হচ্ছে, যা কারও অজানা নেই। প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায় এ ধরনের ঘটনার রিপোর্ট থাকে। আসলে বাংলাদেশের সমাজে অপরাধীকরণ বা ক্রিমিনালাইজেশন এখন ব্যাপকভাবে হয়েছে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে অপরাধীরা সক্রিয় নয়।
বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথম থেকেই এখানে ব্যবসায়ী-বুর্জোয়া, নতুন লুটপাটকারী ধনিকদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। তখন থেকে সমাজে নতুন নতুন অপরাধের জগৎ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ী শ্রেণির শাসনে এটিই নিয়ম। বিশ্বের যে দেশেই ব্যবসায়ী শ্রেণির শাষণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখন অথবা ইতিহাসের বিভিন্ন পযায়ে, সেখানেই অপরাধের জগৎ এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতির এ দিকটির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে এখন অপরাধের জগৎ কত বিস্তৃত হয়েছে, অপরাধের ধরন কত বিচিত্র হয়েছে এবং এসবের কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা আজ যেভাবে নিজেদের ছাত্রছাত্রীদের ওপর যৌন নির্যাতন করছে, যেভাবে তাদেরকে এ কারণে হত্যা পর্যন্ত করছে, তার স্বরূপ বোঝা যাবে না, যদি না আমরা এসব ঘটনাকে বৃহত্তর সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করি। দেশে সুশাসন বলে কিছু নেই এবং বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সমাজ ও অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে যে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রও এ দিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়। কারণ শিক্ষা ক্ষেত্র সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।
স্কুল-কলেজের ও মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকা থেকে নিয়ে শিক্ষকদের দুর্নীতির আজ যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এর মধ্যেই দেখা পাওয়া যায় সমাজে বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্য কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং উচ্চপর্যায়ে উঠেছে, তা সমাজের বিদ্যমান পরিস্থিতির অবনতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু এ কথা আবার বলতে হয় যে, এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়।
শাসক শ্রেণির লোকজন এবং তাদের সরকার দেশের উন্নয়ন নিয়ে অনেক ঢাকঢোল পেটায়। দেশের অর্থনীতির যত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এর হিসাব দিতে তারা ব্যস্ত। কিন্তু বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে যে, এই ‘উন্নয়ন’ যত হচ্ছে, সমাজে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তত বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের যত কথাই বলা হোক, তার সঙ্গে দেশের বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয়ের সীমা নেই। কাজেই কিভাবে দেশে এ ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে এবং এ ‘উন্নয়নের’ প্রভাবে দেশে বর্তমান পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে, এটা ভেবে দেখার বিষয়।
যেভাবে এই ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে তার সঙ্গে সমাজের ভাঙন এবং নৈতিক অবক্ষয় যে সম্পর্কিত, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কাজেই ‘উন্নয়ন’ যত বেশি হচ্ছে, ততই দেশের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।
এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, ‘উন্নয়ন’ যেভাবে হচ্ছে, যে পদ্ধতিতে হচ্ছে তার মধ্যেই সমাজের বিশৃঙ্খলা ও নৈতিক অবক্ষয়ের শর্ত বিরাজ করছে। উন্নয়নের অর্থ শাসক শ্রেণি ও সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু লোকের হাতে দেশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া। ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং গরিব আরও গরিব হচ্ছে। মধ্য শ্রেণির অবস্থাও এ দিক দিয়ে খারাপ। তাদের প্রকৃত আয় ক্রমশ কমে আসছে, সেই সঙ্গে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অপ্রতিহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যে ভেজালের অবস্থার ওপর সংবাদপত্রে নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। সমগ্র অর্থনীতি দেশের বাজারকে কালোবাজারে পরিণত করছে। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো লুটপাট করছে, ব্যাংকাররা চুরি-দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে সংকট সৃষ্টি করে নিজেদের পকেট ভর্তি করছে। এ সবই হলো বাংলাদেশের ‘উন্নয়নের’ পরিণাম। এর সঙ্গে জনস্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই।
মাদ্রাসার কিছু শিক্ষক ও অধ্যক্ষ আজ যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর যৌন নির্যাতন করছে, যেভাবে নৈতিক অবক্ষয় তাদের ঘিরে রেখেছে, এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় আকারে দুর্নীতিও করছে, যদিও এর ওপর তেমন কোনো রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না।
কিন্তু তাদের যৌন নির্যাতন যে তাদের অন্যান্য অনৈতিক কাজের সমার্থক, এটা এক মহা সত্য। এ কারণে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা যে নৈতিক অধঃপতনের স্বাক্ষর রাখছে তাকে দেশের সামগ্রিক দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির থেকে, সমাজে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের থেকে পৃথক করে দেখার উপায় নেই।