ড. জোবাইদা নাসরীন : অধ্যাপক,নৃবিজ্ঞান বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়:
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যখন স্বাধীন দেশ হিসেবে তার পঞ্চাশ বছর পালন করছে, ঠিক সেই সময়ই দেশের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার ভাটেরা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের মেয়ে নুরুন নাহার চৌধুরী ঝর্ণার উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পড়তে যাওয়া এবং সেই মেয়েটির বিদেশে পরিধেয় পোশাক নিয়ে দেশে থাকা পরিবারকে একঘরে করেছে স্থানীয় মসজিদ কমিটি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জানতে পারি যে, এই ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ঝর্ণা আগে থেকেই ‘পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি বাংলাদেশ’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং ২০১৩ সালে এই সংগঠনের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি মূলত নারী শিক্ষা এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছিলেন। তখন থেকেই অনেকের রোষানলে পড়েন।
তার পর সময় গেছে অনেক। কিন্তু ঝর্ণার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একটা পক্ষ আস্তে আস্তে খুব শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। যেটি হয়তো ঝর্ণা দেশে থাকা অবস্থায় ততটা বুঝতে পারেননি। সেটি জোরালোভাবে প্রকাশ পায় ২৬ ডিসেম্বরের পর। কারণ সেদিন উচ্চতর পড়োশোনার জন্য ঝর্ণা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেন। শুধু সেই ঘটনায়ই ঝর্ণার বিরুদ্ধে আক্রোশ থামেনি। তারা নজির রেখেছেন ঝর্ণার ফেসবুকে। তার ফেসবুকের দেয়ালে ছবিসহ, তার দেশের বাইরে পোশাক-আশাক নিয়েও এলাকায় তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয় এবং তার বাবাকে একঘরে করে ফেলার হুমকি দিতে থাকেন এবং ঝর্ণার বিচারের জন্য তাগাদা শুরু করেন। আর এই বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটি। তারা ঝর্ণার বাবাকে হেয় করার জন্য পঞ্চায়েত কমিটি কর্তৃক আয়োজিত বৈঠকে থাকতে চাপ দেন। অসুস্থ থাকায় সেই সভায় জাননি ঝর্ণার বাবা। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি পঞ্চায়েত কমিটি। ঝর্ণা এবং তার বাবার অবর্তমানেই রায় দিয়ে তাদের একঘরে করে ফেলা হয়েছে। এই রায়ও পোস্ট করা হয়েছে সেই ফেসবুকেই।
এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। প্রথমত, মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির এ রকম বিচার বসানোর এখতিয়ার কতখানি? মসজিদ কমিটি যখন এ রকম একটা কাজ করছিল তখন সেই এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা কি কিছুই জানতেন না? নাকি মসজিদ কমিটি তাদের ইন্ধনেই কাজটি করেছে? কেন মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটি এ রকম একটি বিচারের জন্য সভা ডাকল? একজন নারী বিদেশে গিয়েছে এ জন্য? কে কখন কোথায় কী পোশাক পরবে সেটি নিয়ে আরেকজন কিংবা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কেন মাথাব্যথা হবে? কে কার সঙ্গে ছবি পোস্ট করল, কার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলল সেটি কীভাবে সভার বিষয় হয়? এ রকম একটি বেআইনি কাজ করার জন্য মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির বিরুদ্ধে কী কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
না, যতদূর জানি হয়নি। এ বিষয়ে কোনো সংবাদও আমরা পাইনি। এই দেশ ১৯৯১ সাল থেকে মাত্র দুবছর বাদ দিলে পুরোটাই ছিল নারী প্রধানমন্ত্রীর শাসনে। কিন্তু এখনো নারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ঢঙে-রঙে অপপ্রচার, বিচার-সালিশ সবই হচ্ছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ বিচার-সালিশের রায়ও যাচ্ছে নারীর বিপক্ষে। সালিশ কিন্তু সভার করতে পারার ক্ষমতাও নেই। কিন্তু সেটিকে না মেনেই বিভিন্ন পাটাতন থেকেই নারীর বিরুদ্ধে সালিশ হচ্ছে, বিচার হচ্ছে। নারীকে ঘরছাড়া করছে, সমাজচ্যুত করছে। কখনো কখনো ধর্ষকের সঙ্গে বিয়েও দিচ্ছে।
দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের এখতিয়ারাধীন এলাকায় কতিপয় বিরোধ ও বিবাদের সহজ ও দ্রæত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গ্রাম আদালত গঠনকল্পে গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ করা হয়। এর অনুচ্ছেদে আছে ‘ইহা কেবল ইউনিয়নের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় প্রযোজ্য হইবে।’ তার মানে অন্য কেউ চাইলেই তারা বিচার-সালিশ করার ক্ষমতা রাখেন না।
অথচ বাংলাদেশ স্থানীয় সরকারের বাইরেও সেখানে আছেন প্রশাসনিক ক্ষমতার ব্যক্তিরা। তারাও এই সালিশের বিষয়ে জানতেন না এটা খুব অবাক করা বিষয়। নাকি নারীর বিষয়ে সালিশ করার এখতিয়ার সবাই রাখেন বলেই সামাজিকভাবে মনে করা হয়?
সা¤প্রতিক একটি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশিরভাগ সালিশই নারীর বিপক্ষে যায় এবং সেখানে বিচারের পরিবর্তে ‘মিলমিশ’ পদ্ধতি গ্রহণ করে নারীর প্রতি অবিচার করা হয়। বেশ কিছুদিন আগেও একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ের ব্যবস্থা করে আলোচনায় এসেছেন, যদিও আইনগতভাবে এটি গ্রাম আদালতের বিষয় নয়। কিন্তু এগুলো হচ্ছে।
কেন এ রকম হচ্ছে? ঝর্ণা চৌধুরীর কী দোষ? কেন তিনি কিংবা তার পরিবারকে বিচারের আওতায় আনা হবে? কারা করছে এই বিচার? তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়? স্থানীয় প্রশাসনের ভ‚মিকা কী ছিল? কেন তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না কিংবা ঠেকানোর চেষ্টা করা হয় না? কিংবা কেন এতদিনেও এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর জন্য সেই পঞ্চায়েতের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না?
আমরা গণমাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বক্তব্য পড়েছি। তিনি বলেছেন, ‘ঘটনাটা একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে হয়েছে।’ কার ভুল বোঝাবুঝি? এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি কী তার দায় এড়িয়ে যেতে পারেন আসলে? তা হলে তিনি কেন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি। কোনো নাগরিককে অযথা হেনস্তা করা হলে সেই দায় সেখানকার সব স্তরের প্রশাসনকেই নিতে হবে।
ঘটনাটি সেখানেই ধামাচাপা দেওয়া হলো। এর কারণ কী? এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই যে, নারীর বিরুদ্ধে একজোট হতে সময় লাগে না, কারণও লাগে না। সমাজের প্রত্যাশিত চরিত্রের বাইরে নারী হাজির হলেই তার বিরুদ্ধে এক হওয়া সহজ হয়ে পড়ে। কারণ আমরা বেশিরভাগই নারীবিদ্বেষী। নারীর বিদ্বেষ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নারীর মাধ্যমেই তার পরিবারকে সবচেয়ে বেশি হেনস্তা করা যায়। আসলে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটি সেটিই করতে চেয়েছে। কারণ অনেক মানুষই হয়তো মনে করে মসজিদ কমিটি করলে তার বিপক্ষে মানুষ যেতে চায় না।
কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সবার বিচার বসানোর এখতিয়ার আছে কিনা? কী বিষয়ে বিচার-আচার সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। নারী কেন বিদেশে পড়তে গেল এটিকে নিয়ে বিচার হলে তো একজনের নাগরিক আধিকার হরণের অভিযোগে আইনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত কমিটির বিচার আগে হওয়া উচিত। আর সঙ্গে থাকে তার পোশাক এবং তার সঙ্গী। সেটিও একজন মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়। এই বিষয়ে বিচার তো দূরের কথা, কথা বলার এখতিয়ারও কারও থাকার কথা নয়। তা হলে কীভাবে এগুলো হচ্ছে এবং প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাব জারি থাকছে?
প্রশাসনিকভাবে ঝর্ণা চৌধুরীর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে, কিন্তু অযথা যে হেনস্তার শিকার সেই পরিবারের লোকজন হয়েছে সেটি ঘুচবে কীভাবে? প্রশাসন এই মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির বিষয়ে কেন পদক্ষেপ নিল না? আজ ঝর্ণা চৌধুরীর বিরুদ্ধে বসেছে, কাল এবং পরশু যে আবার অন্য কোনো নারীর বিরুদ্ধে এই ধরনের বিচার বসবে না তার কোনো গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে? তাই শুধু একটি পরিবারের সাময়িক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়েই এই ঘটনার নিষ্পত্তি খুব বেশি আশার জায়গা তৈরি করে না। বরং পঞ্চায়েত কমিটির বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাই হতে পারত ন্যায়বিচারের সোপান।
ড. জোবাইদা নাসরীন : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়