শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৪:০৫ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ফজলুল হকের হাতে আলাদিনের চেরাগ

ফজলুল হকের হাতে আলাদিনের চেরাগ

স্বদেশ ডেস্ক:

রংপুর মেডিক্যাল কলেজে ১৯৯৭ সালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ পান ফজলুল হক। ২০০৪ সালে হন ‘অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট’ কাম কম্পিউটার অপারেটর। এর পর পদোন্নতি পেয়ে ২০০৯ সালে স্টোরকিপার এবং ২০১২ সালে হন ‘হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট’। নন-মেডিক্যাল কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী তার আর কোনো পদোন্নতির সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো,

তিনি এখন রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ছিলেন সচিবের দায়িত্বেও। ফজলুল হকের উল্লম্ফন শুধু পদোন্নতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিকও।

উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ফজলুল হক কীভাবে সুইপার থেকে বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা হলেন- সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন। তবে কেউই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। ‘গায়েব হয়ে গেছে’ ফজলুল হকের চাকরিসংক্রান্ত নথিপত্রও। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একাধিকবার তদন্তের উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অন্তত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন ফজলুল হক। রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়সহ ৮ জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই। পছন্দের লোকদের বিভিন্ন পর্যায়ের টেন্ডার, ওষুধ, গজ-ব্যান্ডেজ, যন্ত্রপাতি সরবরাহের ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফজলুল হক রংপুর মহানগরীর আলমনগর ও দর্শনা এলাকায় নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। রংপুর মহানগরীর কলেজপাড়া এলাকায় ৩ একর জায়গায় মেয়ের নামে ৪০০ শয্যার ‘ফারজানা ছাত্রী হোস্টেল’ বানিয়েছেন তিনি। মহানগরীর আর কে রোড এলাকায় কয়েক একর জায়গাজুড়ে ছোট ছেলের নামে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফাইয়াজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ’। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জায়গার আনুমানিক বাজারমূল্য ২৫ কোটি টাকা। স্কুলের পাশেই রয়েছে তার বিলাসবহুল আরেকটি বাড়ি। এ ছাড়া দর্শনার বড়বাড়ী এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিশাল গরুর খামার। সেখানে রয়েছে বাগানবাড়ি ও বিশাল পুকুর। খামারে রয়েছে ২ শতাধিক দেশি-বিদেশি গরু।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুরারঘাট এলাকায় ২৫ একর জমি রয়েছে ফজলুল হকের। তার দুই ছেলে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া করেন। ফজলুল হকের ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার) রয়েছে ২টি। এক ছেলের নামে রয়েছে আইটি সেন্টার। এ ছাড়া কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর বালারহাটে গ্রামের বাড়িতেই অনেক জায়গা কিনেছেন তিনি।

রংপুর জেলা দলিল লেখক সমিতির সদস্য মোতালেব সরকার বলেন, ‘ফজলুল হক তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে অসংখ্য জমিসহ বিভিন্ন সম্পদ লিখে দেওয়া এবং হেবা দলিল করেছেন। এ কাজগুলো আমি করে দিয়েছি।’

রংপুর মেডিক্যাল কলেজের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে চলতি দায়িত্ব পেয়ে সচিবের চেয়ারে বসেন ফজলুল হক। ওই সময় কলেজে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ ওঠে। এর পর ২০১৯ সালের ৩ মার্চ রংপুরের বিভাগীয় স্বাস্থ্য অফিসে বদলি হন প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. একেএম নুরুন্নবী লাইজু জানান, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতির জন্য যাদের তালিকা করা হয়েছিল, সেখানে ফজলুল হকের নাম ছিল না। কীভাবে তার পদোন্নতি হলো, তা রহস্যজনক। সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. বিমল চন্দ্র জানান, তিনি গত ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নিয়েছেন। ফজলুল হকের সচিব হওয়ার ব্যাপারে কিংবা নথিপত্র গায়েবের বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘পুরো ঘটনা আমি খতিয়ে দেখব।’

ফজলুল হককে রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রশাসনিক পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য মহাপরিচালক অফিসের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। লিখিতভাবে আবেদন করা হলে ফজলুল হকের নিয়োগসংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করা হবে বলেও জানান তিনি।

রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. জাকিরুল ইসলাম লেলিন বলেন, ‘আমার যোগদানের আগে ২০১৯ সালে তৎকালীন রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক অধ্যাপক ডা. অমল চন্দ্র সাহার আমলে ফজলুল হক চলতি দায়িত্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ সিদ্ধান্তে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তথ্য অধিকার আইনে আমাকে নোটিশ করা হলে ফজলুল হকের কাগজপত্র সংগ্রহ করে দেওয়ার চেষ্টা করব।’ জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘ফজলুল হক তার চলতি দায়িত্ব থেকে স্থায়ী দায়িত্ব নেওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবির করছেন। সম্ভবত তিনি ঢাকায় গিয়ে এ কাজে ব্যস্ত আছেন। চাকরিবিধি অনুযায়ী পরিচ্ছন্নকর্মীর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও এমএলএস পদ থেকে পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে। তবে ফজলুল হকের ক্ষেত্রে সেটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

তৎকালীন রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. অমল চন্দ্র সাহা আমাদের সময়কে জানান, তিনি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ওপর মহল থেকে ফজলুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

দাপ্তরিক কাগজপত্র সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত রংপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রধান সহকারী রিফাত সুলতানা দিবা জানান, রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে যোগদানের আগেই ফজলুল হক তার পদোন্নতিসহ সব নথিপত্র সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। বর্তমানে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে তার কোনো নথিপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজের ফাইল নেই। একই কথা জানান রংপুর মেডিক্যাল কলেজের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এদিকে ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে রংপুর মেডিক্যাল কলেজের সাবেক সচিব ফজলুল হকসহ ৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদক। তবে সেই তদন্ত তিনি ধামাচাপা দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ গত ২০ ডিসেম্বর রংপুর মেডিক্যাল কলেজে টেন্ডার জালিয়াতি করে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে ফজলুল হকসহ ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তলব করা হয়। কিন্তু চিঠি আসার পর ফজলুল হক ছুটিতে চলে যান।

রংপুর জেলা দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন বলেন, ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি বহুল আলোচিত।’ তার অবৈধভাবে পদোন্নতির বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কীভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা হলো, যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার হওয়া উচিত।’ তিনিও দুর্নীতি দমন কমিশনকে তদন্ত করে অবিলম্বে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সদস্য ও সমাজকর্মী অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ বলেন, ‘অবৈধভাবে একজন সুইপার কীভাবে সচিব হন। ১০০ কোটির ঊর্ধ্বে টাকার মালিক তিনি কীভাবে হলেন? দুদকের উচিত, নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।’

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদস্য ও রংপুর মেডিক্যাল কলেজের সাবেক ভিপি ডা. সৈয়দ মামুনুর রহমান মামুন বলেন, ‘ফজলুল হক অনিয়ম করে থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।’

নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে ফজলুল হক বলেন, ‘পদোন্নতি আমি নিজে নেইনি। পদোন্নতি বোর্ড আমাকে দিয়েছে। বোর্ডকেই জিজ্ঞাসা করা হোক কীভাবে আমার পদোন্নতি হয়েছে।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877