স্বদেশ ডেস্ক: সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজপথের কঠোর কর্মসূচি ছাড়া শুধু আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করা সম্ভব নয়-এমন বক্তব্য প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যেই দেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে ‘অবিলস্বে খালেদা জিয়া’কে মুক্তি না দিলে সরকারের পরিণতি ভালো হবে না বলে হুশিয়ারিও দেন।
তবে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন না। তাদের কথা-নেত্রীকে মুক্ত করতে রাজপথে বড় ধরনের কর্মসূচি প্রয়োজন। সে কর্মসূচিতে থাকতে হবে সিনিয়র নেতাদের। অন্যদিকে সিনিয়র নেতারা বলছেন, সরকার না চাইলে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।
কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে দেনদরবার করতে হবে। আলোচনার পথ খোলা রেখে সরকারকে রাজি করাতে পারলেই খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাবন্দি হন। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন, খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর সিনিয়র নেতারা তার মুক্তির জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেননি। সিনিয়র নেতারা এখনো যদি সিদ্ধান্ত নেন বিএনপির দাবি হবে একটি খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা।
এ জন্য রাজপথে যত ধরনের কর্মসূচি তা বিএনপিকে করতে হবে। ঢাকা মহানগরকে জেগে উঠতে হবে। কর্মসূচি সফল করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার হওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। খালেদা জিয়ার মতো আপসহীন থাকতে হবে। তা হলে তার মুক্তি সম্ভব।
তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, সিনিয়র বেশিরভাগ নেতার মানসিক অবস্থা হচ্ছে গ্রেপ্তার এড়িয়ে যতটুকু রাজনীতি করা যায়। কোনো কোনো নেতার মধ্যে এমন ধারণা জন্মেছে খালেদা জিয়া মুক্ত হলে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বর্তমানে যে কর্তৃত্ব করতে পারছেন তা আর পারবেন না।
এমন অবস্থার মধ্যে আজ সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়াও বন্যা পরিস্থিতি ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে।
গত শুক্রবার বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়া জিহ্বায় আলসার হয়েছে। গত এক সপ্তাহে চার কেজি ওজন কমেছে। ম্যাডামকে দেখলে এখন চিনতেই পারবেন না। এমন সংবাদে বিএনপির নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে নিয়ে বেশ চিন্তিত।
একাধিক সিনিয়র নেতা বলছেন, নির্বাচনের পর থেকেই তৃণমূল থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে তাদের ওপর চাপ আছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বড় ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না।
অনেকেরই ধারণা ছিল-একাদশ সংসদে নির্বাচিতরা সংসদে যোগ দিলে সরকার নমনীয় হবে এবং খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেবে। সম্প্রতি খুলনার বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে তার সঙ্গে সংলাপ করেছি, নির্বাচনে গেছি, শপথ নিয়ে সংসদেও গেছি। কিন্তু সব পরীক্ষার ফল শূন্য। এখনো যদি মনে করি দেশনেত্রীকে মুক্তি দেবে সরকার সেটি হবে ভুল।
গত ১৮ মাস ধরে ‘গণতন্ত্রের মা’ ভিত্তিহীন মামলায় কারাবন্দি। কিন্তু তার জন্য কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। আমরা যদি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে না পারি খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। আমাদের দ্রুত আন্দোলন করতেই হবে।
দলটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, তারা মূলত একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। দলের চেয়ারপারসন কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে। দলের নেতারা পরস্পরকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। একজন আরেকজনকে মনে করে সরকারের লোক। সে কারণে তারা মুখে মুখে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি করলেও ভেতরে ভেতরে দলের ঐক্য ধরে রাখার পেছনে বেশি সময় দিচ্ছেন।
ওই নেতা জানান, বর্তমানে হরতাল, অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা তাদের মাথায়ও নেই। জনগণের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করেই আন্দোলনে নামবেন। সরকারের চাপে না পড়লে অথবা সরকারের পতন না হলে খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো সম্ভাবনা ওই নেতা দেখছেন না।
গত ১৮ এপ্রিল বরিশাল সমাবেশে তৃণমূলের নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যে কোনো কর্মসূচি দেওয়ার জন্য মহাসচিব মির্জা ফখরুলের প্রতি আহ্বান জানান। এ সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, মিছিল-মিটিংয়ে, মানববন্ধনে দেশনেত্রীকে মুক্ত করা যাবে না। তাকে মুক্ত করতে হলে সবাইকে ঢাকা শহরে যেতে হবে। বেশি না এক লাখ লোক শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে থাকি, আমাদের সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ যোগ দেবে। এ জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
দলের এক নেতা জানান, বুমেরং হয় এমন কোনো কর্মসূচিতে বিএনপি যাবে না। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজপথে কঠোর কোনো কর্মসূচির চিন্তা নেই বিএনপিতে। বিভাগীয় কর্মসূচি শেষ করে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গতানুগতিক ধারায় দেশের বৃহত্তর জেলাগুলোয়ও কর্মসূচি হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এর সব মামলা হচ্ছে রাজনৈতিক। আমরা ৩৫টি মামলায় জামিন নিয়েছি। এখন দুটি মামলার জামিন বাকি। আইনি লড়াই করছি। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগ্রাম-দুইয়ের মিলনে খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন।