শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৯:২৯ অপরাহ্ন

পরিবহণে বাড়তি ভাড়া: মুনাফায় খুশি মালিকরা শ্রমিকদের হাহাকার

পরিবহণে বাড়তি ভাড়া: মুনাফায় খুশি মালিকরা শ্রমিকদের হাহাকার

স্বদেশ ডেস্ক:

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস মালিকরা জমার টাকার (চুক্তির টাকা) পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতে আগের তুলনায় তারা বেশি মুনাফা পাচ্ছেন। কিন্তু পরিবহণ শ্রমিকদের ওপর চাপ আরও বেড়েছে।

জমার বাড়তি টাকা ও চাঁদাসহ অন্যসব খরচ পোষাতে তাদের বাড়তি ভাড়া আদায় করতে হচ্ছে। পরিবহণ শ্রমিকদের দাবি- বাসের ভাড়া বাড়ায় মালিকদের লাভ হচ্ছে কিন্তু তারা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। তাদের মধ্যে হাহাকার দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির নেতাদের দাবি, তারা ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। ওয়েবিল ও সিটিং সার্ভিস তারা বন্ধ করেছেন। তবে শ্রমিকরা বলছেন, এসব হলো কথার কথা। বাস্তবে কিছুই কার্যকর হয়নি। পালটা চুক্তিবদ্ধ গাড়িতে জমার পরিমাণ বাড়িয়ে মালিকরা নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন।

তাদের মতে, মালিকরাই ওয়েবিল জিইয়ে রেখেছেন। মালিকদের কারণে পরিবহণে ভাড়া নৈরাজ্য কমেনি। যাত্রীরা জানান, সর্বনিম্ন ভাড়া এমনিতেই বেশি। এরপরও এ সর্বনিম্ন ভাড়াও মানেন না পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক এনফোর্সমেন্ট সরওয়ার আলম যুগান্তরকে বলেন, পরিবহণ নৈরাজ্য বন্ধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিদিন অভিযান চলছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ১১টি ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, নগর পরিবহণকে একটা নিয়মে আনার কাজ চলছে। পরিবহণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আসলে শ্রমিকরাও ভালো থাকবে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, মূলত সর্ষের মধ্যেই ভূত। এ ভূত তাড়াতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শ্রমিকরাও ভালো থাকবে না। তিনি বলেন, নানা উদ্যোগ নিয়েও ভাড়া নৈরাজ্য থামানো যায়নি। বেশি ভাড়া আদায়কারী মালিকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারলে পরিবহণে নৈরাজ্য কমে যেত।

বাস মালিকদের জমার পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়টি শিকার না করলেও বুধবার সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্ল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, চুক্তির বিষয়টিই একটি অনৈতিক পদ্ধতি (আনইথিক্যাল সিস্টেম)। এটা ভাঙতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

সরেজমিন দুইদিন ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে পরিবহণ খাতের নানা চিত্র ওঠে এসেছে। সাভার থেকে বাড্ডা নতুন বাজার রুটে চলাচলকারী বৈশাখী পরিবহণের এক চালক যুগান্তরকে বলেন, তেলের দাম বাড়ায় ভাড়া বেড়েছে। এতে আমাদের কি? সব লাভ তো মালিকের। ভাড়া বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মালিক জমার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে মালিককে আড়াই হাজার টাকা জমা দিতাম। এখন সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। আগের চেয়ে এখন দিনে তেল খরচ ১ হাজার টাকা বাড়তি লাগছে। এরপর জিপির টাকা, চাঁদার টাকা কতকিছু দিতে হচ্ছে।

ওই চালক আরও বলেন, আমার নাম লিখবেন না, লিখলে আমি গুম হয়ে যাব। পরিবহণ শ্রমিকরা মনের কথা মনেই রাখে। বিপদের ভয়ে মুখ খোলে না।

তিনি আরও বলেন, ২৫ বছর ধরে এ লাইনে কাজ করেও ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারিনি। আগে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বাড্ডা এলাকায় ভাড়া থাকতাম। করোনাভাইরাসের ধাক্কায় সব ওলটপালট হয়ে গেছে। রংপুরে গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দিয়েছি। লকডাউনের সময় যে ধারদেনা হয়েছে তা এখনও ঠেলছি (শোধ করতে পারিনি)।

তিনি বলেন, সপ্তাহে তিনদিন গাড়ি চালাই। আর চারদিন বেকার। তিনদিনে যে টাকা আয় হয় তাতে সংসার চলে না। এখন দিন শেষে সব খরচ দিয়ে আগের চেয়েও কম টাকা রোজগার হয়।

তিনি বলেন, যে টাকা আয় হয় তা পকেটে নিয়ে বাসায় ফিরতে পারলে কবেই বড়লোক হয়ে যেতাম।

মতিঝিল-চন্দ্রা রুটে চলাচলকারী ওয়েলকাম পরিবহণের চালকের সহকারী রিয়াজ যুগান্তরকে বলেন, আগে মালিককে জমা দিতাম ২ হাজার ২০০ টাকা। ভাড়া বাড়ার পর ৩ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভাড়া বৃদ্ধির করণে যে টাকা বাড়তি আয় হয়, তাতো মালিকরাই নিয়ে যায়। এরপর রাস্তায় দিতে হয় নানা ধরনের চাঁদা। সব মিলিয়ে দিন শেষে আমাদের কিছুই থাকে না। কোনোদিন ৫০০-৬০০ টাকা আবার কোনোদিন ৭০০ টাকা নিয়ে বাসায় ফিরতে পারি।

রিয়াজের মতে, এ চুক্তি-পদ্ধতি বাতিল করে রোজ বেতনে গাড়ি চালালে তারা ভালো থাকবেন।

মিরপুর-১৪ থেকে চন্দ্রা রুটে চলাচলকারী ইতিহাস পরিবহণের এক সুপারভাইজার যুগান্তরকে বলেন, ‘ভাড়া বাড়লে আমাগো কি? লাভ সব মালিকের। আমরা যে লাউ সেই কদু।’

তিনি বলেন, আগে মালিককে ২ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দিতাম। এখন দিতে হয় ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। আর বাড়তি ভাড়া নিয়ে রাস্তায় যাত্রীদের সঙ্গে তাদের যতসব ঝামেলা পোহাতে হয়।

তিনি বলেন, ৫ টাকা ভাড়া বেশি চাইলে যাত্রীরা মারতে আসে। আবার ১০০ টাকা কম দিতে চাইলে মালিক গাড়ি দিতে চান না।

গাবতলী-ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচলকারী অছিম পরিবহণে নিয়মিত যাতায়াত করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রায়হান আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সরকার নির্ধারিত চার্ট পরিবহণ শ্রমিকরা মানছেন না। তারা মনগড়া ভাড়া দাবি করেন। না দিলে দুর্ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় কথা বলি, আবার অনেক সময় জেনেশুনেই বাড়তি ভাড়া দিয়ে দেই। এসব দেখার তো কেউ নেই।

তিনি বলেন, কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে কালসি পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু অছিম, নূরে মক্কা ও রাজধানী পরিবহণে ২৫ টাকা নেওয়া হয়। ভাড়া না দিলে পরিবহণ শ্রমিকরা দুর্ব্যবহার করে।

অছিম পরিবহণের একটি গাড়ির চালকের সহকারী সোহেল যুগান্তরকে বলেন, দোষ তো সব আমাদের। কিন্তু আমরা তো শখে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেই না। বাড়তি ভাড়া না নেওয়ার জন্য আমরাও আন্দোলন করেছি। মালিকদের বুঝাতে পারিনি।

তিনি বলেন, দুপুরের সময় দেখা যায়, অর্ধেক যাত্রী নিয়েও চলাচল করতে হয়। এতে তেলের পয়সাও উঠে না। কিন্তু মালিক তো ষোল আনা টাকা ছাড়া বুঝেন না।

বনশ্রী থেকে মিরপুরগামী আলিফ পরিবহণের যাত্রী ইমরানুল হক যুগান্তরকে বলেন, গাড়িতে উঠলেই গুনতে হয় ২৫ টাকা।

তিনি বলেন, মহাখালী রেলগেট থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব ৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার। এতে ভাড়া আসে সর্বনিম্ন ১০ টাকা। কিন্তু তারা আদায় করছে আড়াই গুণ।

আলিফ পরিবহণের এক চালক যুগান্তরকে বলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানের বিপরীত পাশে চেকিং হয়। আমাদের কিছুই করার নেই। ২৫ টাকা নিতেই হবে। আর কম নিলে জমার টাকা মেলাতে পারি না।

কুড়িল বিশ্বরোড থেকে আজিমপুরগামী দেওয়ান পরিবহণের শ্রমিক রাজিব যুগান্তরকে বলেন, সারা দিন গাড়ি চালিয়ে আমরা টাকা রোজগার করি। কিন্তু দিন শেষে পকেট শূন্য। আমরা শুধু টাকা কামিয়েই দিলাম। কিন্তু নিজেরা ভালো থাকতে পারলাম। আমাদের দেওয়া টাকা দিয়ে আয়েশ করেন বাস মালিকরা। প্রতিটি রুটেই যেমন ভাড়া আদায়ে অনিয়ম চলছে, তেমনি শ্রমিকদের মাঝেও হতাশা, হাহাকার বিরাজ করছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী যুগান্তরকে বলেন, ৮০ শতাংশ গাড়িই চুক্তিতে চলে। এ নিয়ম বাতিল না করলে কোনোভাবেই বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, প্রতিদিন মালিকদের ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। তেল খরচ মিটিয়ে আবার নিজেদের বেতনও তুলতে হয়। এছাড়া অন্যসব খরচ তো আছেই।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877