রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৩১ অপরাহ্ন

রোকেয়া সাখাওয়াতের সমাজ ভাবনা

রোকেয়া সাখাওয়াতের সমাজ ভাবনা

ডা: মিরা মমতাজ সাবেকা:

মুসলিম বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার আদর্শ ছিল ধর্মভিত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক ভারসাম্যপূর্ণ। তার মন ও মননে, চিন্তা ও চেতনায় ধর্মীয় উপাদান ছিল মুক্ত, সঠিক, যুক্তিনির্ভর ও কুসংস্কারমুক্ত। ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা ও যৌক্তিকতার আলোকে তার নৈতিকতা, কর্মপন্থা ও কর্মপরিধি তাকে উন্নীত করেছিল এক অনন্য সাধারণ অবস্থানে, যার আলোকচ্ছটা শতবর্ষ পরও দেদীপ্যমান। তার বোধ তাকে আজীবন সাধনায় ব্রতী করেছিল, তা ছিল নিরলস, কঠোর ও ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে।

জ্ঞানতাপসী রোকেয়া অনুধাবন করেছিলেন, ইসলামের শাশ্বত সুন্দর বাণী পুরুষতান্ত্রিক অপব্যাখ্যা ও কুসংস্কারের কালো পর্দায় আচ্ছাদিত কালো মেঘের আড়ালে সেই সূর্যরশ্মি তাকে আলোকিত করেছিল, সেই আলোয় তিনি আলোকদিশারি হয়েছেন, তার অনুজ সব নারীর জন্য।

মুসলিম নারীর উন্নয়নকল্পে তার আজীবন সংগ্রাম এর মূল বাধা এসেছিল স্বীয় সমাজ-গোত্র-ধর্ম থেকেই। সেই অভিব্যক্তির স্বাক্ষর রয়েছে তার অমূল্য লেখনীতে। তিনি নারীর সহস্র বছরের ঘুম ভাঙাতে প্রয়াসী হয়েছেন, তাদের মুখ থুবড়ে পড়া চেতনাকে আঘাত করেছেন কৌতুকচ্ছলে, অবরোধের দুর্গ ভেদ করে নবসূর্যের আলোকবর্তিকার সন্ধান দিয়েছেন।

ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও কুসংস্কার নিরসনে তিনি কুরআনের শরণাপন্ন হয়েছেন…সমুদ্রের অতলান্ত নিমজ্জিত যাত্রীর মুক্তিসোপান এই কুরআন। এর জন্য তিনি- ১. কুরআন বুঝে পড়ার তাগিদ দিয়েছেন, আরবি জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন; ২. কুরআনকে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বলে আখ্যায়িত করেছেন; ৩. কুরআনকে প্রাথমিক শিক্ষায় বাধ্যতামূলক করার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন।

নারীমুক্তির প্রথম সোপান হিসেবে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এর প্রথম প্রতিবন্ধক হিসেবে তিনি নারীর অজ্ঞতা ও অনুৎসাহকেই দায়ী করেছেন। তৎকালীন বাঙালি মুসলিম নারীদের তিনি নানাভাবে জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছেন। শিক্ষার সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে মুসলিম নারী বিয়ের ক্ষেত্রে তার যোগ্যতা হারাবে, এভাবে সমাজে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি ধর্মহীনতার আশঙ্কাও প্রবল। জ্ঞানহীনতা ধর্মহীনতার নামান্তর, যেখানে পদস্খলিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। নার্স নেলী প্রবন্ধে তিনি এ চিত্র তুলে ধরেছেন, ‘যে কখনো আলোক দেখে নাই, তাহার কাছে জোনাকির আলোই সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে হয়।’ তাই নারীদের অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে শুধু গৃহকর্ম ও সন্তান প্রতিপালনে জীবন অতিবাহিত না করে সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োজিত হতে বলেছেন। চলমান পৃথিবীর গতিপথে নিজেকে স্থবির রাখা বোকামির নামান্তর এবং আশঙ্কাজনক।

সর্বোপরি নারীশিক্ষার বিকাশে কলম ধরেছেন তিনি, স্কুল স্থাপন করেছেন, তৎকালীন অবরোধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। অবরোধবাসিনী প্রবন্ধে সাহসিকতাপূর্ণ তির্যক বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন- ধর্মীয় এই অপশাসন অদূর ভবিষ্যতে মুসলিম সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।

তিনি বারবার প্রমাণসহ উচ্চারণ করেছেন, নারী-পুরুষের মেধাশক্তিতে কোনো পার্থক্য নেই। প্রচলিত মতানুযায়ী নারীর মস্তিষ্ক আকারে বা ওজনে ছোট হওয়া এ কথা প্রমাণ করে না যে, নারীর মেধা পুরুষের তুলনায় কম। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, হাতির মস্তিষ্ক যত বড়ই হোক না কেন তা মানুষের তুলনায় নগণ্য, সুতরাং আকার ও ওজন কখনোই শ্রেষ্ঠত্বের নিয়ামক হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে তিনি রাসূল সা:-এর বাণী উল্লেখ করে বলেছেন, জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সুতরাং সমাজের হিতকর্মে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি, নারী পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877