সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৩:১৮ পূর্বাহ্ন

করোনার পর ডিজেলের ধাক্কা, লাফিয়ে বাড়ে ‘বাঁচা’র খরচ

করোনার পর ডিজেলের ধাক্কা, লাফিয়ে বাড়ে ‘বাঁচা’র খরচ

স্বদেশ ডেস্ক:

করোনায় আয় কমেছে মানুষের। কর্ম হারিয়েছেন অনেকে। তবে লাফিয়ে বেড়েছে জীবনযাত্রার খরচ। চাহিদার তুলনায় ছিল না প্রয়োজনীয় জোগান। বছরজুড়ে তাই নিত্যপণ্যের বাজারে ছিল আগুন। আর সেই দুঃসময় কাটিয়ে চলে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্যে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু কোমর সোজা হওয়ার আগেই বড় ধাক্কা হয়ে আসে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জ্বালানিটির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয় প্রায় ২৩ শতাংশ। এতে জনগণের দুর্ভোগ বেড়ে যায় বহুগুণ। যাতায়াত ও দ্রব্যমূল্যসহ একে একে বেড়ে যায় সব ধরনের খরচ। সেই বাড়তি চাপে সবাই নাজেহাল। টিকে থাকতে মৌলিক চাহিদায় কাঁচি চালাতে বাধ্য হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত।

বিদায়ী বছরে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটলেও বাজার হেঁটেছে উল্টোপথে। নিত্যপণ্যের দামে পুড়তে হয় ভোক্তাদের। বিশেষ করে তেল, চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, আটা, চিনি, দুধ, মাছ-মাংসে দুর্ভোগ পোহাতে হয় বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে দফায় দফায় সয়াবিন তেলের দাম বাড়ান ব্যবসায়ীরা। পাল্লা দিয়ে খোলা তেলের দামও বাড়ানো হয়। একইভাবে বাড়ানো হয়েছে চিনির দাম। এমনকি পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সরকার পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও তা ছিল খাতা-কলমেই।

প্রচুর জোগান থাকলেও বছরের শেষে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয় অস্বাভাবিকভাবে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়ে যায় পরিবহন খরচ। তাই বছর শেষে শীতের দেখা মিললেও শীতল হয়নি সবজির বাজার। প্রায় সব ধরনের তরিতরকারির দামই থাকে নিম্নআয়ের নাগালের বাইরে। এক পিস ডিমের দামও গিয়ে ঠেকে ১০ টাকায়। গরিবের প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়ে যায় হু হু করে। বছরজুড়ে চালের বাজার ছিল বেশ চড়া। সরকারের আমদানির সিদ্ধান্ত ও আমনের ভালো ফলনেও সুখবর মেলেনি বাজারে। সব ধরনের চালের দাম এখনো বাড়তি। মোটা চাল ও মসুর ডালের পেছনে খরচ বাড়ায় ডাল-ভাতেও টান পড়ে গরিবের।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে যদিও ঘটা করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা, তাই সমাধানও মেলেনি। বারবারই উপেক্ষিত হয়েছে সরকারের নির্দেশ। ব্যবসায়ীরা চলছেন আপন মর্জিতেই। কেবল মাসুল গুনছেন ভোক্তারা। রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণনকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবও বলছে, বছরের ব্যবধানে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বাজারের অস্থিরতা সামাল দিতে বছরের বিভিন্ন সময়ে ভর্তুকি মূল্যে ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি ও পেঁয়াজ বিক্রি করে টিসিবি। কিন্তু বরাদ্দকৃত পণ্যের তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় ডিলার ট্রাকের সামনে পণ্য পেতে চলে হাহাকার। করোনায় আয় কমে যাওয়ায় ন্যায্যমূল্যের এসব ট্রাকের সামনে নিম্নআয়ের পাশাপাশি মাস্কে মুখ ঢেকে মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ভিড় বাড়ে। বিশেষ করে কম দামে সয়াবিন তেলের দুই লিটারের একটি বোতল পেতে রীতিমতো লড়াই চলে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও দেশে বাড়িয়ে দেওয়া হয় তার কয়েকগুণ। হঠাৎ কোনো পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেই কেবল টনক নড়ে প্রশাসনের। ততক্ষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় সিন্ডিকেট চক্র। বাজার ব্যবস্থাপনাতেও বড় ঘাটতি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ থাকলেও রয়েছে সমন্বয়ের ঘাটতি। শুধু তা-ই নয়, অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি, মজুদ ও সরবরাহের প্রকৃত পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে যে তথ্য রয়েছে বাস্তবতার সঙ্গে সেটারও বিস্তর ফারাক।

ভোক্তা পর্যায়ে গত ৩ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা থেকে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এর পরই মালিক সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। যদিও রাজধানীর বিভিন্ন রুটে আদায় করা হচ্ছে তারও অতিরিক্ত ভাড়া। গোঁ ধরেন লঞ্চ মালিকরাও। ধর্মঘটের মাধ্যমে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে তারাও লঞ্চ ভাড়া বাড়িয়ে নেন ৩৫ শতাংশ। ৯ নভেম্বর পাঁচ ধরনের সেবায় ২৩ শতাংশ হারে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)। এতে আমদানি পণ্যের ব্যয় বেড়ে যায়। ১৭ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লাইটার জাহাজের ভাড়াও ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। ডিজেলের দাম বাড়ায় বিঘাপ্রতি সেচ খরচ ১৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে কৃষকের। অপরদিকে ধর্মঘট শেষে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করছে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানগুলোও, যার প্রভাব পড়ছে বাজারের পণ্যের দামে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে ফলের দামও।

এদিকে এলপি গ্যাসের দাম কয়েক দফা বাড়ায় সংসার খরচ বেড়েছে। হোটেলে খাবারের দামও ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সকালের নাশতার সামান্য পরটার দামটাও বেড়ে গেছে। শিল্প-কারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় খরচ বাড়িয়েছে ডিজেল, কেরোসিন ও গ্যাস সিলিন্ডারের বাড়তি দাম। জাহাজ ভাড়া ও কনটেইনার খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় পশুখাদ্যের সব ধরনের পণ্যের দামও ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। খামার টিকিয়ে রাখতে তাই বিপাকে পড়েন উদ্যোক্তারা।

চলতি বছর এক জরিপে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম বাংলাদেশ জানায়, মহামারী করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে দেশের ৮০ শতাংশ পরিবার খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে খাদ্যবহির্ভূত খরচ কমিয়ে দিয়েছে ৬৪ দশমিক ৫০ শতাংশ পরিবার। ‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব’ নিয়ে এক জরিপে সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোরাম (সানেম) বলছে, করোনা সংক্রমণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। ২০১৮ সালে এটি ছিল কেবল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপ বলছে, করোনাকালে দেশে বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েকগুণ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877