সোমবার, ১৭ Jun ২০২৪, ০৪:১৫ পূর্বাহ্ন

হজ থেকে যে শিক্ষা নেয়া দরকার………

হজ থেকে যে শিক্ষা নেয়া দরকার………

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক: এখন হজের মৌসুম। আল্লাহর ঘরের মেহমানরা হজে যাচ্ছেন। প্রিয়জন ও বন্ধুদের অনেকেই জানতে চান, হজ থেকে আমরা কী নিয়ে ফিরব? কাবার পথের যাত্রীদের জন্য প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। নিচের আলোচনায় সে প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হজের সফরের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কোনো না কোনো ইবাদত আদায় করা হয়। চাই তা ফরজ, সুন্নত বা নফল হোক না কেন। একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য ও আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে যে সে আল্লাহর ঘর থেকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদতকারী বান্দা হয়ে ফিরে আসবে যেমন বলা হয়েছে, ‘আয়িবুনা তায়িবুনা লি-রব্বিনা হামিদুন’ হে আল্লাহ আপনার হামদ ও শোকর আদায় করতে করতে আবার আপনার দরবারেই আমরা ফিরে আসছি।
হজ ও ওমরাহ শেষে সঙ্গে করে কী আনবেন, তা জানতে হলে কুরআন, হাদিস, সিরাতের কিতাব থেকে হজের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট অধ্যয়ন করতে হবে। আকাবিরদের হজের ঘটনাবলি পাঠ করতে হবে। বায়তুল্লাহ এবং হজের অন্যান্য শাআয়ের ও মাশায়ের (নিদর্শনাবলি) যেসব মহাপুরুষের ত্যাগ ও কোরবানির সাক্ষ্য বহন করছে, কুরআন মজিদে তাঁদের অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যাবলি পড়তে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর হজের বিবরণ এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা হজ করেছেন তাঁদের ঘটনাবলি হতে পারে আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ পাঠ। সেখান থেকেই জানা যাবে হজের শিক্ষা কী এবং সেখান থেকে কী আনতে হবে। এই নিবন্ধে শুধু কিছু মৌলিক শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত করা হলো।
তাওহিদ, ঈমান ও বিশ্বাস: তাওহিদের পূর্ণতা ও ঈমান-ইয়াকিনের দৃঢ়তা হজের প্রথম ও চূড়ান্ত শিক্ষা। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক থেকে শুরু করে বিদায় তাওয়াফ পর্যন্ত হজের প্রতিটি আমল এ সাক্ষ্যেরই মূর্ত রূপ যে আমাদের তাওহিদ শুধু বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আকিদা ও বিশ্বাসের সীমা অতিক্রম করে তা আমাদের কর্ম ও আচরণে, আমাদের চরিত্র, ব্যবহার ও চালচলনে মিশে গেছে।
কাবা’র নির্মাতা, তাওহিদের ইমামের (ইবরাহিম (আ.)) আচরণ-উচ্চারণ তো এই ছিল, ‘আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম, যিনি আকাশম-ল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সুরা : আনআম, আয়াত : ৭৯) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলে দাও, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎগুলোর প্রতিপালক।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬২-১৬৩)
তাওহিদ পূর্ণ হয় মূলত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা ও নিসবতে ইহসান (আত্মনিবেদনের সম্পর্ক) অর্জনের মাধ্যমে। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো হজ ও ওমরাহে এই দুটি জিনিসেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ঈমান ও ইয়াকিন মজবুত করার জন্য হারামের সীমানায় প্রবেশ করার সময় হাজেরা (রা.)-এর ইয়াকিনপূর্ণ ওই বাক্য স্মরণ করাই যথেষ্ট, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন এক কঠিন মুহূর্তে। ইবরাহিম (আ.) যখন তাঁকে ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈলকে তৃণলতাহীন, জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তরে উপায়-উপকরণহীন নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাচ্ছিলেন এবং তিনি এ কথা জানতে পারলেন যে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশেই এমনটি করা হচ্ছে, তখন তিনি অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে দৃঢ়তাপূর্ণ ঐতিহাসিক বাক্যটি উচ্চারণ করেন, ‘ইজান লা ইউজিয়ুনা’ আল্লাহ তায়ালাই আমাদের অভিভাবক। সুতরাং তিনি আমাদের ধ্বংস করবেন না। (আসসুনানুল কুবরা, নাসায়ি, হাদিস : ৮৩২০)।
আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ: মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হলো আনুগত্য ও সমর্পণ। হজের বিধি-বিধানে এই সমর্পণেরই অনুশীলন চলে। উপরন্তু কোনো হজ বা ওমরাহকারী যদি কাবাগৃহের নির্মাতা ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আ.)-এর অবস্থা স্মরণ রাখেন, তাহলে তিনি অবশ্যই হজ থেকে আনুগত্য ও সমর্পণের শিক্ষা গ্রহণ করবেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে বললেন, আনুগত্যে নতশির হও, তখন সে (সঙ্গে সঙ্গে) বলল, আমি রাব্বুল আলামিনের (প্রতিটি হুকুমের) সামনে মাথা নত করলাম। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৩১)
আল্লাহ তায়ালা হজের নিদর্শনাবলির সঙ্গে বিজড়িত হজরত ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আ.)-এর কোরবানি, পরীক্ষা ও সাফল্যের বর্ণনা দিয়েছেন, ‘ইবরাহিম (আ.) বললেন, আমি আমার প্রতিপালকের কাছে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন। হে আমার প্রতিপালক আমাকে এমন পুত্র দান করুন, যে হবে সেলাকদের একজন। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সেই পুত্র যখন ইবরাহিমের সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন সে বলল, হে আমার পুত্র আমি স্বপ্নে দেখেছি যে তোমাকে জবেহ করছি। এবার চিন্তা করে বলো, তোমার অভিমত কী? পুত্র বলল, পিতা আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন। সুতরাং (সেটা ছিল এক বিস্ময়কর দৃশ্য) যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলো, আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি এক মহান কোরবানির বিনিময়ে সেই শিশুকে মুক্ত করলাম। এবং যারা তার পরবর্তীকালে এসেছে তাদের মধ্যে এই ঐতিহ্য চালু করেছি যে (তারা বলবে) সালাম হোক ইবরাহিমের প্রতি, আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই সে আমার মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ৯৯-১১১)
ধৈর্য, অবিচলতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা: শুধু ইসমাঈল (আ.)-এর কোরবানি ও সম্পর্কের ঘটনা থেকেই ধৈর্য ও অবিচলতা এবং ত্যাগ ও আত্মত্যাগের শিক্ষা লাভ করা সম্ভব। তিনি বলেছিলেন, পিতা আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন। (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০২)
আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা রাখা ও সন্তুষ্ট থাকা: আল্লাহ তায়ালার যেকোনো ফায়সালার প্রতি আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট থাকা হচ্ছে তাওহিদের অনেক বড় একটি শাখা। আল্লাহ তায়ালাকে যে চিনতে পেরেছে, আল্লাহর প্রতি যার ভালোবাসা আছে এবং যার মাঝে এই অনুভূতি আছে যে আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন, তার মাঝে কি ‘রিজা বিলকাজা’র (আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকা) গুণ না থেকে পারে
দুর্বল ঈমানদার অসংখ্য মানুষ এই দৌলত থেকে বঞ্চিত। তারা যদি মক্কা ও মদিনায় ইবরাহিম (আ.), ইসমাঈল (আ.) ও হাজেরা (রা.) এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর মোবারক সিরাতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি আবার স্মরণ করে তাহলে তার মাঝে ‘রিজা বিলকাজা’র গুণ উজ্জীবিত না হয়ে পারে না।
বায়তুল্লাহর হিদায়াত ও বরকতসমূহ: আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘বাস্তবতা এই যে মানুষের (ইবাদতের) জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরি করা হয়, নিশ্চয়ই তা সেটি, যা মক্কায় অবস্থিত, (এবং) তৈরির সময় থেকেই সেটি বরকতময় ও সমগ্র জগতের মানুষের জন্য হিদায়াতের উপায়।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬-৯৭) কেউ বায়তুল্লাহর হজ করল অথচ বায়তুল্লাহ যেসব হিদায়াত ও বরকতের কেন্দ্র তা নিয়ে আসতে পারল না, তাহলে তার হজ কেমন হজ হলো? বায়তুল্লাহর প্রধান হিদায়াত হলো তাওহিদ ও একতা। আর তার প্রধান বরকত সম্ভবত শান্তি ও আমানতদারি রক্ষা। ইসলামের ভিত্তিই হলো তাওহিদ ও একতার ওপর। আর ঈমানের মৌলিক শিক্ষা হলো শান্তি বজায় রাখা ও আমানতদারি রক্ষা করা। সুতরাং সে যদি তাওহিদ ও ইত্তিহাদ এবং আমল ও আমানতের সবক না নিয়েই ফিরে আসে তাহলে সে নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করল।
আল্লাহর শাআয়েরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি: শাআয়ের বলা হয় এমন সব কথা ও কাজ এবং এমন সব স্থান ও সময়কে, যা আল্লাহ তায়ালা ইসলাম ও মুসলমানের জন্য নিদর্শন বা প্রতীক নির্ধারণ করেছেন। এগুলো মূলত আল্লাহ তায়ালার কুদরত ও রহমতের নিদর্শন এবং ইসলামের প্রতীক। ইসলামের অনেক প্রতীক রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলোকালামুল্লাহ (কুরআন মাজিদ); বায়তুল্লাহ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো (যেমন হারামের ভূমি, সাফা-মারওয়া, মিনা-মুজদালিফা, আরাফা ইত্যাদি); রাসুলুল্লাহ, আল্লাহর রাসুল (সা.); আল্লাহ তায়ালার সব ইবাদত-বন্দেগি; বিশেষত কলেমা, নামাজ, জাকাত, সাওম, হজ ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা হজের আহকাম ও বিধান বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এসব কথা স্মরণ রেখো। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ যেসব জিনিসকে মর্যাদা দিয়েছেন তার মর্যাদা রক্ষা করবে, তার জন্য এই কাজ অতি উত্তম তার প্রতিপালকের কাছে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩০) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘এসব বিষয় স্মরণ রেখো। আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই উৎসারিত।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩২) শাআয়েরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন হলো ঈমান। আর ইসলামের কোনো শাআয়েরের সামান্যতম অবমাননা কুফর।
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা
বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা ও অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, নিয়মানুবর্তিতা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বায়তুল্লাহর হজকারীরা যখন বায়তুল্লাহর নির্মাতাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা শোনেন যে ‘এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে গুরুত্ব দিয়ে বলি যে তোমরা উভয়ে আমার ঘরকে সেই সব লোকের জন্য পবিত্র করো, যারা (এখানে) তাওয়াফ করবে, ইতিকাফে বসবে এবং রুকু ও সিজদা আদায় করবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৫)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং সেই সময়কে স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহিমকে সেই ঘরের (কাবা) স্থান জানিয়ে দিয়েছিলাম। (এবং তাকে হুকুম দিয়েছিলাম) আমার সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না এবং আমার ঘরকে সেই সব লোকের জন্য পবিত্র রেখো, যারা (এখানে) তাওয়াফ করে, ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় এবং রুকু-সিজদা আদায় করে। (সুরা : হজ, আয়াত : ২৬)
সবচেয়ে বড় পবিত্রতা জীবিকা হালাল হওয়া
এ কথা মনে রাখা জরুরি যে ঈমানের পর সবচেয়ে বড় পবিত্রতা হলো জীবিকা হালাল হওয়া। আয়-উপার্জনে হালাল-হারাম বেছে চলা। জীবিকা হালাল না হওয়ার অপবিত্রতা এমন যে অজু-গোসল দ্বারা যতই পবিত্র করার চেষ্টা করা হোক, তা পবিত্র হয় না। এ থেকে পবিত্রতা লাভের একমাত্র উপায় হলো খাঁটি দিলে তাওবা করা এবং হারাম উপার্জন ত্যাগ করে হালাল পন্থা অবলম্বন করা। পাশাপাশি যেসব মানুষের হক নষ্ট করা হয়েছে তা ফিরিয়ে দেওয়া। উপার্জন যতক্ষণ পবিত্র না হবে, ততক্ষণ দোয়া ও ইবাদত কবুল হবে না। তবে এ অবস্থায় ইবাদত-বন্দেগি ত্যাগ করবে না। কারণ এতে গুনাহ আরো বেশি হবে; বরং ইবাদতকে পরিশুদ্ধ ও কবুল করানোর সব চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম বেছে চলার মনোভাব সৃষ্টি বায়তুল্লাহর সফরের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা মক্কার মুশরিকরাও বায়তুল্লাহ নির্মাণের সময় এই প্রতিজ্ঞা করেছিল যে এর নির্মাণে কোনো হারাম অর্থ মেলাবে না। এ কারণেই অর্থাভাবে হাতিমের অংশটুকু তাদের পক্ষে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ)
পিতা-মাতার আনুগত্য: হজের সৌভাগ্য যেসব সন্তানের হয়েছে, তাদের হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর দৃষ্টান্ত থেকে পিতা-মাতার আনুগত্যের শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যক, যতক্ষণ না পিতা-মাতা ঈমান ও ইসলামের পরিপন্থী কোনো নির্দেশ দেন।
আল্লাহর নির্দেশ পালনে স্বামীর অনুসরণ: হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত হাজেরা (রা.)-এর ঘটনা মুসলিম দম্পতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তা হলো, স্বামী যদি স্ত্রীকে আল্লাহর কোনো নির্দেশ ও নির্দেশনা মান্য করতে আহ্বান জানায়, তবে স্ত্রী তার আনুগত্য করবে। তাকে শাসন ও নির্দয়তা হিসেবে না থেকে আল্লাহর পথে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) খোদাভীরু ও সৎ স্বামীর ব্যাপারে বলেছেন, ‘তুমি ভেবে দেখো, তার কাছে তোমার স্থান কোথায়? কারণ সে-ই তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম।’ একইভাবে স্বামী স্ত্রীর সৎ পরামর্শ মেনে নেবে এবং তার ত্যাগ ও কোরবানির মূল্যায়ন করবে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে নিজের স্ত্রীর জন্য সর্বোত্তম। আমি তোমাদের সবার চেয়ে আমার স্ত্রীদের জন্য উত্তম।’
সন্তানদের ঈমানি তরবিয়ত: ইবরাহিম (আ.) ও হাজেরা (রা.)-এর জীবন থেকে সব পিতা-মাতার এই শিক্ষা লাভ করা উচিত। তাঁরা যেভাবে সন্তানকে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, পিতা-মাতারও উচিত সেভাবে সন্তানকে আল্লাহর আনুগত্য শেখানো। তার হƒদয় সেভাবে প্রস্তুত করা। যেসব পিতা-মাতা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তাদের জানা দরকার যে আসল ভবিষ্যৎ আখিরাত। যে ব্যক্তি তার সন্তানের আখিরাত ধ্বংস করল কিংবা তাদের আখিরাত সাজানোর বিষয়ে কোনো চিন্তাই করল না, সে সন্তানের কোনো অধিকার ও দায়িত্ব পালন করল না। সে হলো অবিচারকারী, আর সন্তান হলো অবিচারের শামিল।
সংকল্পগুলো হাজিদের জন্য: ক. যে চোখ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কাবা দর্শনের তাওফিক দিয়েছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হেরেম দেখিয়েছেন, সেই চোখের হেফাজত করা, চোখের অন্যায় ব্যবহার না করা। ইনশাআল্লাহ। খ. হাদিসে আছে, ‘যে হজ করল এবং সব অশ্লীলতা ও গুনাহর কাজ থেকে বিরত থাকল, সে সদ্যোজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে গেল। তাই আল্লাহ তাআলার কাছে আশা রাখা, তিনি আমার হজ কবুল করেছেন এবং এর বদৌলতে আমাকে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ করেছেন। ইনশাআল্লাহ আমি পাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করব। আল্লাহ না করুন কোনো গুনাহ হয়ে গেলেও তাৎক্ষণিক তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে আবার পবিত্র হয়ে যাব। গ. এই সংকল্প করা যে বিদায় হজের বিভিন্ন স্থানে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে যে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছেন তার সব কিছু মনেপ্রাণে মানব এবং তার ওপর দৃঢ় ও অটল থাকব। ঘ. মনে করতে হবে, হজের যত মর্যাদা ও কল্যাণ আছে, সবই মাবরুর (কবুল) হজের সঙ্গে সংযুক্ত। মাবরুর হজের অর্থ নেক ও পবিত্র হজ। আমার হজটি মাবরুর হলো কি না এটা তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তবে এর একটি বাহ্যিক নিদর্শনও রয়েছে। তা হলো, হজের পর দ্বিনদারি ও ঈমানি অবস্থার উন্নতি হবে। এর অর্থ শুধু নামাজ-রোজার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, নফল ইবাদতের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া, বাহ্যিক বেশভূষা ঠিক হয়ে যাওয়া নয়; এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিজের জীবনে হালাল-হারাম বেছে চলা। হারাম উপার্জন থেকে বিরত থাকা। সততা ও বিশ্বস্ততাকে নিজের প্রতীক হিসেবে ধারণ করা। সব ধরনের খেয়ানত, ধোঁকা ও প্রতারণা এবং জুয়া, সুদ-ঘুষের মতো সব ধরনের নাজায়েজ কাজ, নাজায়েজ লেনদেন এবং সব অন্যায়-অপরাধ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। ঙ. আল্লাহ তায়ালা যখন তাঁর ঘর দেখা ও জিয়ারত করার তাওফিক দিয়েছেন, তখন এই নিয়ামতের মর্যাদা রক্ষা করা। আল্লাহর অনুগ্রহে জান্নাতে প্রবেশ পর্যন্ত তাঁর শোকর আদায় করতে থাকা। আল্লাহ তায়ালা তাওফিক দান করুন। আমিন।
আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের জন্য কী আনবেন: শুধু এবং শুধু যে জিনিসগুলো আনবেন তা হচ্ছে:- ক. উন্নত ও পবিত্র জীবন, যেন আপনার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনও আপনাকে দেখে হজের তামান্না করে এবং নিজেদের জীবনে আপনাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। খ. জমজম, যা ভূপৃষ্ঠে কাওসারের দৃষ্টান্ত। এর ইতিহাস ও অনুপ্রেরণা এক স্বতন্ত্র অধ্যায়। এর বৈশিষ্ট্য, কল্যাণ ও মর্যাদা প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত। গ. মদিনার খেজুর। এর চেয়ে বেশি কিছু আনতে চাইলে কোনো দ্বিনি কিতাব কিংবা হিজাজের তৈরি এমন জায়নামাজ, যার মধ্যে কোনো ছবি, কোনো পবিত্র বস্তুর চিত্র বা কারুকাজ নেই। এসব ছাড়া অন্য কোনো কিছু হারামাইন শরিফাইনের হাদিয়া হতে পারে না। কেননা সৌদির বাজারের জিনিসপত্র সৌদি আরবের নয়। তাহলে তা হারামাইনের হাদিয়া কিভাবে হতে পারে? তা ছাড়া সৌদি আরবের ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, বিশেষত হজ-ওমরাহর মৌসুমে ওই সব লোকের হাতে থাকে, যারা আমাদের আপন নয়, পর। যাদের উদ্দেশ্য শুধুই ব্যবসা।
যে জিনিসগুলো আনবেন না: হিজাজে যেসব জিনিস ইসলাম ও মুসলিম হিজাজের শত্রুদের মাধ্যমে প্রবেশ করেছে তা হিজাজেরও নয়, হারামাইনেরও নয়। এসব জিনিস আপনি কখনো গ্রহণ করবেন না। এমনকি চোখ তুলেও এসবের দিকে তাকাবেন না। নিজের সঙ্গে এসব বস্তু আনার তো প্রশ্নই আসে না। যেমন:- ১. ইসলামবিরোধী সংস্কৃতি ও রেওয়াজ প্রচলনের কোনো কিছু সঙ্গে করে আনবেন না। আপনার বা আপনার দেশের কোনো ত্রুটি ও দুর্বলতা যদি সেখানেও দেখতে পান তাহলে একে ওই ত্রুটির পক্ষে বৈধতার দলিল বানাবেন না। বেপর্দা, নির্লজ্জতা ও ইসলামবিরোধী বেশভূষা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। ২. বর্তমান কোনো কোনো আরবের দুর্বলতা দেখে আরবদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা সঙ্গে করে আনবেন না। আরবের সৎ ও আলেমদের সম্পর্কে তো নয়ই। ৩. সেখানে নামাজের পদ্ধতিগত যে দু-চারটি ভিন্নতা চোখে পড়ে তাও সুন্নাহসম্মত এবং তারও মূল ভিত্তি সুন্নাহ। আর আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করা হয় তারও ভিত্তি সুন্নাহ। উভয় পদ্ধতিই সুন্নাহ ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ জন্য সেখানে কোনো ভিন্ন পদ্ধতি দেখে নিজ দেশের আলেমের প্রতি অনাস্থা নিয়ে আসবেন না যে তাঁরা আপনাকে নামাজের সঠিক পদ্ধতি শিক্ষা দেননি; বরং তাঁরা আপনাকে যা শিখিয়েছেন তাও সঠিক এবং সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। পুরোপুরি সুন্নাহসম্মত। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে সে অনুযায়ী আমল করতে থাকুন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877