শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩১ পূর্বাহ্ন

শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা কেমন আছেন?

শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা কেমন আছেন?

স্বদেশ ডেস্ক:

‘আপনাকে জুমার নামাজ পড়তে হলে আগে আগে মসজিদে আসতে হবে। ৫০ জন হলে আর ঢুকতে দেয়া হবে না।’ কলম্বোর গল হাইওয়ে রোডের পাশে লোয়ার বারাতেল্লি সড়কে অবস্থিত আল হাসাদ মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে জানা গেল এই তথ্য। আরব সাগরের কলম্বোর এই অংশের উপকূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই চারতলার মসজিদে পুরুষ ও মহিলা মিলে হাজার খানেক মুসলমান নামাজ পড়তে পারেন। কিন্তু করোনার দোহাই দিয়ে এখন এই ৫০ এর সীমা বেঁধে দেয়া। জুমার সময় ৫০ জন মুসল্লিকে মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলেও অন্য ওয়াক্তের নামাজে ৪০ জনের বেশি অনুমতি পান না। পুরো কলম্বো জুড়ে থাকা অসংখ্য মসজিদে এই নিয়ম। অবশ্য রাজধানীর বাইরে কোনো বাধাধরা নিয়ম নেই বলে জানান স্থানীয় খাবার হোটেলের মালিক মোহাম্মদ ওয়াদির। শুক্রবার বারাতেল্লি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে দেখা গেল, ৫০ এর কোটা পূরণ হওয়ায় বেশ কয়েকজন মুসল্লিকে ফেরত পাঠাচ্ছে মসজিদের লোকজন। এটাই সরকারের নিয়ম।

বাস ও ট্রেনের মতো গণপরিবহন চলছে, কলম্বোতে আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে, ছোট গ্যালারি দর্শকে পরিপূর্ণ। চলছে অফিস, মার্কেট। ঠাসাঠাসি করে যাত্রী নিয়ে চলছে বাস, খোলা শপিংমল। খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। কিন্তু নিয়মের কড়াকড়ি শুধু মসজিদে। এতে বিরক্ত শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারীর শুরুতে খুবই নাজুক অবস্থার মুখে পড়েছিল লঙ্কার মুসলমানরা। করোনায় শ্রীলঙ্কার কোনো মুসলমান মারা গেলে তার লাশ পুড়িয়ে ফেলা হতো। শ’ খানেক মুসলমানের লাশ এভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এর মধ্যে ছিল ২ মাস বয়সী একটি শিশুও। এরপর সোচ্চার হয় স্থানীয় মুসলমানরা। তাদের তুমুল আন্দোলনের মুখে মুসলমানদের লাশ পুড়িয়ে ফেলার নীতি থেকে সরে আসে মাহেন্দ রাজাপাকসে সরকার। তবে সিংহলী এবং তামিলদের করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া লাশ এখনো পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। হিন্দু ধর্মের তামিলদের অবশ্য কেউ মারা গেলেই পুড়িয়ে ফেলার নিয়মটা শত শত বছর ধরে।

কলম্বোর টুকটুক (বেবী ট্যাক্সি) ড্রাইভার রিজওয়ান জানান, মুসলিমদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা শুরু হলে আমরা পার্লামেন্ট ভবনের সামনে আন্দোলন করতে থাকি। মহিলারা পর্যন্ত হিজাব পরে এই আন্দোলনে নামে। কারণ মুসলমানদের লাশ পোড়ানো তো ইসলাম সম্মত নয়। যদিও করোনার দোহাই দিয়ে আমাদের আন্দোলন করতে নিষেধ করা হয়েছিল। তার মতে, ‘এই আন্দোলনের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা চাপ দেয় লঙ্কান সরকারকে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট সালেহ মোহাম্মদ ইব্রাহিমরা কলম্বো এসে লঙ্কান সরকারকে মুসলমানদের লাশ পুড়িয়ে ফেলতে নিষেধ করেন।’ এরপর আরো বিশ্ব মুসলিম নেতাদের চাপে মুসলমানদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা লঙ্কায় নিষিদ্ধ হয় বলে জানান তিনি। বাংলাদেশের ফুটবলের অতিপরিচিত মুখ ঢাকা আবাহনীতে খেলা এবং পরে আবাহনী, মোহামেডান, লে. শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব এবং বাংলাদেশ পুলিশ দলে কোচিং করানো পাকির আলীও জানান, আন্দোলনের পর বন্ধ করা হয় মুসলমানদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা। বিশেষ করে ২ মাস বয়সী শিশুকে পোড়ানোর পর জনরোষ তীব্র আকার ধারণ করে।

স্থানীয় অনলাইন পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক আহমেদ সোহেল জানান, করোনায় মারা গেছে এই সন্দেহে দুই মাসের শিশুকেও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এটা আসলে ছিল লঙ্কান মুসলমানদের বিপক্ষে রাজাপাকশে সরকারের একটি এজেন্ডা। এই দেশের সব সরকারই মুসলমানদের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু রাজাপাকশে সরকারের বিদ্বেষটা মাত্রাতিরিক্ত। কলম্বোর বাসিন্দা সোহেল ক্ষোভের সাথে জানান, পৃথিবীতে শ্রীলঙ্কাই একমাত্র দেশ যেখানে করোনায় মারা যাওয়া মানুষদের লাশ পোড়ানো হয়েছে। তার পাল্টা প্রশ্ন, ইতালিতে এত লোক করোনায় মারা গেছে, কিন্তু সেখানে তো কোনো লাশ পোড়ানো হয়নি।

মূলত করোনায় মারা যাওয়া দুই মাসের মুসলমান শিশুর বাবা-মায়ের করোনা ছিল না বলে জানান সোহেল। ২০২০ সালে করোনা শ্রীলঙ্কায় হানা দেয়ার পর প্রথম কয়েক মাস চলে মুসলমানদের এই লাশ পোড়ানো। শ্রীলঙ্কার কিছু ডাক্তারও লাশ পোড়ানোর পক্ষে মত দেন। তাদের বক্তব্য, করোনা রোগীর লাশ মাটির ৮ ফুট গভীরে দাফন করা হলেও পানির মাধ্যমে তা ছড়াতে পারে। এরপর মুসলমানদের আন্দোলন তীব্র হলে পিছু হটে সরকার। পরে সিদ্ধান্ত হয় শ্রীলঙ্কার যে অঞ্চলে পানি উঠে না সেই পূর্বাঞ্চলে করোনায় মারা যাওয়া মুসলমানদের লাশ দাফন করতে হবে। এখন এই দেশে করোনায় কোনো মুসলমান মারা গেলে সেই শুষ্ক এলাকায় দাফন করা হয়।

কলম্বোর গল রোডের হোটেল পালাউসে কর্মরত মুসলমান মোহাম্মদ ফোরকান জানান, এক হাজারের মতো মুসলমান মারা গিয়েছিল করোনায়। এখন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাতে করোনায় মারা যাওয়া লোকের সংখ্যা তিন হাজারের মতো। সাংবাদিক সোহেল আরো জানান, মুসলমানদের দ্বিতীয় দফা করোনা টেস্ট করানোর সুযোগ দেয়া হতো না। আমরা যে নিজ উদ্যোগে প্রাইভেট হাসপাতালে করোনা টেস্ট করাব সেই সুযোগও নেই। যা কিছু করবে সরকারই।

২০২০ সালে করোনা শুরু হলে যেসব মুসলমান অন্য রোগে মারা গিয়েছিল তাদেরও করোনা রোগী বলে জানানো হতো। মারা যাওয়ার পর তাদের নমুনা নিয়ে করোনা পরীক্ষা করানো হতো। সেই রিপোর্ট তার পরিবারের কাউকে দেখানো হতো না। শুধু ফোনে জানানো হতো, তোমাদের রোগী করোনা পজিটিভ ছিল । সুতরাং লাশ পোড়ানোর জন্য প্রস্তুত হও। এই তথ্য দেন সোহেল। প্রসঙ্গত, একটি করোনা রোগীর লাশ বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্যাকেটজাত করে দাফনের জন্য শ্রীলঙ্কান ৫০ হাজার রুপি (২০-২২ হাজার টাকা) ব্যয় হয়। কিন্তু পুড়িয়ে ফেললে এত টাকা লাগে না। অনেক গরিব মুসলমানের পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। পরে অন্য মুসলিম দেশ থেকে এসব লাশ দাফনের ব্যয় বহনের আশ্বাস এলে বন্ধ হয়ে যায় লাশ পোড়ানো।

কলম্বো শহরে প্রচুর মুসলমানের উপস্থিতি। রাস্তায় একটু পরপরই দল বেঁধে চলতে থাকা বোরকা পরা মুসলিম মহিলাদের দেখা যাবে। আর মুসলমান পুরুষদের চেনা যায় দাড়ি আর টুপি দিয়ে। দেশটির জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মুসলমান বলে জানান স্থানীয়রা। দেশটির পূর্বাঞ্চলেই মুসলমানদের বসতি বেশি।

শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল। অধিকাংশই ব্যবসায়ী। রফতানির ব্যবসায় তারা করেন। আবার বেশ কিছু মুসলমান ভিক্ষুকও পাওয়া গেল। তারা অবশ্য বয়স্ক। মুসলমানদের অর্থনৈতিক শক্তিটা পছন্দ করছে না বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী সিংহলিরা। তারা খুব হিংসে করে মুসলমানদের। তাদের এই আচরণে মুসলমানরা বেশ সমস্যায় আছে বলে জানান ব্যবসায়ী বোরহান ও ক্রীড়া সাংবাদিক দানিশ আলী। আগের সরকারগুলোর সময় বেশ কয়েকজন মুসলমান মন্ত্রী ছিলেন। সিরিসেনা সরকারের সময় এই সংখ্যা ছিল ৬। কিন্তু রাজাপাকশে সরকারে মুসলমান মন্ত্রী মাত্র একজন। শ্রীলঙ্কা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি অবশ্য মুসলমান। নাম জাসওয়ার ওমর। লঙ্কান মুসলমানদের অন্যতম ব্যবসা বিদেশ থেকে টাইলস আমদানি।

এখন এই ব্যবসা বন্ধ করতে নানা ধরনের শর্তকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার, অভিযোগ সাংবাদিক সোহেলের।
২০১৯ সালে এক মুসলমান কলম্বোর এক গির্জায় বোমা হামলা চালালে প্রচুর লোক নিহত হয়। এ ঘটনার পর দেশটির মুসলমানরা খুবই চাপে পড়ে যায়। ক্রীড়া সাংবাদিক সোহেল নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন এভাবে, ওই বোমা হামলার পর আমার ১৫ বছরের পুরনো বন্ধু, একেবারে বাল্যকালের বন্ধুরা পর্যন্ত আমাকে সন্দেহ করত। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমার কাছ থেকে দূরে থাকত। এখন সেই অবস্থা অবশ্য নেই।

শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের মাতৃভাষা তামিল। বাড়িতে তারা তামিল ভাষায় কথা বলে। তবে সরকারি সিংহলি ভাষাতেও তারা দক্ষ। বেশ কিছু মুসলমানের ভাষা আবার মালয়। মালয়েশিয়ান কিছু মুসলমান এ দেশে এসে থেকে যাওয়ায় তারা মালয় ভাষা ছাড়তে পারেনি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877