শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ফিলিস্তিন সমস্যার ন্যায্য ও স্থায়ী সমাধান চায় চীন বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ১৫ সদস্যের দলে যাদের রাখলেন ওয়াকার দীর্ঘ বিরতি শেষে বলিউডে ফিরছেন প্রীতি জিনতা রোহিঙ্গা ইস্যুতে একসাথে কাজ করবে ঢাকা-ব্যাংকক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী গরমে পোষা প্রাণীর যত্ন দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের সাহারা মরুভূমির গরমের মতো অনুভূত হচ্ছে : সরকারকে দায়ী করে রিজভী থাইল্যান্ড সফরকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাইলফলক বললেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ৭৩ জনকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
সিটিং সার্ভিস বন্ধ : ওয়েবিল সার্ভিস চালু কেন?

সিটিং সার্ভিস বন্ধ : ওয়েবিল সার্ভিস চালু কেন?

মো: তোফাজ্জল বিন আমীন :

জীবিকার তাগিদে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে বাসে চড়ে। ঢাকার একাধিক রুটে অসংখ্য লোকাল, কাউন্টার ও সিটিং বাস সার্ভিস চলাচল করে। পরিবহন মালিক সমিতির ভাষ্যমতে, যাত্রীদের সেবার কথা চিন্তা করেই নাকি তিন ধরনের সার্ভিস চালু করা হয়েছে। বাস্তবে বাসের হেলপার কিংবা ড্রাইভার দ্বারা যাত্রীরা নিগৃহীত হন। এ ধরনের খবর প্রায়ই চোখে পড়ে। ১২ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের লালখানবাজারে বাড়তি ভাড়া নেয়ার প্রতিবাদ করায় এক যাত্রীকে বাসের চালক ও হেলপার বাস থেকে ফেলে দেয়। পরে ৯৯৯ ফোন দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে যাত্রীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এ ঘটনায় চালক ও সহকারীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এ রকম ঘটনা আরো আছে।

ড্রাইভার-হেলপারদের ছোট করা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে অহেতুক অভিযোগ উত্থাপন করা নিবন্ধনের উদ্দেশ্য নয়। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই নিবন্ধনের উদ্দেশ্য। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এমন একটি সময়ে করা হয়েছে যখন নাগরিকরা দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির চাপে দিশেহারা। ব্যয়ের চাপ সামলাতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে বাড়তি ভাড়া ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তাঘাটে হরতাল কিংবা অবরোধ হয়নি, এটা ঠিক। কিন্তু জনগণের প্রতিবাদের সুর হাওয়ায় ভাসছে। যার কিছু নমুনা বাসের মধ্যে দেখা যায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পরই পরিবহন মালিকরা গাড়ি বন্ধ করে দেন। অথচ হরতাল কিংবা অবরোধের মতো কর্মসূচিতেও আমরা গাড়ি চলতে দেখেছি। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার-প্রতি ১৫ টাকা বাড়ায় বিআরটিএ নতুন ভাড়া নির্ধারণ করে। মহানগর এলাকায় বড় বাসের ভাড়া দুই টাকা ১৫ পয়সা, মিনিবাস দুই টাকা পাঁচ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়। মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া আট টাকা, বড় বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা করা হয়। কিন্তু সিটিং, গেটলক ও ওয়েবিল সার্ভিসের গাড়িগুলোর ভাড়া দুই থেকে তিন গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য দেখা দেয়। যাত্রী, চালক ও হেলপার হাতাহাতি থেকে শুরু করে মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে।

১০ নভেম্বর রাজধানীর বাংলামোটর কার্যালয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, রাজধানীতে সিটিং ও গেটলক সার্ভিস থাকবে না। কেউ সিটিং ও গেটলক সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া নিলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু তার এ ঘোষণার পরও রাজধানীতে সিটিং সার্ভিসের নামে ওয়েবিলের অজুহাতে দিগুণ ভাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে।

সরকার ২০০৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন করলেও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে যাত্রীদের স্বার্থ উপেক্ষিত। বাসের ভাড়া বৃদ্ধির সাথে সাথে লেগুনা, হিউম্যান হলার, নছিমন-করিমন, অটো-টেম্পো, অটোরিকশাসহ সব ধরনের যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে। এসব পরিবহনের ৯৮ শতাংশ সিএনজিচালিত হলেও ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে অন্যায়ভাবে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে। অথচ এসব নিয়ে মামলা হওয়ার হার খুবই কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, লালবাগ ট্রাফিক পুলিশ অক্টোবর মাসে দুই হাজার ৪০৬টি মামলা করেছে। কিন্তু বেশি ভাড়া আদায় করার কারণে মামলা হয়নি। এক হাজার ২৬২টি মামলা হয় চলন্ত বাসে যাত্রী উঠানো-নামানো কিংবা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য। এ ছাড়াও লাইসেন্স না থাকা, রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালানো, গাড়ির ফিটনেস না থাকা, ক্রটিপূর্ণ গাড়ি চালানো, পরিবেশ দূষণকারী কালো ধোঁয়ার কারণে মামলা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে (গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) বিআরটি এর ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই হাজার ৬৪৬টি অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানে ১৯ হাজার ১৮টি মামলা হয়। দুই কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে কতগুলো মামলা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই।

পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন প্রণীত হয়। ওই আইনের ৮০ ধারা অনুসারে গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা একটি অপরাধ। এ আইন অমান্য করলে অমান্যকারীকে অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ না থাকায় বাসমালিকরা ওয়েবিল সার্ভিস চালুর নামে যাত্রীদের জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। ওয়েবিলের অজুহাতে বিআরটিএ নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া না নিয়ে উল্টো দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করছে। ওয়েবিলে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ থেকে ২৫ টাকা যখন ছিল তখন বিআরটিএর সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল সাত টাকা।

ওয়েবিল পদ্ধতিতে অতিরিক্ত ভাড়া রাখার অভিযোগ বেশ পুরোনা। আসাদগেট থেকে মহাখালীর দূরত্ব গুগল ম্যাপ অনুসারে ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। যেখানে সর্বোচ্চ ভাড়া ১৫ টাকা হওয়ার কথা সেখানে বিকাশ ও ভিআইপি পরিবহন ভাড়া নেয় ৩০ টাকা। অর্থাৎ নির্ধারিত ভাড়ার দিগুণ। মালঞ্চ পরিবহন ধূপখোলা থেকে সিটি কলেজ পর্যন্ত ৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার দূরত্বে ভাড়া নেয় ৩৩ টাকা। অথচ ৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার দূরত্বে বিআরটিএ নির্ধারিত ২.১৫ টাকা হারে ভাড়া হয় ১৭ টাকা ২০ পয়সা। মালিবাগ থেকে আসাদ গেটের দূরত্ব ছয় কিলোমিটার। অথচ অল্প দূরত্বের মধ্যে লাব্বায়িক, লাভলী ও স্বাধীন পরিবহনের মগবাজার এবং খামার বাড়িতে দুটি চেকিং রয়েছে। ফলে খামারবাড়ি থেকে আসাদগেট পর্যন্ত এক কিলোমিটার পথ যেতে ১৫ টাকা ভাড়া দিতে হয়। গুলিস্তান থেকে শাহবাগের দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার। এ পথে আগে যেসব বাসে ১০ থেকে ২৫ টাকা ভাড়া আদায় করা হতো, এখন সেখানে ১৫ থেকে ৩৫ টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ এ পথে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা। এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে চালক ও হেলপারদের কাছে হেনস্তা হতে হয়।

মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার হলো তার জীবনের নিরাপত্তা। কিন্তু একজন মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় আবার ঘরে ফিরতে পারবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। বছরে প্রায় ২৩ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। তাই সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে যাত্রীদের কল্যাণ সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ভাড়া ব্যবস্থাপনা, যাত্রীদের সাথে বাসচালক-সহকারীদের ভালো ব্যবহার, নারী যাত্রীদের নিরাপত্তা, বাসে ওঠানামায় শৃঙ্খলা ও যাত্রীছাউনি নির্মাণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আইনগতভাবে সিটিং সার্ভিস বা ওয়েবিল সার্ভিস বলে কিছু নেই। এমনকি পারমিটও নেই। কিন্তু পরিবহন মালিকদের সুবিধার জন্য এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় একরকম আর আদায় করা হয় অন্যরকম। ভাড়া নির্ধারণ করা আছে কিলোমিটার হিসাবে। কিন্তু আদায় করা হচ্ছে ওয়েবিল হিসাবে। এ পদ্ধতি যাত্রীদের কল্যাণের জন্য করা হয়নি। সুতরাং ওয়েবিল সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে সংশ্লিষ্ট মহল উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, এমনটিই ভুক্তভোগী যাত্রীদের প্রত্যাশা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877