শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২১ অপরাহ্ন

জলবায়ু সম্মেলন : লজ্জা তাদের ভূষণ নয়

জলবায়ু সম্মেলন : লজ্জা তাদের ভূষণ নয়

ড. মাহবুব হাসান :

পশ্চিমা মিডিয়ার নীতি আদর্শ বোঝা দায়। তারা কখন যে কাকে মাথায় তুলবে, আর কাকে নামাবে, সেই খেলায় মেতে থাকে। জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, সংসদ সদস্য, পরিবেশ অধিকারকর্মী, পরিবেশ গবেষক, লেখক-সাংবাদিক যোগ দিয়েছেন। তারা নানা পরামর্শ, যুক্তি-তর্কের ভেতর দিয়ে পরিবেশের বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের সারিতে নিয়ে আসবেন। আর সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে শত শত ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট প্রতিবাদের ঝাণ্ডা উড়িয়ে অঙ্গীকার পূরণের জন্য ধনী দেশগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছে। পরিবেশবাদী ও পরিবেশ অ্যাক্টিভিস্টরা যে কত বিচিত্রভাবে ওই সম্মেলনের শহরে উপস্থিত হয়েছে, তারও বর্ণনা ও সচিত্র রিপোর্ট দেখেছি আমরা। বাংলাদেশের কোনো পরিবেশ অ্যাক্টিভিস্ট স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো গেছেন কি-না, কোনো মাধ্যমেই তা জানতে পারিনি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অনেক গুরুত্ব পাচ্ছেন সেখানে, সেটা বিবিসির রিপোর্টে পাওয়া গেল। সম্মেলনে তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন, তারও কিছুটা শুনেছি। খুবই ভালো ভালো কথা বলেছেন তিনি। বিশেষ করে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। জলবায়ুর শিকার যেসব দেশ, তাদের হয়ে তিনি বেশ শক্ত-পোক্ত বক্তব্য দিয়েছেন। একটি পত্রিকায় পড়েছি, তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, দেশে যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনার কাজ চলছে, তা বন্ধ করার। অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ হয় ও হবে এমন প্রকল্প তিনি করবেন না। তার এই সিদ্ধান্তকে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাই।

এই করতালির শব্দ আমরা আগেও বহুবার শুনেছি। ২০১৫-এ, প্যারিসে কপ ২৫ সম্মলনে শোনা গিয়েছিল ওই রকম বিপুল করতালির আওয়াজ। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে ওই সম্মেলনে একটি চুক্তি হয়েছিল। ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশগুলো এর মধ্যেই যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গরিব দেশগুলোকে নানান রকম প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণের পদক্ষেপ ছিল। বিশাল অঙ্কের অর্থ দেয়ার অঙ্গীকার করেছিল তারা, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবন মান পুনরুদ্ধারে এবং তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে ক্ষতি পোষাতে পারে। আর ভবিষ্যতে পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, ধনী দেশগুলো তাদের প্রদত্ত হিস্যার অর্থ ছাড় করেনি। তাদের তো টাকার অভাব হয়নি বা তারা অর্থনৈতিক ধসেও পড়েনি। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে তাদের অবদানের গতিও তেমনভাবে কমেনি। তাদের কারণে গোটা পৃথিবীর যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটা তারা স্বীকার করলেই কি তার সমাধান হয়ে যাবে? না হবে না, বন্ধ করতে হবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। ফলে কমে আসেনি পৃথিবীর উষ্ণায়নের মাত্রা। তারা অঙ্গীকার করেছিলেন যে, ২১০০ সালের মধ্যে উষ্ণায়নের মাত্রা কমিয়ে আনবেন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। এখন বলছেন, ২০৬০-এর মধ্যে এ-কাজটা করতে পারবেন। তার মানে এখন সেই মাত্রা কত আছে? আমরা তেমনভাবে কি জানাতে পেরেছি সেই মাত্রার প্রকৃত তথ্য? ওই পরিমাপক যন্ত্রও তাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন আজো। এ রকম নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে চলমান ওই সম্মেলনে। সম্মেলন শুরু হয়েছে ২৯ অক্টেবর, শেষ হবে ১২ নভেম্বর। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে চীন। সে দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্মেলনে সরাসরি নয়, ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও যোগ দেননি সম্মেলনে। অথচ তারাই প্রধানত দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যোগ দিয়েছেন এবং তার ভূমিকা সরব। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তৎপর ছিলেন। অন্যসব দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা অঙ্গীকার পূরণের ব্যাপারে উন্মুখ, এটা বলা যাবে না। তবে, তাদের উপস্থিতি ইতিবাচকই বলতে হবে। সব মিলিয়ে কপ-২৬ সফলতার দিকেই গড়াচ্ছে। তার পরও সন্দেহ বাড়ছে পুরনো অঙ্গীকারের ফান্ড ছাড়করণের ব্যাপারে। কারণ, তারা সীমাবদ্ধতার নানা কারণ দেখানোর পাশাপাশি কোভিড-১৯কেও দায়ী করছেন। শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর কোভিডের ধকলকে ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডবের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বিপর্যস্ত পৃথিবীর কোভিড-উত্তর অর্থনৈতিক দুরবস্থা কতটা অতি দ্রুত পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এসব জটিলতা ও আরো রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচের অতলে হারিয়ে যেতে পারে সম্মেলনের আসল দাবি ও চেহারা।

উত্তর মেরুর বরফ গলতে শুরু করেছে উচ্চমাত্রার উষ্ণায়নের ফলে। সমুদ্রপাড়ের অনেক গরিব দেশও লবণাক্ততার শিকার হয়ে হারাচ্ছে ফসলি জমি ও উৎপাদন, ভূমিধস, বসতিস্থান। আর তারা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ সবই জানা তথ্য। কিন্তু আমরা যা জানি না বা সাধারণ মানুষ যা জানে না, সেটা হলো, উত্তর মেরুর বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন টন মিথেন গ্যাস বরফের ফাটল দিয়ে বাইরে আসছে। সব বরফ যদি গলে যায়, তাহলে একই সাথে আমরা দুই মহাসঙ্কটের মুখে পড়ব। তার একটি সমুদ্রপিঠ স্ফীত হয়ে যাওয়ায় বসবাসের জায়গা ও ফসলি জমি হারানো এবং মিথেনের সর্বনাশা চাপ। মিথেন গ্যাস সূর্যের আলোর তাপ ফিরে যেতে বাধা দেবে। তাতে করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আরো গরম হয়ে যাবে। ফলে বসবাসের জন্য পৃথিবীর কোনো এলাকাই নিরাপদ থাকবে না। যে পরিমাণ বিপর্যয় ঘটে চলেছে পরিবেশের, তার ধকল পৃথিবীর মানুষ সহ্য করতে পারছে না। ক্লাইমেট চেঞ্জের ওই নারকীয় ধকল, পরমাণু বোমার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। ওই গ্রিনহাউজ গ্যাস আমাদের অস্তিত্বই কেবল বিলীন করবে না, একদিন কেয়ামত ডেকে আনবে। এটা ধনী দেশগুলো বোঝে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক চিন্তা সামরিক ক্ষমতায়নের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সংগঠন ন্যাটো, চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়াসহ পরিবেশ বিপর্যয়কারী দেশগুলোকে বুঝতে হবে এই মহাসঙ্কটের স্বরূপ। সামরিক খাতের চেয়ে ক্লাইমেট খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে তাদের। কারণ পৃথিবী মানুষের জন্য। পরমাণু বোমা যেমন পরিবেশ ধ্বংসকারী তেমনি মানব সভ্যতারও। অর্থায়নের জন্য যে চারটি ফান্ড সৃষ্টি করা হয়েছে, সেগুলোতে তাদের অঙ্গীকৃত অর্থ সম্মেলনের পরপরই ছাড়করণ হোক। শুধু কথায় ক্লাইমেট চেঞ্জর রূঢ় বাস্তবতার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কোনো ফল হবে না।

ফান্ডের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না। বাঁচাতে পারছে না গরিব মানুষ, বিশেষ করে উপক‚লবর্তী মানুষদের। ঠেকাতে পারেনি লবণাক্ত সামুদ্রিক জলের আঘাত, যা কেবল সেখানকার ফসলই নষ্ট করছে না, ভূমিরও সর্বনাশ করছে। ফসলি জমি পরিত্যক্ত হচ্ছে। উদ্বাস্তু হচ্ছে তারা। ভূমিধসের ফলে নানা সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে সমাজ-সংসারে।

এ সবই বলেছেন শেখ হাসিনা, জোরালো গলায়। কিন্তু এটা বলেননি যে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে এমন একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনি নির্মাণের জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন এবং সেটা এখনো নির্মিত হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবন ধ্বংস হলেও তিনি সেটা করে ছাড়বেন। অথচ, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের বিরুদ্ধে ‘জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি লাগাতার সংগ্রাম করছে, মিছিল করছে, পুলিশের মার খাচ্ছে। অধ্যাপক ও সাংস্কৃতিক সমাজের যশস্বীরা আন্দোলনে নিগৃহীত হলেও টনক নড়েনি সরকারপ্রধানের। গ্লাসগোতে যাওয়ার আগেও তিনি ওই সব কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থগিতের কোনো বক্তব্য দেননি। জলবায়ু মহাসম্মেলনে বক্তব্য উপস্থানের সময় বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট চালুর শেষপ্রান্তে উপনীত। তবে, মাসখানেক আগে, ২০১০ সালে নেয়া যে ২০-২২টি কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার মধ্য থেকে ১০-১২টি বাতিল করেছেন। কেননা, সেগুলোর নকশা-ডিজাইন গত দশ বছরে প্রণীত হয়নি। ওই দশ বছর ধরে ওই সব প্রকল্পের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। আমরা আশা করতেই পারি, তিনি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করবেন। তিনি পায়রা বন্দরে চালু হওয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রজেক্ট বাতিল করতে পারবেন না। যখন ওই প্রকল্প নেয়া হয় সম্প্রতি, তখন কি ক্লাইমেট নিয়ে গোটা বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশ সোচ্চার ছিলেন না? তার পরও আমরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতাম না, যদি কয়লাটা আমাদের দেশের হতো। বিদেশ থেকে মোটা অঙ্কে কেনা কয়লা ব্যবহৃত হবে ওই প্রকল্পে। তিনি মুখে বলছেন একটা, কাজ করছেন উল্টোটা। এটা গোটা বিশ্বের ধনীদের চারিত্রিক লক্ষণ। পুঁজির মালিকরা এটা করেন, আমরা তো তাদের চুইয়ে পড়া পুঁজির অংশীদারমাত্র। আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

বিশ্বনেতারা প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জোর ভূমিকা নেবেন বলে পুনরায় ওয়াদা দেবেন, আমরা তা জানি। কিন্তু কাজের কাজ ওই করতালির শব্দদূষণই সার হবে। দুই কি তিনটি দেশ বাদে ধনীদের বাদবাকিরা প্যারিস চুক্তির প্রণোদনার অর্থ সহসাই ছাড়বে এমনটা বাস্তব বলে মনে হয় না। যেমনটা অতীতে হয়নি, এবারও তা হবে না।

ফলে গ্লাসগোর কপ-২৬ সম্মেলন কাগজপত্রে সফল বলা যাবে, বাস্তবে তাকে অসফলই বলা উচিত। ধনীরা যেসব অঙ্গীকার করেন, তা তারা পালন করেন না। এটাই আমরা দেখে আসছি। এই ধারা আজকের নয়, বহু পুরনো। কার্বন নিঃসরণের জন্য তারা লজ্জিত বলে কখনোই মনে হয় না। লজ্জা অনুভূতিটা ক্ষমতাসীনদের মনে-মননে ও চেতনায় থাকে বলে মনে হয় না। তারা অঙ্গীকার করতেও বেশি উৎসাহী নয়, যদি সত্যই সেই অঙ্গীকার অতিদ্রুত পূরণ করতে হয়?

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877