স্বদেশ ডেস্ক:
বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন শিথিল হচ্ছে। আট বছর ঝুলে থাকার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে তড়িঘড়ি পাস হওয়া আইনটি সংশোধন করে জেল জরিমানা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে সংশোধন প্রস্তাবটি এখন পাঠানো হবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে।
মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি ৩৪টি ধারা সংশোধনের। তাদের দাবির মুখে আইনের ৯টি ধারার প্রয়োগ স্থগিত রয়েছে। ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি পরিবর্তনে উদ্যোগী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে অন্যতম দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে তিন লাখ টাকা করা। এ অপরাধের মামলা জামিন অযোগ্যই থাকছে। তবে পরিবহন নেতাদের দাবি অনুযায়ী বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করার এবং গাড়ির আকার পরিবর্তনের মামলা জামিনযোগ্য করা হচ্ছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন নেতাদের চাপে আইনটি পরিবর্তন করা হলে সড়ক আরও অনিরাপদ হবে। সবার সম্মিলিত চেষ্টার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একটি গণজাগরণ তৈরি হয়েছিল আইনটির পক্ষে। সে কারণেই আইনটি হয়েছিল।নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আইনটি
সংশোধনের ব্যাপারে মতামত চাওয়া হয়েছে। আমরা মতামত দিয়েছি। তবে আইনের কঠোরতা কমানোর সুযোগ নেই। আগে দেখি কী সংশোধন আসছে। পরে মন্তব্য করব। আমরা চাই, অজামিনযোগ্য ধারা যেন সংশোধন না হয়। কারও দাবির মুখে শাস্তি কমানো যৌক্তিক হবে না। ন্যায্যতা নিশ্চিত করাই জরুরি।
সড়ক আইন ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর কার্যকর করা হয়। তখন থেকেই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আইনটিকে কঠোর ও স্বার্থবিরোধী আখ্যা দিয়ে আন্দোলনে নামেন। আইন সংশোধন করে শিথিলের দাবিতে কর্মবিরতির নামে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। ব্যাপক জনদুর্ভোগের মুখে সরকার আইনের ৯টি ধারার প্রয়োগ স্থগিত রাখে। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো ৩৪টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে সরকারকে কয়েকদফা চিঠি দেয়। তাদের সঙ্গে দুবছর আলোচনার পর সরকার সংশোধনের যে খসড়া প্রকাশ করেছে, তাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবিরই প্রতিফলন বেশি। খসড়াটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলে সংসদে উত্থাপন করা হবে। সেখানে পাস হলে আইনের সংশোধন কার্যকর হবে।
সড়ক পরিবহনে সবচেয়ে আলোচিত ১০৫ ধারায় জরিমানা কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে দ-বিধি ৩০৪(খ) ধারায় চালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর কারাদ-। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছিল। সঙ্গে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। সংশোধনীতে জরিমানা কমিয়ে তিন লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আদালত অর্থদ-ের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন।
আইনের ৪০ ধারা লঙ্ঘন অর্থাৎ গাড়ির আকার আকৃতি পরিবর্তনের অপরাধে ৯৮ ধারা অনুয়ায়ী সর্বোচ্চ তিন বছর জেল এবং সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ধারায় পরিবর্তন না হলেও এ অপরাধকে জামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করা অপরাধে ৯৮ ধারায় মামলাও তা জামিন অযোগ্য। খসড়ায় এ দুটি ধারাকে জামিনযোগ্য করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ধারায় সংঘটিত অপরাধকে আপসযোগ্যও করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে প্রাণহানির ক্ষেত্রে আগের মতোই ১০৫ ধারা জামিন অযোগ্য থাকবে। সড়ক আইনের এই একটি ধারাই জামিন অযোগ্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইনের ৬ ধারায় রয়েছে, পেশাদার চালক হতে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, তিন চাকার বাহনের পেশাদার চালক পঞ্চম শ্রেণি পাস করলে লাইসেন্স পাবেন। বাস ট্রাকের কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজারের ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে পরীক্ষা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন। তাদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত রাখা হয়নি। আইনের ১৪ ও ১৫ ধারা সংশোধন করে কন্ডাক্টরের সঙ্গে সুপারভাইজার পদটি যুক্ত করা হয়েছে। এ পদে নিয়োগপত্র দিতে হবে।
ফিটনেসবিহীন গাড়িকে সনদ দিলে বিদ্যমান আইনের ২৫(২) ধারায় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইন সংশোধন করে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। খসড়ায় বলা হয়েছে- ‘কোনো অবস্থাতেই ত্রুটিপূর্ণ কোনো যানবাহনকে ফিটনেস সনদ প্রদান করা যাবে না’। সনদ দিলে কর্মকর্তার কী শাস্তি হবে তা বলা নেই।
লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে বিদ্যমান আইনের ৬৬ ধারায় ছয় মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। ধারাটি সংশোধন করে জরিমানা সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ধারা ৬৯ অনুযায়ী ভুয়া লাইসেন্স বানালে সর্বোচ্চ দুই বছর জেল এবং অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সংশোধনে ভুয়া বা জাল লাইসেন্সের জন্য অনধিক এক বছরের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাতিল হওয়া লাইসেন্সে গাড়ি চালানোর জরিমানা ২৫ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ১০ হাজার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
যাত্রীবাহী পরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত নিলে বিদ্যমান আইনের ৮০ ধারা অনুযায়ী এক মাস কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। জরিমানা কমিয়ে পাঁচ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া নিলে বিদ্যমান আইনে চালকের লাইসেন্স থেকে এক পয়েন্ট কর্তনের বিধান রয়েছে। তা বাদ দেওয়া হয়েছে খসড়ায়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা ভাড়ায়চালিত গাড়ির মিটারে কারসাজির শাস্তি ছিল ছয় মাসের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। এখন জরিমানা ২৫ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইনের ৮৫ ধারা অনুযায়ী ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্যে জরিমানা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। তা কমিয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে লাইসেন্স থেকে পয়েন্ট কাটার বিধান থাকছে। শব্দ ও বায়ু দূষণকারী গাড়িকে ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান সংশোধন করে পাঁচ হাজার টাকা, অবৈধ পার্কিংয়ে জরিমানা পাঁচ হাজার থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব হয়েছে। পার্কিং দখল করে যাত্রী ও পণ্য ওঠানো-নামানোয় জরিমানা পাঁচ হাজার থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ অপরাধে চালকের লাইসেন্স থেকে এক পয়েন্ট কর্তনের শাস্তি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
ধারা ৮৬ অনুযায়ী সড়কের জন্য ক্ষতিকর ওভারলোডিংয়ে সর্বোচ্চ এক বছর জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গাড়ির মালিক, পণ্য বহনকারী প্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদার ওভারলোডিং করলে সর্বোচ্চ এক বছর জেল বা এক লাখ টাকা জরিমানা হবে। তবে চালক এ অপরাধ করলে সর্বোচ্চ তিন মাস জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে।
আইনের ৮৮ ধারা অনুযায়ী গাড়িতে নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টি করে এমন হর্ন বা যন্ত্রাংশ সংযোজনের শাস্তি তিন মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা। খসড়ায় তা কমিয়ে এক মাসের জেল বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। ৮৯ ধারা অনুযায়ী পরিবেশ দূষণকারী ও ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি চালানোর শাস্তি তিন মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। সংশোধনীর খসড়ায় তা কমিয়ে এক মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে।
অতিরিক্ত পণ্যবাহী বা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে জীবন ও সম্পদের ক্ষতির শাস্তি ৯৮ ধারা অনুযায়ী তিন বছর জেল বা তিন লাখ টাকা জরিমানা। সংশোধনীতে তা অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ধারাটি আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ওভারটেকিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটালেও একই শাস্তি হবে। অন্যান্য শাস্তি কমলেও দুর্ঘটনার পর গাড়ি ভাঙচুরের সাজা বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে সংশোধনীতে। ১০ হাজার টাকা জরিমানা দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।