স্বদেশ ডেস্ক:
দেশে প্রথম ক্রিস্টাল মেথের (আইস) চালান ধরা পড়ে ২০০৭ সালে। এর পর গত ১২ বছরে আর এর খবর পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালে আবারও এ মাদকের চালান জব্দ হয়। রাজধানীতে মেলে আইস কারখানার সন্ধানও। এর পর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আইস জব্দের ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে আইসের চালান বেড়েছে অনেকগুণ, দখল করে নিচ্ছে আরেক মাদক ইয়াবার স্থান। আইস সেবনের শারীরিক প্রতিক্রিয়াও ইয়াবার চেয়ে অনেক বেশি। ভয়ঙ্কর এ মাদকের কারবারে জড়িয়েছে ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানরাও। মাদকটি ইতোমধ্যে মাদকবিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বাহিনী ও সংস্থাগুলোর নতুন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে আইসের কারবারের রিং লিডার হিসেবে কাজ করছে ৮ শীর্ষস্থানীয় মাদককারবারি। বিদেশ থেকে আইস এনে ছড়িয়ে দিচ্ছে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোয়। ওই আটজনের কাছ থেকে আইস নিয়ে মাঠপর্যায়ে বিক্রি করে শতাধিক সিন্ডিকেটের খুচরা কারবারিরা। স্বল্পসময়ে অধিক মুনাফার লোভে ইয়াবাকারবারিদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে আইস কারবারে। বিভিন্ন সময় ছোট বা মাঝারি পর্যায়ের করবারি ধরা পড়লেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে রাঘববোয়ালরা। শীর্ষ আট কারবারির কেউই নিজের কাছে মাদকটি রাখে না। এ কারণে তাদের ব্যাপারে তথ্য থাকলেও প্রমাণের অভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ জোগাড়ের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাদকবিরোধী অভিযানে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকাসহ সারাদেশে গড়ে ওঠা আইসের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে রিং লিডারদের আইনের আওতায় আনার কাজ শুরু হয়েছে। সবশেষ গতকাল শনিবার সাড়ে ৫ কেজি আইসসহ দুই কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এটি এখন পর্যন্ত ধরা পড়া আইসের সবচেয়ে বড় চালান। এগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা।
বিভিন্ন অভিযানের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইসে আসক্তদের অনেকেই বিদেশে পড়ালেখা করতে গিয়ে এ মাদকের জালে আটকা পড়েছেন। পরে দেশে ফিরে মাদকটির নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করেন তারা। একপর্যায়ে তাদের কেউ কেউ এটির কারবারেও জড়িয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সন্তান। অনেককেই গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তবে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চাইছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
মাদকবিরোধী অভিযানে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, মিয়ানমারে প্রতি গ্রাম আইসের দাম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। রাজধানীতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি গ্রাম বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায়। রাতারাতি বিপুল টাকা কামাতে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে আইসের কারবারে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় আইস মূলত অভিজাত শ্রেণির মাদক হিসেবে পরিচিত।
সূত্র জানায়, শুরুর দিকে থাইল্যান্ড থেকে মিয়ানমার হয়ে টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবার রুটেই প্রবেশ করত আইস। তবে এখন মিয়ানমারেই গড়ে উঠেছে আইসের অনেক কারখানা। অনেক সময় ইয়াবার চালানের সঙ্গেও ঢুকে আইস। এ ছাড়া মিয়ানমারের আচার, চকলেট, চা, কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে দেশে ঢুকে পড়ছে আইসের বড় বড় চালান।
২০১৯ সালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আইস তৈরির কারখানার সন্ধান পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। তখন যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তিনি মালয়েশিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনার সময় আইস তৈরি শেখেন। দেশে ফিরে কারখানা গড়ে তোলেন।
গত ২২ আগস্ট রাজধানীর বনানী, বারিধারা, বনশ্রী ও খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের ১০ তরুণ আইসকারবারিকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। এ সময় তাদের কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকার ৫০০ গ্রাম আইস এবং ৫ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া ধনীর সন্তানদের দুজন পশ্চিমা দেশে পড়তে গিয়ে আইসে আসক্ত হন। দেশে ফিরে শুরু করেন আইসের কারবার। মেয়ের জামাই, শাশুড়ি ও শ্বশুর একই সঙ্গে আইসের ব্যবসা করে আসছিল দুই বছর ধরে। দুই মাস আগে প্রথমে শ্বশুর নুরুল হুদাকে রাজধানীর ডেমরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর গত ১৩ অক্টোবর জামাই রবিন ও শাশুড়ি আরাফা আক্তারকে কোটি টাকার আইস ও ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে ডিএনসি।
আইসবিরোধী অভিযানগুলোয় নেতৃত্ব দেওয়া ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উত্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান আমাদের সময়কে বলেন, দুটি চক্রের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। সেসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের রূপরেখা তৈরি করছি।
ইয়াবা উৎপাদনের জন্য মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্য বিশেষভাবে আলোচিত। এর উত্তরে চীন, পূর্বে লাওস, দক্ষিণে থাইল্যান্ড। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের অংশ শান রাজ্যে একাধিক সশস্ত্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সক্রিয়। মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানের জন্য গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বিশেষভাবে পরিচিত। বর্তমানে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল এলাকার গভীর জঙ্গলে বিপুল পরিমাণে ইয়াবা উৎপাদিত হয়। তবে এখন শানে ইয়াবার জায়গায় বেড়েছে আইসের উৎপাদন।
৫ কেজি আইসসহ গ্রেপ্তার দুই
গতকাল ভোরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে সাড়ে ৫ কেজি আইসসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিদেশি অস্ত্র এবং গুলিও উদ্ধার করা হয়। দুপুরে কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া খোকন টেকনাফকেন্দ্রিক আইস ও ইয়াবার কারবারে জড়িত একটি সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা। গ্রেপ্তার হওয়া রফিক তার সহযোগী। তারা প্রায় পাঁচ বছর ধরে ইয়াবা কারবারে জড়িত। অধিক মুনাফার আশায় কয়েক মাস ধরে আইসের কারবারে জড়িয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের এতটাই সখ্য গড়ে উঠেছে যে, যদি কোনো চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তা হলে সে চালানের টাকাও তাদের পরিশোধ করতে হয় না। বিদেশি মাদককারবারিরা বাংলাদেশের চোরাকারবারিদের প্রলুব্ধ করতে এ রকম একটি ব্যবসায়িক কৌশল বেছে নিয়েছে। সাধারণত সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার সমুদ্রে নৌপথে মালামাল স্থানান্তর করে চোরাকারবারিরা। এ সময় তারা নিজস্ব সিগন্যাল ব্যবহার করে থাকে।
র্যাব জানায়, খোকন এর আগেও বেশ কয়েকটি আইসের চালান নিয়ে ঢাকায় এসেছে। তার নামে একাধিক মামলাও রয়েছে। মিয়ানমার থেকে আসার পর মাদকের চালান প্রথমে টেকনাফে রাখা হয়। পরে নৌপথ ব্যবহার করে চট্টগ্রামে আনা হয়। চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন যানবাহন ব্যবহার করে চালান রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আসে। সেখান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে।
দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে এই মাদক সিন্ডিকেটের ২০-২৫ জনের নাম পাওয়া গেছে উল্লেখ করে র্যাব মুখপাত্র বলেন, আইস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত টেকনাফে এবং ঢাকায় অনেকের নাম পেয়েছি। সে বিষয়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করব। গুলশান, বনানী, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরকেন্দ্রিক যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, এসব জায়গায় আইস পৌঁছে দেওয়ার জন্যই চালানটি নিয়ে আসা হয়েছিল। চালান পৌঁছে দেওয়ার পরই টাকা সংগ্রহ করত তারা। কিন্তু এর আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে তারা।
তিনি আরও বলেন, খোকন নিয়মিত মিয়ানমারে যেতো। সেখান থেকে চা ও আচারের প্যাকেটে করে আনা হতো আইস। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে অভিনব কৌশল ব্যবহার করত সে। টাকা পরিশোধ করত হুন্ডির মাধ্যমে।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার রফিক অটোরিকশা চালক হিসেবে কাজ করত। মাদক এলে প্রথমে তার বাসায় রাখা হতো। পরে সুযোগমতো অন্য জায়গায় স্থানান্তর করত।