বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৭ অপরাহ্ন

সন্ত্রাসবাদ : পাশ্চাত্যবাদ

সন্ত্রাসবাদ : পাশ্চাত্যবাদ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে বাড়ছে সন্ত্রাসী যত কর্মকাণ্ড। সন্ত্রাস একদিকে যেমন বিশ্বশান্তিকে হুমকির মুখে দাঁড় করে দিয়েছে, অন্য দিকে ধ্বংস করছে সভ্যতার সৌধ। বর্তমান বিশ্বে ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে একাকার করে ফেলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ মানবসভ্যতায় সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে ইসলাম পৃথিবীতে এসেছে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সন্ত্রাসের সাথে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজ গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, এর দ্বারা ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠীকে আতঙ্কিত করে তোলা হচ্ছে এবং বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণার জন্ম দেয়া হচ্ছে।
সন্ত্রাস একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ মতবিরোধপূর্ণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একপ্রকার অসম্ভবই বটে। কারণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা যেকোনো বিষয় বা মতবাদের সংজ্ঞার ভিন্নতা নির্দেশ করে। তাই দেখা যায়, এক গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে যে কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসের মতো নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত, অপর গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে সে কর্মকাণ্ডই স্বাধীনতা কিংবা স্বাধিকার সংগ্রামের মতো মহৎ ও প্রশংসনীয়।

সন্ত্রাস শব্দটি বাংলা ‘ত্রাস’ শব্দ উদ্ভূত যার অর্থ ভয়, ভীতি, শঙ্কা। আর সন্ত্রাস অর্থ হলো, মহাশঙ্কা, অতিশয় ভয়, কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা, অতিশয় শঙ্কা বা ভীতি, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ, ভীতিকর অবস্থা, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক পরিবেশ। সন্ত্রাসের সমার্থক শব্দ হিসেবে সন্ত্রাসবাদ, আতঙ্কবাদ, বিভীষিকাপন্থা, সহিংস আন্দোলন, উগ্রপন্থা, উগ্রবাদ, চরমপন্থা ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে সন্ত্রাস কোনো বিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড নয়। এটি এখন একটি মতবাদে পরিণত হয়েছে। তাই সন্ত্রাসভিত্তিক বা কেন্দ্রিক মতবাদ ও কর্মকাণ্ডকে বোঝাতে সন্ত্রাসবাদ শব্দটি বহুল প্রচলিত। অভিধানে ‘সন্ত্রাসবাদ’ অর্থ লেখা হয়েছে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা-অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠাননীতি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পীড়ন, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক কর্ম অবলম্বন করা উচিত- এই মত। আধুনিক আরবি ভাষায় সন্ত্রাস শব্দের প্রতিশব্দ হলো ‘ইরহাব’। এ শব্দটি এসেছে ‘রাহবুন’ থেকে যার অর্থ ‘খাফ’ বা ভীত হলো, ভয় পেলো ইত্যাদি। আর ‘ইরহাব’ অর্থ হলো ‘তাখভিফ’ ও ‘তাফজি’, তথা ভীতিপ্রদর্শন, শঙ্কিতকরণ, আতঙ্কিতকরণ। সন্ত্রাসের শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থের ব্যাপারে মতানৈক্য তেমন না থাকলেও এর পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণে ব্যাপক মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। আর এই কারণেই আজ পর্যন্ত সন্ত্রাসের সর্বসম্মত কোনো পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেক মতবাদীই নিজ নিজ বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র এবং দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়নে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাসকেন্দ্রিক আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে দুটি প্রধান দর্শন। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের সমন্বয়ে গঠিত পাশ্চাত্য দর্শন। অপরটি ইসলামী দর্শন। তাই সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ উভয় দর্শন থেকে প্রদত্ত সংজ্ঞাগুলো উল্লেøখ করা হলো। জায়েদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাদি আল মাদখালি বলেন, ‘ইরহাব (সন্ত্রাস) এমন একটি শব্দ বিভিন্ন আঙ্গিকে যার অনেক অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে- অন্যায়ভাবে নিরপরাধ নির্দোষ মানুষকে ভয় দেখানো ও শঙ্কিত করা। কখনো নিরীহ ব্যক্তিদেরকে হত্যার জন্য সীমাহীন ভীতি প্রদর্শন, সুরক্ষিত সম্পদ বিনষ্ট বা লুট, সতী-সাধ্বী নারীর সম্ভ্রমহানি করা। আল-মাওসুআহ আল-আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইরহাব (সন্ত্রাস) হচ্ছে ভীতি সঞ্চারের জন্য বল প্রয়োগ করা অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করা। ‘রাবিতাতুল আলামিল ইসলাম’ পরিচালিত ‘ইসলামী ফিকহ কাউন্সিল’ ১৪২২ হিজরিতে মক্কায় অনুষ্ঠিত ১৬তম অধিবেশনে সন্ত্রাসের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা নির্ধারণ করে- ‘কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র কোনো মানুষের ধর্ম, বুদ্ধিমত্তা, সম্পদ ও সম্মানের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যে শত্রুতার চর্চা করে তাকে সন্ত্রাস বলে।’ এ সংজ্ঞা সব ধরনের নীতিবহিভর্‚ত ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন, ক্ষতিসাধন, অন্যায় ও বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপরাধমূলক হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে একক ও সমষ্টিগতভাবে পরিচালিত যেকোনো ধরনের অন্যায় কর্ম, সশস্ত্র হামলা, চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, রাহাজানি, ভীতিকর ও হুমকিপূর্ণ কাজ এবং লোকজনের জীবন, স্বাধীনতা, নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে, জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে এমন কর্মকাণ্ডকে শামিল করে। তা ছাড়া পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ও জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট বা প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করাও সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য হবে। ১৯৮৯ সালে আরব দেশগুলোর আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ প্রদত্ত সংজ্ঞা হচ্ছে- ‘সহিংসতা সৃষ্টিকারী বা হুমকি-ধমকি প্রদানকারী এমন সব কাজ যা দ্বারা মানবমনে ভীতি-আতঙ্ক, ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি হয়। তা হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, অপহরণ, গুপ্তহত্যা, পণবন্দী, বিমান ও নৌজাহাজ ছিনতাই বা বোমা বিস্ফোরণ প্রভৃতির যেকোনোটির মাধ্যমে হোক না কেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেসব কাজ ভীতিকর অবস্থা ও পরিবেশ, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তা-ও সন্ত্রাস।’ বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার সুসংগঠিত পন্থাই হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই সন্ত্রাসকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে- সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোনো সরকার, বেসরকারি জনগণ বা অন্য যেকোনো অংশকে ভীতি প্রদর্শন বা দমনের জন্য ব্যক্তি বা সম্পদের উপর অবৈধ শক্তি প্রয়োগ বা সহিংস ব্যবহারকে সন্ত্রাস বলা হয়।

যে কর্মকাণ্ড সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জান-মালের ক্ষতিসাধন, দেশ ও সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি, শান্তি ও নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন, স্থাপনা ও স্থাপত্য ধ্বংস এবং সর্বস্তরের নাগরিকদের আতঙ্কিত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে তাকে বলা হয় সন্ত্রাস। মোট কথা- যে কর্মকাণ্ড জনগণের মাঝে ভয়ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে এবং জানমালের ক্ষতি করে সেটাই সন্ত্রাস এবং যে বা যারা এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত তারাই সন্ত্রাসী।

ইসলামী আইনের প্রধান উৎস আল-কুরআনুল কারিমে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ দুইভাবে এসেছে- শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থে। সন্ত্রাসের আরবি প্রতিশব্দ ‘ইরহাব’কে ভিত্তি ধরে শাব্দিক অর্থ হলো- প্রথমত, ‘আল্লাহকে ভয় করা’ অর্থে এর শব্দমূলের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যেমন- আল্লাহ বলেন, ‘মূসার ক্রোধ যখন প্রশমিত হলো তখন সেগুলো তুলে নিলো। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য তাতে যা লিখিত ছিল, এর মধ্যে ছিল পথনির্দেশ ও রহমত।’ অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে বনি ইসরাইল! আমার সেই অনুগ্রহকে তোমরা স্মরণ করো যা দ্বারা তোমাদেরকে অনুগৃহীত করেছি এবং আমার সাথে তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় করো।’ অপর এক আয়াতে উল্লেখ আছে, আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা দুই ইলাহ গ্রহণ করো না; তিনিই তো একমাত্র ইলাহ। সুতরাং আমাকেই ভয় করো।’ মানুষকে ভয় দেখানো বা সন্ত্রস্ত করা অর্থেও ইরহাব শব্দের সরাসরি ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত্র করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জানো না, আল্লাহ তাদেরকে, শত্রুকে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জানো না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ সামান্য পরিবর্তিত রূপে শব্দটি ব্যবহার করে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘সে (মূসা) বলল, তোমরাই নিক্ষেপ করো। যখন তারা (জাদুকররা রজ্জু ও লাঠি) নিক্ষেপ করল তখন তারা লোকের চোখে জাদু করল, তাদেরকে আতঙ্কিত করল এবং তারা একরকমের জাদু দেখাল।’

প্রচলিত অর্থে সন্ত্রাস বলতে যা বোঝায় তা প্রকাশের জন্য ইরহাব শব্দের ব্যবহার কুরআনে পাওয়া যায় না। সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বোঝানোর জন্য কুরআনে ‘ফিতনাহ’ এবং ‘ফাসাদ’ শব্দদ্বয়ের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সিরাত বিষয়ক উর্দু বিশ্বকোষের ‘নুকুশ’-এর প্রসঙ্গে বর্ণনা নিম্নরূপ- পবিত্র কুরআন গভীরভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণা করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু, ঈমান, কায়-কারবার ইত্যাদি যার কারণে হুমকি ও বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয় তা-ই হলো ‘ফিতনা’ এবং যার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, তা-ই হলো ‘ফাসাদ’। আল-কুরআনে ‘ফিতনা’ শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব আয়াতে ‘ফিতনা’কে সন্ত্রাসের কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে প্রদত্ত হলো- আল্লাহকে অস্বীকার করা, তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করা, ইবাদতে বাধা প্রদান ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ফিতনার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তাতে যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে বাধা দান, আল্লাহকে অস্বীকার করা, মসজিদুল হারামে (প্রবেশে) বাধা দেয়া এবং তার বাসিন্দাকে তা থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর কাছে তদপেক্ষা অধিক অন্যায়; ফিতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, নির্যাতন) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অন্যায়।’ দুর্বলের ওপর অত্যাচার করা, তাদের ন্যায্য অধিকার হরণ করা, তাদের ঘরবাড়ি জবরদখল করা এবং তাদের বিভিন্ন পন্থায় কষ্ট দেয়াও ফিতনা। আল্লাহ বলেন, ‘যারা নির্যাতিত হওয়ার পর হিজরত করে, অতঃপর জিহাদ করে এবং ধৈর্য ধারণ করে, তোমার প্রতিপালক এসবের পর, তাদের প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ জবরদস্তিমূলকভাবে সত্যকে দমন করে এবং সত্যগ্রহণ থেকে মানুষকে বাধা দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘ফিরআউন ও তার পরিষদ নির্যাতন করবে এই আশঙ্কায় মূসার সম্প্রদায়ের এক দল ব্যতীত আর কেউ তার প্রতি ঈমান আনেনি। বস্তুত ফিরআউন ছিল দেশে পরাক্রমশালী এবং সে অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ মানুষকে বিভ্রান্ত করা, বিপথে চালিত করা এবং সত্যের বিরুদ্ধে প্রতারণা, ধোঁকা, বিশ্বাসঘাতকতা ও বল প্রয়োগের চেষ্টা করা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি তা হতে তারা পদস্খলন ঘটানোর চেষ্টা প্রায় চূড়ান্ত করেছিল যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে তার বিপরীত মিথ্যা উদ্ভাবন করো; তবেই তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত।’ বিশ্বাসীদের বিপদে ফেলা। আল্লাহ বলেন, ‘যারা বিশ্বাসী নর-নারীদের বিপদাপন্ন করেছে এবং পরে তাওবা করেনি তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে দহন যন্ত্রণা।’ অসত্যের প্রতিষ্ঠা, অসৎ ও অবৈধ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুদ্ধ, হত্যা ও রক্তপাত করা। আল্লাহ বলেন, ‘যদি বিভিন্ন দিক থেকে তাদের বিরুদ্ধে শত্রুদের প্রবেশ ঘটত, অতঃপর তাদেরকে বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত করা হতো, তবে তারা অবশ্য তাই করত, তারা এতে কালবিলম্ব করত না।’ আল-কুরআনুল কারিমে ‘ফাসাদ’ শব্দটি বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব আয়াতে ‘ফাসাদ’ শব্দকে সন্ত্রাসের কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে প্রদত্ত হলো- অন্যায় শাসন ও হত্যাকাণ্ড, দুর্বলদের প্রতি অবিচার ও সম্পদ লুটপাট করা। আল-কুরআন ফিরআউনকে ‘ফাসাদ’ সৃষ্টিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কারণ সে তার প্রজাদের মাঝে শ্রেণী ও বর্ণগত পার্থক্য সৃষ্টি করত এবং স্বৈরাচারী শাসন চালাত, দুর্বলদের ও বিরোধীদের অন্যায়ভাবে হত্যা এবং তাদের সম্পদ লুট করত। আল্লাহ বলেন, ‘ফিরআউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানে অধিবাসীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল করেছিল; তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত থাকতে দিত। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।’ ন্যায়ানুগ পন্থার বিপরীতে বিকৃত পথে জীবন চালানো। প্রাচীনকালের আদ, সামুদ, লুত, মাদায়েনবাসীসহ বিভিন্ন জাতিকে আল-কুরআনে আল্লাহ ‘ফাসাদকারী’ হিসেবে গণ্য করেছেন। কারণ তারা সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠভাবে জীবনযাপনের পরিবর্তে বিকৃত পথে জীবনকে চালিত করেছিল। আল্লাহ বলেন, ‘যারা দেশে সীমালঙ্ঘন করেছিল এবং সেখানে অশান্তি বৃদ্ধি করেছিল। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই তো পুরুষে উপগত হচ্ছ, তোমরাই তো রাহাজানি করে থাকো এবং তোমরাই তো নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে ঘৃণ্য কাজ করে থাকো। উত্তরে তার স¤প্রদায় শুধু এই বলল, আমাদের ওপর আল্লøাহর শাস্তি আনয়ন করো- যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়। সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের ফলে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় তাও ফাসাদ। আল্লাহ বলেন, ‘সে বলল, রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অপদস্থ করে, এরাও এরূপই করবে।’ অন্য স্থানে আল্লাহ বলেন, ‘আর সেই শহরে ছিল এমন ৯ জন ব্যক্তি, যারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করত এবং সৎকর্ম করত না।’

জুলুম, অবিচার ও লুটতরাজের কাজে প্রশাসনিক ক্ষমতার ব্যবহার করা। যে ধরনের শাসন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ক্ষমতাকে মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের পরিবর্তে জুলুম, অবিচার ও লুটতরাজের কাজে ব্যবহার করা হয় তাকে আল-কুরআন ‘ফাসাদ’ নামে অভিহিত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না।’ সন্ত্রাসের মাধ্যমে যারা সমাজে অশান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায় আল-কুরআন তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।’ অন্যায়ভাবে বা পৃথিবীতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল। আল্লাহ বলেন, ‘এ কারণেই বনি ইসরাইলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করার কারণ ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল।’ পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের শাস্তি ও পরিণতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় এটা তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা এবং পরকালে তাদের মহাশাস্তি রয়েছে।’

বিশ্ববাসী ইসলামের ব্যাপক আবেদন থাকা সত্ত্বেও হিংসা ও স্বভাবজাত শত্রুতাবশত অন্য ধর্মাবলম্বীরা বিশেষ করে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা ইসলাম ও মুসলিমদের নামে নানা কুৎসা রটাচ্ছে। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ইসলাম ও এর অনুসারীরা ইসলামবিরোধীদের কাছ থেকে যেসব ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে বর্তমানে সন্ত্রাসকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টাও সেসবের অন্যতম। এক দিকে ইহুদি-খ্রিষ্টান-পৌত্তলিকদের ষড়যন্ত্র অপর দিকে জন্মগতভাবে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভ্রান্তি, এ দুয়ে মিলে ইসলাম আজ পৃথিবীতে ভুলবোঝা ধর্মে’ পরিণত হয়েছে, যেমনটি বলেছেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ মুহাম্মদ কুতুব রহ:।

তবে আশার কথা, মুসলিমরা এখন ধীরে ধীরে তাদের অজ্ঞতা ও ভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করার চেষ্টা শুরু করেছে। সন্ত্রাসের সাথে যে ইসলামের কোনোরকম সম্পর্ক নেই সে কথা আলোচনায় কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে। ইসলামের অবস্থান কুরআন, হাদিস ও রাসূল সা:-এর জীবনাদর্শে চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে। কুরআন, হাদিস ও রাসূল সা:-এর জীবনাদর্শ দ্বারা প্রমাণিত যে, ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, বরং ইসলাম এর চরম বিরোধী। শান্তিকে বিঘ্নিত করে এমন কোনো কর্মকাণ্ডকে ইসলাম সমর্থন করে না, উপরন্তু বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের চিরন্তন নীতি। ইসলাম স্বভাবগত কারণেই কখনো সন্ত্রাস বা বিশ্বশান্তি নষ্ট করে এমন কর্মে উৎসাহ, সমর্থন, অনুমোদন দেয় না। মুসলিম কখনো সন্ত্রাসী হতে পারে না। তাছাড়া গুটিকতক তথাকথিত মুসলিমের কর্ম বিচার করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্ম ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে সম্পৃক্ত করা কখনোই উচিত নয়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877