মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০১:৫৯ পূর্বাহ্ন

কেন চাই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার

কেন চাই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার

সুরঞ্জন ঘোষ :  এখনকার সময়টা বড় কঠিন। খুব নির্মম। কেউ কোনো কথা বললে তার কদর্থ হবেই, কোনো কথা উচ্চারণ করুন, তা যতই সৎ চিন্তা থেকে হোক না কেন, সমালোচনা হবেই। এ জন্য বুদ্ধিমানরা চুপচাপ। কেউ মুখ খুলছেন না, যেচে কেউ গালাগাল খেতে চান না।
তারপরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না রেখে, কারো সম্পর্কে কোনো রূঢ় মন্তব্য না করে, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বর্তমান গণতন্ত্রের কাহিল অবস্থা সম্বন্ধে কিছু কথা বলাই আজকের এই লেখা।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। বছর দুই যেতে না যেতেই দেশ থেকে নির্বাসিত হয় গণতন্ত্র। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনে দেশের রাজনৈতিক আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে নব্বইয়ের শেষ লগ্নে। যে নির্বাচন ব্যবস্থা ক্ষমতাশ্রয়ীদের হাতে অর্থহীন হয়ে পড়েছিল, নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনায় তার পুনরুজ্জীবন ঘটে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে আলোচনা পর্যালোচনার বিষয় এতদিন পর্যন্ত ছিল নিষিদ্ধ তাও প্রাণ ফিরে পায়। আলোচনার মাধ্যমেই তিন জোটের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়।

হতাশ হওয়ার কারণও রয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে যে তিনটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার দু’টি সম্পন্ন হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণে। প্রথমটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে অনুষ্ঠিত না হলেও পরিচালিত হয়েছিল নিরপেক্ষ এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা। এসব নির্বাচনে যারা বিজয়ী হতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই ব্যবস্থাপকদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছেন। ভোটে কারচুপি ও ভোটডাকাতির অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। দেশময় চিৎকার করে বলে বেরিয়েছেন, কারচুপির মাধ্যমে তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ‘সূ কারচুপি’ ‘স্থূল কারচুপি’ ‘ভোট চুরি’ ‘ভোট জালিয়াতি’ প্রভৃতি কথার ফুলঝুরি ছড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। যারা বিজয়ী হলেন তাদের মধ্যে উদারতার এতটুকু প্রকাশ দেখা গেল না। মনে হলো এতদিন ধরে ব্যক্তিগত পারিবারিক বা সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ সম্পর্কে তারা যেসব স্বপ্ন দেখেছেন, তা বৈধ কিংবা অবৈধ পথে বাস্তবায়িত করবেনই।

যারা হেরে গিয়ে তোলপাড় করে ফেললেন তারা ভাবেননি গণতন্ত্রের কথা। ভাবেননি কল্যাণমুখী রাজনীতির কথা। ভাবেননি জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষিত হবে। যারা একদলীয় নির্বাচন এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন করে বিজয়ী হলেন তারা তা ভাবলেন না গণতন্ত্রের কথা। ভাবলেন না গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা। যে জনগণকে ক্ষমতারোহণের সোপান রূপে ব্যবহার করে এতদূর এলেন তাদের কথাও ভাবলেন না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পেয়ে ব্যবহার করলেন নিজেদের জন্য। নিজেদের প্রভাব এবং বৈভব অর্জনের মাধ্যম রূপে। প্রভাব এবং বৈভব যখন প্রধানতম লক্ষ্য হয়ে ওঠে তখন রাজনীতিকরা সর্বক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মনযোগী হয়ে ওঠেন। যেন সমাজের কোনো অংশে স্বাতন্ত্র্যবোধ শক্তিশালী না হয়। বিরোধী দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকেই জন্ম হয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নির্যাতন, নিপীড়ন, উৎপীড়ন, নিগ্রহের কাহিনী। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাজের বিভিন্ন অংশের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে তার অপমৃত্যু ঘটে। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ যাবতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় দলীয়করণের প্রবণতার জন্মও এ লক্ষ্য থেকেই। প্রশাসনের দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, ক্ষেত্রমতে আইন ভেঙে যায়, না হয় আইনের শর্তগুলো দুমড়ে-মুচড়ে এবং দুর্নীতিপরায়ণ সমাজ জীবনের চার দিকে ডালপালা বিস্তার করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ক্ষমতায় থাকাকালীন যে যা অর্জন বা উপার্জন করেছেন তা সংরক্ষণে যেকোনো পন্থায় পুনর্বার ক্ষমতায় আঁকড়ে রাখার মানসিকতা প্রবলতর হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতাকে দখলে রাখতে নিরন্তর চেষ্টা করতে দেখা যায়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রেক্ষাপঠ পর্যালোচনা করলেই এর উত্তর মিলবে।

মানুষের স্মৃতি বড়ই দুর্বল। আমাদের দেশে মনে হয় আরো বেশি ক্ষণস্থায়ী। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শেষপর্বে দেশের পাঁচদলীয়, সাতদলীয় এবং আটদলীয় জোটের মধ্যে যে সমোঝোতা হয়েছে এবং যার ভিত্তিতে এ আন্দোলন সফল হয়েছিল এবং চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন ঘটেছিল তা ভুলতে আমাদের রাজনীতিকদের লেগেছিল মাত্র দেড় দশক; কিন্তু সেই দেড় দশকে এ দেশের বেশ কয়েক শ’ যোজন এগিয়ে গিয়েছিল তাও স্মরণে রাখতে হবে।

কিন্তু গণতন্ত্র মানে জনগণের রাজত্ব এটা অবশ্যই যথার্থ যে, জনগণ গণতন্ত্র চায়। এ বিশ্বাসে যে, গণতন্ত্র তাদের স্বাধীনতা দেবে। সাম্যও দেবে আর দেবে ক্ষমতা। ভোট খুবই মূল্যবান তাদের কাছে। কেন? বাজারে বেচা যায় বলে? না সে জন্য নয়। ভোট তাদের মর্যাদা দেয়, গুরুত্ব দেয়; ক্ষমতাবান করে তোলে। আত্মবিশ্বাসও দিয়ে থাকে। এ বোধ সৃষ্টি হয় যে, রাষ্ট্রশাসনে তাদেরও মতামত আছে এবং সেই মতের দাম রয়েছে। এই বোধটা কম মূল্যবান নয়।

এমনকি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যদি ক্ষমতায় আসে কোনো সরকার তখনো অচিরেই দেখা যায় যে, সে ভারী গণতন্ত্রমনা হয়ে পড়ে। বলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না করে ছাড়ব না। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো গণতন্ত্র গণতন্ত্র করে সেখানকার বেশির ভাগ দেশে কখনো গণতন্ত্র আসে কখনো সামরিক শাসন আসে। তাতে সুবিধাবাদী ও ডিগবাজি খাওয়া এবং ঘন ঘন দল পরিবর্তন করে তাদের কোনো কষ্ট হয় না। গণতন্ত্রের কালে যারা মন্ত্রী ছিলেন সামরিক শাসনকালেও তাদের অনেকেই মন্ত্রী হয়েছেন। বাকিদের ব্যবসা-বাণিজ্য পেশাগত কর্মকাণ্ড সমানে চলতে থাকে। দল ভাঙেন। আমরা বলি ডিগবাজি খেলেন। আসলে এরা ক্ষমতার সুবিধাভোগী। গণতন্ত্রের কথা তাদের বলতে হয় অন্য কথা বললে লোকে শুনবে না বলে। ধনী হতে লড়ছি না; গণতন্ত্রের জন্য লড়ছি এ কথা বলা সম্মানজনক বলে বলেন তারা। জনগণকে আশা দেন- ভাত পাবে কাপড় পাবে গণতন্ত্র পাবে এসো আমার সাথে। ক্ষমতাবহির্ভূ তরাও গণতন্ত্রের কথা বলেন একই কারণে। ক্ষমতার লোভে।

আমাদের দেশে কেউ কেউ গণ-আন্দোলন ভয় পান। জনগণের ভোট দেয়াকে ভয় পান। কিন্তু গণতন্ত্র এত প্রয়োজন কেন ? প্রয়োজন এ জন্য যে, গণতন্ত্র হচ্ছে সে ধরনের সরকার যেখানে মানুষ পরস্পরকে সহ্য করে এবং সাহায্য করে। গণতন্ত্র মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, দাস হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে, মৃত হিসেবে নয়, স্বাধীন হিসেবে। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে ক্রমওয়েল যে বিপ্লব করেছিলেন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সে বিপ্লব পথে একটি আধুনিক পদক্ষেপ। সেই সময়ে একটি বিতর্ক হয়েছিল ওই গণতন্ত্র নিয়েই যাতে ক্রমওয়েল নিজেও অংশ নিয়েছিলেন। প্রশ্নটা ছিল কাদের ভোট থাকা উচিত? কেউ বললেন, তারাই ভোট দেবে, যাদের সম্পত্তি আছে। কেননা সম্পত্তি না থাকলে অঙ্গীকার নেই, অঙ্গীকার না থাকলে দায়িত্বজ্ঞান নেই, দেশপ্রেম নেই ইত্যাদি। তখন সৈনিক একজন উঠে দাঁড়াল, দাঁড়িয়ে বলল- সব মানুষেরই তো জীবন আছে এবং জীবনের চেয়ে বড় সম্পত্তি কি হতে পারে? হ্যাঁ, ওটাই গণতন্ত্রের কথা। মূল কথা, মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ বা সম্পত্তি আর কিছুই নেই, আর সেই সম্পত্তি তো আছে সব মানুষেরই। তাই সব মানুষই সমান মূল্যবান। ধনী-দরিদ্র উঁচু-নিচু নেই। গণতন্ত্র মানুষকে স্বাধীনতা দেয় এবং সবাইকে ভোটের অধিকার দেয়।

রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের দায়িত্ব রাজনীতিকদের। দেশের রাজনীতি সুস্থ হলে অর্থনীতি গতিশীল হয়ে উঠবে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্র সৃজনশীলতায় ভরে উঠবে। সুসম্পর্কের ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়ে সামাজিক জীবন হয়ে উঠবে সৌহার্দ্যপূর্ণ। সব প্রকার হীনম্মন্যতা দূর হবে। সঙ্কীর্ণতা, সা¤প্রদায়িকতা এবং কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে জাতীয় জীবন আলোর রাজ্যে প্রবেশ করবে। এসব ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের সৃষ্টিশীলতাই মুখ্য ভ‚মিকা পালন করবে বলে মনে করি আমরা।

লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রনেতা ও সভাপতি, সাংবিধানিক অধিকার ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877