শনিবার, ২৫ মে ২০২৪, ১০:০৩ অপরাহ্ন

কী শিক্ষা পেল যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে

কী শিক্ষা পেল যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে

আহমদ রফিক :

সংবাদ শিরোনামটি বেশ উপভোগ্য : ‘রাতের আঁধারে কাবুল ছাড়ল যুক্তরাষ্ট্র।’ বলতে হয় একরাশ রাজনৈতিক লজ্জা আর অপমান মাথায় নিয়ে আফগানিস্তানে দীর্ঘ বিশ বছরের যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটাল পেন্টাগন। দুর্ভাগ্য ডেমোক্রেট দলের যে তাদের শাসনামলে এটা ঘটল, যদিও এর সূচনা তৈরি জো বাইডেনের পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে তালেবানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে।

তুলনা টানা যেতে পারে বহু আলোচিত-সমালোচিত ভিয়েতনামে মার্কিনি আগ্রাসন নিয়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনি বর্বরতা গোটা গণতন্ত্রী ও মানবিক বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। রাসেলের মতো শান্তিবাদীরা বিচলিত বোধ করেছিলেন যুদ্ধাপরাধের চরিত্র বিচার করতে গিয়ে। শ্যাডো বিচারালয়ও বসানো হয়েছিল। রাসেল প্রমুখকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে গণহত্যার দায়ে যুদ্ধাপরাধী।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো অসীম ক্ষমতাশালী পরাশক্তির মাথা নোয়ানো তো সহজ নয়। তাই তাত্ত্বিক বিচার তার নিয়মমাফিক শেষ হয়েছিল শান্তিবাদী বিশ্বে নিন্দার ঝড় তুলে। ক্রমান্বয়ে শান্তিবাদীদের ক্ষমতা কমেছে বিশ্ব রাজনীতির কূটচালে। তদুপরি চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্ব তাতে জ্বালানি যোগ করেছে। অন্যদিকে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব প্রগতি বিশ্বের জন্য হয়ে উঠেছে এক স্থায়ী সমস্যা যা প্রগতির অগ্রযাত্রাকে পদে পদে ব্যাহত করেছে- বলতে হয়, এ যেন অন্য এক মিনি শিবির বিভাজন।

এর মধ্যে আফগানিস্তানে অপরিণত পরিবেশে বামপন্থি অভ্যুত্থান ও পরে নজিবুল্লাহ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সেখানে সোভিয়েত সেনার উপস্থিতি দ্বিমাত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে- স্থানিক ও আন্তর্জাতিক। মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গিরা জেহাদের একটা চমৎকার ইস্যু পেয়ে যায়- এদের সংহত ও সংঘবদ্ধ নেতৃত্ব দিতে ছুটে আসে যুদ্ধবাজ মার্কিনিরা। যুদ্ধটা চালায় বিভিন্ন গ্রুপের মুজাহেদিন সম্মিলিতভাবে, তাদের সর্বপ্রকার সামরিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ শেষে কিছুকাল তালেবানি শাসন চললেও এর সুফলভোগী যুক্তরাষ্ট্র।

দুই

সোভিয়েতের বিরুদ্ধে এত বড় সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? মার্কিন পরাশক্তি তার মিত্রশক্তি ও ন্যাটোসহ ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান তছনছে মার্কিনিরা যে উঠেপড়ে লাগে সোভিয়েত বিতাড়ন ও গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রকে নাশ করতে তা এক অন্তহীন যুদ্ধাপরাধের নজির সৃষ্টি করে, নজিবুল্লাহ হত্যা ও সোভিয়েত বিতাড়নের পর তালেবানি শাসন শেষে দীর্ঘ দুই দশকের মার্কিনি শাসন বিচিত্র ঘটনাবলির মাধ্যমে চলে তালেবানি শাসন। শুরুতে ১৯৯৬ থেকে পূর্বাপর এ পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত ছিল চীন-সোভিয়েত তথা রুশ বিরোধিতার উপলক্ষে। অন্যরা যার যার রাজনৈতিক স্বার্থ বিচারে। নিরপেক্ষ আফগানিস্তানকে কট্টর তালেবানি শাসনের প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার দায় তো পুরোপুরি গণতন্ত্রী নামে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।

তারা নিজস্বার্থে কাবুলে তাদের নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকারকে দিয়ে দেশ শাসনের নীতি গ্রহণ করায় দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমত, স্বাধীনচেতা আফগানদের মার্কিন বিরূপতা। দ্বিতীয় তালেবানি রক্ষণশীলতার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণির আফগান নাগরিকদের তালেবান শাসনের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির অভাবে। এমন এক দুর্বিপাকে আফগানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ববিরোধী নীতির কল্যাণে। অবশ্য অন্য ধারার আফগানরা একদিকে সরাসরি আফগানিস্তানে বিদেশি মার্কিন শক্তির সামরিক উপস্থিতির বিরোধী, অন্যদিকে তারা একই সঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদী তালেবানদের বিরোধী। তারা শিক্ষা, আধুনিকতা ও গণতন্ত্রের চর্চায় আগ্রহী ও বিশ্বাসী। বিশেষ করে শিক্ষিত বা পেশাজীবী নারী সমাজ।

বর্তমান তালেবান নেতৃত্ব মার্কিনি চাপের মুখে যাই বলুক না কেন, তারা এই শেষোক শ্রেণির ঘোর বিরোধী। বিশেষভাবে নারী সাংবাদিক-পেশাজীবী ও শিক্ষিতদের। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু হত্যাকা- ও নির্যাতনের ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

তিন

ভিয়েতনাম যুদ্ধে যত না অভিজ্ঞতা, যত না রাজনৈতিক অবমাননা যুক্তরাষ্ট্রের, যত না সমালোচনা বিশ্বব্যাপী, আফগানিস্তানে তালেবানদের হটিয়ে দুই দশক পুতুল সরকার বসিয়ে (যেমন হামিদ কারজাই) যুক্তরাষ্ট্র ততটা প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন না হলেও তুলনায় পরিণামটা শোকাবহ বলতে হয়। সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার পতন ও শিবির বিভাজন বিলুপ্ত হওয়ার কারণে পূর্বোক্ত প্রভেদ, শক্তিশালী বিরোধী শিবির না থাকার কারণে।

কিন্তু আফগানিস্তানে অভ্যন্তরীণ জনপ্রতিক্রিয়া ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠে। বিদেশি পরোক্ষ সামরিক শাসনের চেয়ে স্বদেশি প্রতিক্রিয়াশীলতা যেন সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে থাকে। আফগানিস্তানের এই রাজনৈতিক চরিত্রবদল কী তার স্বদেশ কিংবা গণতন্ত্রী আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে অনাকাক্সিক্ষত হয়ে ওঠে, প্রগতি বিশ্বের জন্য তো বটেই।

আফগানিস্তানের রাজনীতি বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে নাগরিক প্রতিক্রিয়া বিদেশি তথা মার্কিনি শাসনবিরোধী। সে সুযোগ তালেবানদের তাদের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করে, যদিও মানুষ ভোলে না তালেবানদের প্রথম পর্বের শাসনের নিষ্ঠুরতা ও রক্ষণশীলতা, বিশেষ করে কট্টর শরিয়াপন্থি মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে। ওমরের নির্দেশে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন ঐতিহাসিক বুদ্ধমূর্তি ভাঙার ঘটনা গোটা বিশ্ব সমাজকে নাড়া দিয়েছিল।

তাই তালেবানি শাসন নিয়ে আফগান নারী সমাজ যেমন বিচলিত, তেমনি সচেতন নাগরিকরা যথেষ্ট দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছে এবং ভুগছে। এর মধ্যে আইএস-এর বর্বর আবির্ভাব মার্কিনি সেনা প্রত্যাহারের শেষ লগ্নে দুর্যোগ-দুর্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। অনেক মার্কিনি সেনা হতাহতের এবং আফগান সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগের অভিনন্দিত সিদ্ধান্তও তাদের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। দায়টা তাদেরই। আফগান জনতাসহ আন্তর্জাতিক নিন্দা মাথায় নিয়ে তাদের আফগানিস্তান ত্যাগ স্বদেশেও প্রশ্নের ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে মার্কিন সেনা হতাহতের প্রেক্ষাপটে। ভিয়েতনামের তুলনায় আফগানিস্তান তাদের যে শিক্ষা দিয়েছে, তার প্রায় সবটাই তেতো এবং ডেমোক্র্যাট বা বাইডেনেরই নয়, রিপাবলিকান ও ডোনাল্ড ট্রাম্পেটরও প্রাপ্য।

তাদের বিদেশনীতিতে ছিল বহু ভুলভ্রান্তি। ভাবতে অবাক লাগে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন কোন যুক্তিতে তাদের নিযুক্ত সরকারপ্রধান গনিকে তালেবানদের ক্রমান্বয় বিজয়ের কথা জনগণের কাছে চেপে যেতে বলেছিলেন? এ তো দ্বিমুখী প্রতারণা যেমন নিজ সরকারকে বিষপান করতে বলা, তেমনি শত্রু তালেবানের প্রতি উদ্দেশ্যমূলক সমর্থন। আফগান সুধী সমাজের অভিযোগ সঙ্গত যে, মার্কিনি শাসন তাদের তালেবানদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।

তবে এটা ঠিক, মাথায় লজ্জা নিয়ে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত সঠিক, কিন্তু তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসা উচিত ছিল। যারা নিজ সেনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, তারা কীভাবে বিশেষ আফগান গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? আফগানিস্তান অনেক মৃত্যু রক্তের বিনিময়ে যে তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে তা রাজনৈতিক বিচারে ঐতিহাসিক।

বাইডেন তাদের পররাষ্ট্রনীতি বদলের ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থাৎ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে অন্য দেশে আগ্রাসী অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য ডেমোক্র্যাট বাইডেন অভিনন্দনযোগ্য হলেও পরে কোনো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট যে তা বদলে দেবে না, এমন নিশ্চয়তা কোথায়। তবু এটা আফানিস্তানের তাৎক্ষণিক অবদান অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ করেছি, মার্কিনি রাজনৈতিক সমাজে ইতিবাচক নিঃশব্দ রাজনৈতিক পরিবর্তন। বার্নি স্যান্ডার্স তার একটি উদাহরণ।

এখন দেখার বিষয়, কত তাড়াতাড়ি তালেবান সরকার আইএস জঙ্গিদের দমন করতে পারে পশ্চিমা শক্তির সহযোগিতায়। বলা বাহুল্য আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ তার ওপর নির্ভর করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনে দরকার আন্তর্জাতিক সহায়তা। তালেবানরা এ ব্যাপারে নির্ভর করছে চীনের ওপর। আর রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে?

 

আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্রগবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877