বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১১:০৪ পূর্বাহ্ন

আফগানিস্তানে এখন ক্ষমতার লড়াই!

আফগানিস্তানে এখন ক্ষমতার লড়াই!

সুরঞ্জন ঘোষ :

আফগানিস্তান সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে প্রথমে আসে আমেরিকার কথা। আমেরিকা সরকারকে বাদ দিয়ে আফগানিস্তান সম্বন্ধে লেখা যায় না। বর্তমান আফগানিস্তানকে ঘিরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে; সেটিই স্বল্প পরিসরে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি । যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে যত টাকা খরচ করেছে তার ৬০ শতাংশের বেশি খরচ করেছে আফগান সেনা এবং নিরাপত্তাবাহিনী গঠনে। গত বছর পর্যন্ত এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচ ছিল প্রায় আট হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এ বছর বাড়তি আরো ৩৩০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে আফগান সেনাবাহিনীকে।

সেনাবাহিনী এবং পুলিশ মিলিয়ে আফগান নিরাপত্তাবাহিনীর সংখ্যা কাগজকলমে তিন লাখের কিছু বেশি। একটি বিমানবাহিনী তৈরি হয়েছে। একটি কমান্ডো সেনা ইউনিট রয়েছে যাদের দক্ষতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগান সরকার খুবই গর্বিত। এই বাহিনীর ক্যাডেটদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। অথচ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার সাথে ‘শান্তি চুক্তি’ করার পর তালেবান যখন জায়গা দখলের লড়াই জোরদার করল তখন আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্বলতা প্রকাশ পেতে শুরু করে।

মে মাস থেকে তালেবানের শহর দখলের ঝটিকা অভিযান শুরুর পর আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সেই দুর্বলতা কাবুল সরকারের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছিল। অর্থাৎ আফগান সেনাবাহিনী এমনকি কাবুলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে তা নিয়ে আমেরিকানরাও সন্দিহান ছিল। কাবুলসহ সমগ্র আফগানিস্তান এখন তালেবানের দখলে। ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছে।

এখন প্রশ্ন তালেবান কি পারবে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে? তারা কি পারবে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে? তারা কি পারবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে? তারা কি পারবে নারীর স্বাধীনতা, লেখাপড়া করতে দিতে? তারা কি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে? আমরা দেখেছি, ১০২ বছরের ইতিহাসে ১৮ বার পতাকা পরিবর্তন করা হয়েছে দেশটির। আর কতবার পরিবর্তন হবে? গনি সরকার সৈনিকদের ঠিকমতো বেতনভাতা দিতে পারেনি বলে শত শত সৈনিক লড়াই না করেই তালেবানের হাতে অস্ত্র, যানবাহন, রসদ তুলে দিয়ে ইউনিফর্ম খুলে চলে গেছে। তারা তালেবানকে আলিঙ্গন করেছে। অনেকসময় তালেবানরা তাদের পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বাড়িতে চলে যেতে বলেছে। মাসখানেক আগে এক হাজারেরও বেশি সৈন্য দল ত্যাগ করে তাজিকিস্তানে পালিয়ে গেছে।

ঘনিষ্ঠ হচ্ছে কমিউনিস্ট চীন ও সুন্নি তালেবান। তৈরি হয়েছে নতুন সমীকরণ। সেই সাথে রয়েছে আফগানদের জাতিগত বিভেদের সমস্যা। বেশির ভাগ সিপাহি পশতুন জাতিগোষ্ঠীর; কিন্তু সিনিয়র অফিসারদের অনেকে জাতিগত তাজিক। এ নিয়ে একটা রেষারেষি সবসময় রয়েছে। মার্কিন এক জেনারেল হয়তো বলতে চেয়েছেন, আফগান সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার আগেই তাদের ওপর লড়াইয়ের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমেরিকানরা ফিরে যাচ্ছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের বিশ্লেষণে বলেছে, আফগানিস্তানের প্রতিটি নির্বাচন এতটাই সমস্যাসঙ্কুল ছিল যে, প্রতিবারই মার্কিন সরকার চেষ্টা করেছে, নির্বাচনের ফলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগেই যেন তালেবানের সাথে একটা শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিবারই নির্বাচনের কারচুপি এবং সহিংসতা তালেবানের সাথে আলোচনায় বাধা দিয়েছে। আফগানিস্তানের মার্কিন সমর্থিত সরকার এখন কে চালাবে সে ব্যাপারে দুই গ্রুপের মাঝে ব্যাপক বিরোধ দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তানের সহকারী অধ্যাপক ওমর সাদর বলেছেন, মার্কিনিদের সাথে তাদের আফগান মিত্ররাও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইছে । কিন্তু নির্বাচন নিয়ে দু’পক্ষের মাঝে এতটাই দূরত্ব তৈরি হয়েছে যে, তা দ্রুত কমানো না গেলে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। নির্বাচনের দিন সহিংসতার ভয়ে বেশির ভাগ পোলিং স্টেশন বন্ধ ছিল। অর্থাৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুধু কিছু শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ভোক্সের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কাবুলের উচ্চবিত্তদের মাঝে পশ্চিমা লাইফস্টাইলের এক ডলারের কফি জনপ্রিয় হলেও দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের এক দিনের আয় এক ডলারের নিচে। উঁচু দালান এবং বিয়েশাদির জন্য তৈরি করা হলগুলো শহরে উচ্চবিত্তদের নিজেদের জাহির করার পদ্ধতি হলেও তা সে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। সেনাবাহিনীর পাহারায় নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন প্রার্থীরা; যেখানে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয়নি, সেখানে তারা যাননি। আফগানিস্তানের মার্কিন সামরিক অবস্থান কমাতে দীর্ঘমেয়াদে তালেবানরা ক্ষমতা ভাগাভাগিতে কতটা রাজি থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের বেশির ভাগ সরিয়ে ফেলা হলেও স্পেশাল ফোর্সের ছোট একটি অংশ সেখানে রয়ে যাবে।

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আফগানিস্তানের বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সমর্থিত আফগান সরকারের মাঝে। তারা মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের ধারণাগুলোকে ভিত্তি দিতে চাইছেন। গত ১৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্র দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে আফগানিস্তানে অথচ বিপুলসংখ্যক আফগান জনগণের মৌলিক চাহিদাই পূরণ করা হয়নি। আফগানিস্তানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জন্য একটা ব্ল্যাক হোল হয়ে দাঁড়িয়েছে , যা থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া জো বাইডেন সরকার।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের মতো পাথুরে অঞ্চলকে ১৮ বছর চেষ্টার পরেও নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কয়েক মাস আগে আফগান তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং দোহায় তালেবান রাজনৈতিক শাখার প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদার চীন সফরে গেছেন। সেখানে পৌঁছেই উত্তরাঞ্চলীয় তিয়ানজিং শহরে তিনি বৈঠক করেছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সাথে। পাকিস্তানের মাধ্যমে বেশ কিছু দিন ধরেই চীন তালেবানের সাথে তলে তলে যোগাযোগ রক্ষা করেছে। কিন্তু এই প্রথম এত উঁচু মাপের কোনো তালেবান নেতা চীন সফরে গেলেন এবং এই সফর এখন এমন সময়ে, যার কিছুদিন আগেই তালেবান চীনের সীমান্তবর্তী আফগান প্রদেশ বাদাখশানের গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলো কব্জা করেছে। তালেবান নেতার এই সফরের চার দিন আগে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমন্ত্রণ করেছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরায়েশিকে। চেংডু শহরে দুই মন্ত্রীর দীর্ঘ বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে কাজ করবে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আফগানিস্তানে যেকোনো অস্থিতিশীলতার প্রভাব প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানে সরাসরি গিয়ে পড়বে। ফলে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা অত্যন্ত প্রয়োজন।’

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল চীনের ব্যাপারে নীতি। ভারতের দ্যা প্রিন্ট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লাদাখে যখন ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল তখন বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছিল। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, চীনারা ঢাকায় তাদের প্রভাব খাটিয়ে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের পেছনে কাজ করছে। লাদাখের উত্তেজনার মাঝেই চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক ব্রকলিস ইনস্টিটিউটের ফেলো কনস্টানটিনো জেভিয়ার বলেন, ‘দিল্লি এখন ঢাকার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে যেন বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে আসে।’

চীনারা বাংলাদেশকে এই অভয়বাণী দিতে চাইছে যে, তালেবান সরকার যদি আফগানিস্তানে গঠিত হয়েও যায় এবং চীন-পাকিস্তান যদি এই সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রাখে এবং তারা যদি ভারতকে চাপ দিতে চায়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেন ভারতের ছাতার তলায় না এসে নিরপেক্ষ সার্বভৌম অবস্থান নেয় এবং সে ক্ষেত্রে চীন সব রকমেই বাংলাদেশকে প্রটেক্ট করবে, সাহায্য দেবে, আর্থিক সাহায্য তো বটেই। ক‚টনৈতিকভাবেও সাহায্য দিতে পারবে। কিন্তু কথা হলো, বাংলাদেশ যেন ভারতের মুখাপেক্ষী না হয়ে থাকে। সেই তালেবানদের সাথে কথা বলতে যেতে হচ্ছে মোদি সরকারকে। তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল তালেবানদের সাথে আলোচনা করে একটা ‘তালেবানি’ সরকার গঠনের ব্যাপারে মত দিচ্ছেন। আমেরিকা সেনা তুলে নেয়ার পর আবার আফগানিস্তানে ‘তালেবানিকরণ’ হচ্ছে এবং পাকিস্তান সেই প্রক্রিয়ার মদদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। প্রথম দিকে আশঙ্কা থাকলেও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও তালেবানের প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করে ফেলেছেন। আফগানিস্তানের সাথে ভারতের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। এমনকি আফগানিস্তানের সংসদ ভবন পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ভারত তা নির্মাণ করেছে। আফগান রাষ্ট্রপ্রধান হামিদ কারজাইয়ের সময়ে তিনি ঘন ঘন অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং লালকৃষ্ণ আদভানির সাথে দেখা করতেন আর এত বেশি আসতেন যে একবার আদভানি কারজাইয়ের জ্যাকেট দেখে প্রশংসা করায় কারজাই খুশি হয়ে কাবুল থেকে জ্যাকেটের কাপড় এনে ঠিক একই ডিজাইনের জ্যাকেট তৈরি করে উপহার দিয়েছিলেন তাকে। আদভানির জ্যাকেটের মাপ নেয়ার জন্য কারজাই একজন দর্জিকেও সাথে নিয়ে এসেছিলেন। সে ব্যাপারে ভারতকে সাথে নিতে চাইছে আমেরিকা। ভারতকে আমেরিকা বলেছে অবিলম্বে প্রযুক্তিগত একটা আলাদা বিভাগ তৈরি করতে হবে এবং সেখানে জাপান ও আমেরিকার নেতৃত্বে এখনই ভারত-জাপানকে সাথে নিয়ে চীনকে মোকাবেলা করতে হবে। আজ চীন আর আমেরিকার মধ্যে বৈরী সম্পর্ক চলছে। এ ক্ষেত্রে যদি ভারসাম্য রক্ষা না করে ভারত পুরোপুরি আমেরিকার দিকে চলে যায়, তাহলে বিপদ আছে।

সুতরাং ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ এসেছে আর এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশ যেমন আমেরিকার কাছে, তেমনি ভারতের কাছেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হতে পারে, কিন্তু তার যে ‘জিওস্ট্র্যাটেজিক পজিশন’ সেখানে বাংলাদেশের গুরুত্ব অসীম, যার ফলে আজ ভারত ও আমেরিকা দুই পক্ষই বাংলাদেশের সাথে সখ্য বজায় রেখে ‘দায়িত্ব পালন’ করছে।

লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রনেতা। সভাপতি, ‘সাংবিধানিক অধিকার ফোরাম’ কেন্দ্রীয় কমিটি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877