স্বদেশ ডেস্ক:
মানুষ দুনিয়াতে কাউকে কোনো কাজে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তার যোগ্যতা যাচাই করে, যে লোকটা কতটুকু যোগ্য, তার যোগ্যতা যাচাই করার জন্য সার্টিফিকেট দেখে, পড়াশোনা কতটুকু এর জন্য ইন্টারভিউ নেয়। যখন সে ভাবে যে এই লোকটা যোগ্য, তখন তাকে একটা কাজে নিয়োগ দেয়। আর যদি যোগ্যতা না থাকে তাহলে তাকে চাকরিতে নিয়োগ দেয় না।
কিন্তু আল্লাহতায়ালা এতো বড় শক্তিমান সত্তা, আল্লাহতায়ালা মানুষের যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে নয়, আল্লাহ তায়ালা তার অনুগ্রহ ও দয়ার দ্বারা মানুষ থেকে কাজ নেন। অর্থাৎ আমাদের সিস্টেম আর আল্লাহর সিস্টেমের মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
আল্লাহতায়ালা বলেন: إنا عرضنا الأمانة على السماوات والأرض والجبال فأبين أن يحملنها
অনুবাদ- ‘আমি আমানত পেশ করেছিলাম আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বতের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করলো এবং তাতে শঙ্কিত হল। আর তা বহন করে নিলো মানুষ। বস্তুত সে জালেম এবং অজ্ঞ।’
এই আয়াতে আমানতের ব্যপক অর্থ রয়েছে। মুফাসসিরীনে কেরাম বলেছেন, কারো কারো অভিমত এখানে আমানতের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো পবিত্র কুরআন। সেই ব্যখ্যা মোতাবেকই আমি কথা বলবো।
তাহলে আল্লাহ বলেছেন- আমি কুরআনকে পেশ করলাম আসমানের কাছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা যারা এখানে আছি, আমরা আসমানকে অনেক বড় মনে করি, আমাদের থেকে তো আসমান অনেক বড়। আমরা পৃথিবীকে অনেক বড় মনে করি, পাহাড়কে অনেক শক্তিশালী মনে করি।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আসমানকে সম্বোধন করে বললেন, আসমান! তোমাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই, একটা কাজ দিতে চাই। সেই দায়িত্ব হলো, তোমার ওপর কুরআন নাজিল করবো, দেখো তো পারবে কী না?
আল্লাহতায়ালা জমিনের কাছে একিই দায়িত্ব দিতে চাইলেন এমনকি পাহাড়ের কাছেও।
উত্তরে আসমান, জমিন, পাহাড় বললো: হে আল্লাহ, আমরা তো দূর্বল, তোমার কুরআন তো অনেক বড়, অনেক শক্তিশালী। এই কুরআন বহন করার মত যোগ্যতা শক্তি আমাদের নেই, অতএব আমরা অক্ষম।
এরপর আল্লাহতায়ালা এই কুরআনকে পেশ করলেন মানবজাতির কাছে। তাহলে দেখেন আল্লাহ পাক শক্তিশালী, শক্তিওয়ালা বড় জিনিস আসমান, জমিন, পাহাড় যেটা বহন করতে অস্বীকার করলো, অক্ষমতা প্রকাশ করলো, মানুষ তো অনেক দূর্বল, মানুষ কীভাবে পারবে! স্বাভাবিকভাবে মানুষ তো পারার কথা না। কিন্তু আল্লাহতায়ালা মানব সম্প্রদায়ের কাছে এই কুরআন পেশ করলেন।
আল্লাহ বললেন, আমি তোমাদের কাছে এই কুরআন নাজিল করতে চাই, তোমরা কি পারবে?
বিষয়টা বুঝার জন্য আমি একটা উদাহরণ দেই- দশ বছরের একটা বাচ্চাকে বলা হলো: দশ কেজি ওজনের এই ব্যাগটা পাঁচ তলায় উঠাতে পারবে?
সে বলছে- না পারবো না। কিছুক্ষণ পরেই তিন বছরের এক বাচ্চা- যে একটু একটু কথা বলতে জানে- তাকে এটা বলা হলে সে উত্তরে বললো, হ্যাঁ পারবো।
দশ বছরের বাচ্চা বুঝে দশ কেজির ওজনটা কেমন হবে, তাই সে বলেছে আমি তো পারবো না। কিন্তু তিন বছরের শিশু বুঝে না বলেই সম্মতি পোষণ করল।
তো কুরআনের মর্যাদা, কুরআনের ওজন সম্পর্কে আসমান, জমিন, পাহাড়ের জানা ছিলো বলেই তারা এই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলো।
কিন্তু ওই ছোট বাচ্চার মত মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করা হলো— তুমি কি এই কুরআন বহন করতে পারবে? সে না বুঝেই, না জেনেই বলে দিলো যে পারবো।
এই কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা কুরআনে বলেছেন: “إنه كان جهولا ”
মানুষ কুরআন বহন করতে যেই স্বীকৃতি দিলো, সে বললো আমি কুরআন বহন করতে পারবো, সে তো কুরআন সম্পর্কে জাহেল ছিলো। এর মর্যাদা, এর ওজন, এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্য তার জানা নেই। না বুঝেই না জেনেই বলেছে হ্যাঁ আমি পারবো, সে তো জালেম ছিলো।
তো শুরুতেই আমি যে কথাটি বলেছি, আমরা তো চাকরিতে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সময় এমন ব্যক্তিকেই দেই যে যোগ্যতাসম্পন্ন।
কিন্তু আল্লাহ পাক কুরআন দিলেন এমন মানব জাতিকে যে মানুষের ব্যপারে তিনি নিজেই বলেছেন: “إنه كان ظلوما جهولا “।
যার মাঝে কোনো যোগ্যতা নেই এমন মানুষকেই কুরআন দিলেন, মানুষও রাজি হয়ে গেছে কুরআন বহন করতে,
মানুষ যখন রাজি হয়ে গেছে তো আল্লাহ পাকের কুদরতের কারবার এখন শুরু হয়ে গেল।
আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে তুমি রাজি হয়েছো! শুনো আমি এতো বড় শক্তিমান সত্তা, কিছু করতে চাইলে দুনিয়ার কোন আসবাবের প্রয়োজন বোধ করি না, অনেক কিছুর প্রস্তুতি নেওয়া লাগে না, আমি তো কুদরত ওয়ালা, যাই মন চায় করতে পারি।
আল্লাহ পাকের ফায়সালা হয়েছে ফেরাউনেরর মত শক্তিশালী ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন, এই ধ্বংসের জন্য আল্লাহতায়ালার কোন প্রস্তুতি নিতে হয়নি, কোন আসবাবের দিকে তথা বোমা, সৈন্যবাহিনী কিছুই নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, আল্লাহ পাকের ফায়সালা সে ধ্বংস হবে, তিনি চেয়েছেন সে ধ্বংস হবে, ধ্বংস হয়ে গেছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ফায়সালা হয়েছে সায়্যিদুনা ইব্রাহিমকে (আ.) আগুনেই নিরাপদ শান্তিতে রাখবেন, আগুন নেভাবেন না, তো তিনি সেখানেই নিরাপদ ও শান্তিতে ছিলেন। লোকেরা ভাবছিল— তিনি তো পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি নিরাপদ ও শান্তিতে আছেন যেহেতু আল্লাহ এটাই চেয়েছেন।
আমি আমার ভাইদেরকে বুঝানোর জন্য স্বাভাবিকভাবে বলে থাকি আপনি যদি হঠাৎ করে আপনার কোনো বন্ধুর বাড়িতে আগুন লাগার খবর পান, এই খবর শুনে আপনি কী করবেন? বন্ধুকে বাঁচাতে হলে বিভিন্ন জিনিসের উপকরণ লাগবে, ফায়ার সার্ভিসকে কল করবেন, পানির ব্যবস্থা করবেন আরো বিভিন্ন জিনিসের মাধ্যমে আপনার বন্ধুকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।
কিন্তু রাব্বুল আলামিনের ফরমান হলো হে আগুন! তুমি জ্বলতেই থাকো, আমার দোস্ত ইব্রাহিম আগুনেই শান্তিতে থাকবে, ওরা যতো খুশি হোক না কেন, ওরা ভাবতে থাকুক ইব্রাহিম আগুনে পুড়ে যাচ্ছে।
আল্লাহ আগুনকে লক্ষ্য করে বলেন— قلنا يا نار كوني بردا وسلاما على إبراهيم
অনুবাদ- আমি বললাম হে অগ্নি! তুমি ইব্রাহিমের ওপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।
হে আগুন! তুমি জ্বলতেই থাকো কিন্তু পুড়াবে না, আমার দোস্ত ইব্রাহিমের একটা পশমও যেন না পুড়ে।
তো আল্লাহতায়ালা কোন কিছু করতে চাইলে তার কোন কিছুরই প্রয়োজন হয় না, কোন আসবাবের প্রয়োজন হয় না, কোন যোগ্যতার দরকার নাই।
শুনে রাখুন! যার অন্তরে কুরআন নেই আল্লাহতায়ালা তাকে এই আয়াতে জালিম বলেছেন— যত শিক্ষা, যত মেধা, যত যোগ্যতাই থাকুক না কেন, তার ভিতরে কুরআন না থাকলে সে জালিম।
তাই আমার ভায়েরা, আমরা কুরআনের পাশে থাকার চেষ্টা করবো, কুরআন নিয়েই জীবনকে অতিবাহিত করবো,
আমরা যদি কুরআন থেকে দূরে সরে যাই তাহলে আমাদের জিন্দেগী কামিয়াব হবে না, আমরা অন্ধকারে ডুবে থাকবো, আমাদের জীবন আলোকিত হবে না। আমার কবর অন্ধকার হবে, আখেরাত অন্ধকার হবে।
এর বিপরীত যদি আমরা কুরআনকে কলবের ভেতরে, নিজের জিন্দেগীর ভিতরে কুরআনকে নিতে পারি, কুরআন অনুযায়ী চলার চেষ্টা করি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আমার সব অন্ধকারকে আলোতে পরিণত করে দিবেন।
আমার জিন্দেগী আলোকিত হবে, কবর আলোকিত হবে, হাসর আলোকিত হবে, সব জায়গায় কুরআনের আলো নিয়ে চলতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ পাক কুরআনের এক জায়গায় বলেন— نورهم يسعى بين أيديهم وبأيمانهم
অনুবাদ- তাদের আলো তাদের সামনে ও তাদের ডান পাশে ধাবিত হবে।
ইমানওয়ালা, কুরআন ওয়ালা তারা যেখানেই চলবে তাদের সামনে আলো, পিছনে আলো, উপরে আলো, নিচে আলো, ডানে বামে সব জায়গায় আলো, আল্লাহ পুরা মানুষকে নূরান্নিত করে দিবেন। অর্থাৎ তার তো আলো নাই, সে নিজে নুরান্নিত হয়ে যাবে কুরআনের বরকতে।
তাই আজকের এই ইসলাহি মাহফিলে অনুরোধ করবো যদি আমাদের জীবনকে আলোকিত, সফল বানাতে চাই তাহলে কুরআনের বিকল্প নাই, কুরআন ছাড়া আলোকিত হবে না জিন্দেগী।
মুসলমান চাই সে যতো বড় হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রী হোক, ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক কুরআন ছাড়া তার জীবন আলোকিত হতে পারে না।
বিভিন্ন স্কুলের সাইনবোর্ডে লেখা থাকে ‘আলোকিত জীবন’। মানে আলোকিত জীবন বানানোর জন্য স্কুল।
আমি কুরআনের আলোকে বলবো ‘আলোকিত জীবন হতে পারে না কুরআন ছাড়া’। যতো কিছুই পড়ুক না কেন কুরআন না থাকলে তার কিছুই নাই।
হাদিসে এসেছে- ‘যার ভিতরে বিন্দুমাত্র কুরআন নেই সে বিরান ঘরের মতো…’।
তাই ভাইয়েরা! নিজেও কুরআন পড়ুন, কুরআনকে বুকে ধারণ করুন, কুরআন অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের ছেলে মেয়েদেরকেও কুরআনের শিক্ষা দিন, আগে কুরআন শিক্ষা দিন তারপর না হয় ইঞ্জিনিয়ার বানান, ডাক্তার বানান।
নতুবা কেয়ামতের দিন এই সন্তানেরাই আল্লাহর কাছে নালিশ করবে, হে আল্লাহ! আমার মা বাবারাই আমাদেরকে কুরআন শিক্ষা দেয় নাই, দিলে তো আমরা পারতাম…
আল্লাহ সবাইকে কুরআনের আলোয় আলোকিত হওয়ার তৌফিক দান করুক আমীন।
(২৯ আগস্ট ২০২১, রোববার, বাদ মাগরিব উত্তরায় আয়োজিত একটি ইসলাহি মাহফিলে বয়ান রাখেন– জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের সিনিয়র মুহাদ্দিস ও ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানীর (রহ.) খলিফা মুফতি হাফীজুদ্দীন। বয়ানটি শ্রুতিলিখন করেছেন তরুণ আলেম– মুহাম্মদ রাফে)