সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৯:৫৩ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
একজন জ্ঞানসাধকের বিদায়

একজন জ্ঞানসাধকের বিদায়

মাহফুজুর রহমান আখন্দ :

জ্ঞানসাধক প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ ইন্তেকাল করেছেন। ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় রাজশাহী মহানগরীর ফায়ার ব্রিগেড মোড়ের নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। তার ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে জাতি একজন সমাজচিন্তক, রাষ্ট্রচিন্তক এবং দেশপ্রেমিক দার্শনিককে হারাল।

২০০৩ সাল। গবেষণার কাজে আমি বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে তখন নিয়মিত বসি। একদিন স্যার লাইব্রেরিতে ঢুকেই সরাসরি আমার টেবিলে চলে এলেন। আমি ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পরিচয় দিতেই তিনি বলে উঠলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকরা আবার লেখাপড়া করে? বললাম, রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমফিল করার সময় আপনার প্রবন্ধ পড়েছি। ‘ইতিহাসের ধারায় বাংলাদেশ-আরাকান সম্বন্ধ’। খুব সমৃদ্ধ লেখা। স্যার পাশের চেয়ারটা টেনে আমার সামনে বসে আরাকানের অনেক অলিখিত অজানা গল্প শোনালেন। বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়ে ইতিহাসের বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য দেখে মুগ্ধতায় ভরে উঠলো আমার মন।

এবনে গোলাম সামাদকে পাঠ করছি নিয়মিত। বিশেষ করে শিল্পকলাবিষয়ক বইগুলো আমাকে অবাক করেছে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত শিল্পকলার ইতিকথা, ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ইসলামী শিল্পকলা, ২০০৬ সালে প্রকাশিত মানুষ ও তার শিল্পকলা। এ গ্রন্থগুলো শুধু শিল্পকলার ইতিবৃত্ত নিয়েই রচিত নয়, বরং শিল্পকলার বিবরণের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের বিষয় চমৎকারভাবে খোলাসা করেছেন। ধর্ম এবং শিল্পকলাকে একচেতনায় আবদ্ধ করে তিনি পাঠকে আত্মোপলব্ধির দুয়ারে কড়া নেড়েছেন। ধর্ম এবং শিল্প-সংস্কৃতির সম্পর্কটা খুব কাছাকাছি হিসেবেই দেখেছেন এবনে গোলাম সামাদ। সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসের প্রভাব শিল্প-সংস্কৃতিতে সংক্রমিত হয়। তাইতো ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অবস্থাভেদে শিল্প-সংস্কৃতিও রূপ বদল করে থাকে।

শিল্প-সংস্কৃতির মতো নৃতাত্ত্বিক বিষয়েও গভীর জ্ঞানের বিচ্ছুরণ ঘটেছে এবনে গোলাম সামাদের জীবনে। তার পঠন-পাঠনের এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা। তার লিখিত নৃতত্ত্ব বিষয়সমূহ পাঠ করার সময় তাকে একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবেই মনে হয়। বৃক্ষের নৃতত্ত্ব নয়, মানবসমাজের নৃতাত্ত্বিক বিষয়সমূহকে বিশ্লেষণ করেছেন সাবলীল ভাবে। বাংলাদেশের মানব পরিচয় প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, আমরা বলেছি, মানুষকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এরা হলো ককেশয়েড, মঙ্গলয়েড, নিগ্রয়েড এবং অস্ট্রালয়েড। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষকেই স্থাপন করা চলে ককেশয়েড বিভাগে। তবে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের মানুষের উপর বেশ কিছু পরিমাণে মঙ্গলয়েড বিভাগভুক্ত মানুষেরও প্রভাব থাকতে দেখা যায়। নৃতাত্ত্বিক বিষয়ে এগুলো বেশ সাদামাটা আলোচনা হলেও তার গভীর বিশ্লেষণ অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নৃতত্ত্বের প্রথম পাঠ বইটি যেমন নৃতাত্ত্বিক বিষয়ে তার পাণ্ডিত্যের গণ্ডিবিষয়ে ভাবনার জগতে তোলপাড় করে তেমনি বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি বইটিও নৃতাত্ত্বিক যুক্তি-বিশ্লেষণে অন্যরকম এক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। আত্মপরিচয়ের সন্ধানে গ্রন্থটিও নৃতাত্ত্বিক ভাবনায় রসদ জোগায় বৈকি। সব মিলিয়ে মনে হয় হয়তো নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক তিনি।

ইতিহাসের পাঠ এবং পুনর্নির্মাণে তিনি ভীষণ সরস এবং নির্মোহ। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার এবং নির্মোহ বিশ্লেষণ তাকে একজন ইতিহাস গবেষক হিসেবে প্রমাণ করেছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও তার ইতিহাস ব্যবচ্ছেদের পাণ্ডিত্য সত্যি বিস্ময়কর। ইসলামের ইতিহাস, রাজনৈতিক দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, শিল্পকলার ইতিহাস, মানবিক বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা, সর্বোপরি মার্কসবাদসহ রাজনৈতিক বিশ্বের তথ্যবহুল বিশ্লেষণ পাঠক মহলে দারুণভাবে সমাদৃত। এ ক্ষেত্রে তার বাংলাদেশে ইসলাম ও ঐতিহ্য, আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং আরাকান সঙ্কট, বায়ান্ন থেকে একাত্তর, বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি, বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া, শিল্পকলার ইতিকথা, বাংলাদেশের মানুষ ও ঐতিহ্য, বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ গ্রন্থগুলো তার ইতিহাস বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন, পুনঃপাঠ এবং পুনর্নির্মাণের কৃতিত্বে ভূষিত করে।

ধর্মীয় বিশ্বাসে দৃঢ়তার পরিচয় দেন এবনে গোলাম সামাদ। ধর্ম-দর্শন, মুসলিম জাতীয়তাবাদ এবং স্বদেশপ্রেমে তার সুদৃঢ় অবস্থান। ইসলামকে তিনি শুধু একটি ধর্ম হিসেবেই দেখেনি। ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবেই দেখেছেন তিনি। ইসলামের ধর্ম-দর্শনের পাশাপাশি সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনের সামগ্রিক বিষয়ে ইসলামের সমাধানকে একান্তভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- ‘অনেকে বলেন, ধর্মের সাথে রাজনীতিকে যুক্ত করা উচিত নয়। আসলে ইসলামের আরম্ভই হয়েছে মদিনাতে একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে। ইসলামের নবী ছিলেন একজন রণনিপুণ ব্যক্তি ও দক্ষ প্রশাসক। তিনি যেমন আল্লাহর বন্দেগি করেছেন, তেমনি আবার পালন করেছেন সংসার ধর্ম ও একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দায়িত্ব।’ ইসলামের পাশাপাশি প্রচলিত অন্যান্য ধর্ম-দর্শন নিয়ে বিস্তর পড়ালেখা করেছেন প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ। ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের নানাবিধ সংস্কারে এগিয়ে আসা মনীষীরাসহ তাদের গৃহীত কর্মপন্থা নিয়েও যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের এ ক্ষুদ্র সময়ে তার সংস্পর্শে বহুবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সুযোগ হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার। সেমিনার সেম্পোজিয়াম কিংবা অনেক আলোচনা সভাতে তাকে অতিথি করে এনেছি। বক্তৃতা শুনেছি। ব্যক্তিগতভাবে আলাপচারিতা হয়েছে বেহিসেবি। ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি, বিশ্বপরিস্থিতি, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিসহ যখনই যে বিষয় তার সামনে উপস্থাপিত হয়েছে তিনি সহজ-সরল ভাবে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করেছেন। তার মগজটিতে হয়তো বিশ্বের বড় বড় পাঠাগারের গ্রন্থগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবগুলো কম্পিউটারের সফটকপি। চিন্তার জগতে ক্লিক করলেই চলে আসে।

২০২১ সালের ঈদুল ফিতরের আগে তার বাসায় গিয়েছিলাম। তখন তিনি সুস্থ ছিলেন। অবশ্য পরে অসুস্থতার সময় অনেকবার দেখা করেছি। সে সময় দুইজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবী ছিলেন। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন- ইসলামকে সামাজিকভাবে উপস্থাপন করুন। ইসলামের চেয়ে ভালো কোনো সমাজব্যবস্থা পৃথিবীতে নেই। ইসলামকে সামাজিকীকরণ করতে পারলে মুসলিম-অমুসলিম সবাই ইসলামী আদর্শকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে। আর রাজনৈতিকভাবে আদর্শ চরিত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি করুন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়ান, সাধারণ মানুষের সাথে একাকার হয়ে যান। শক্তি অর্জন করুন, যেন কেউ দুর্বল মনে না করতে পারে। তাহলেই ইসলামী আদর্শের বিজয় আসবে।

লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877