বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ অপরাহ্ন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও সতর্কতা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও সতর্কতা

মুঈদ রহমান :

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার স্বার্থে গত এপ্রিল থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের লকডাউন আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু সংক্রমণের মাত্রা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ১ জুলাই থেকে সারা দেশে একযোগে কঠোর লকডাউন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছিল। পরামর্শক কমিটি টানা ১৪ দিনের কঠোর লকডাউনের সুপারিশ করে। এর বিপরীতে ৮ দিনের মাথায় এসে লকডাউন শিথিল করে সরকার। পরে আবার ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সেই ‘কঠোর’ লকডাউন আরোপ করা হয়। তবে এবারেও তা কার্যকর করা যায়নি। মাত্র ৭ দিনের মাথায় এসে পোশাকশিল্প ও কলকারখানা খুলে দেওয়া হয়। অবশ্য দোকানপাট, শপিংমল ও পরিবহণের ওপর বিধিনিষেধ ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ১১ আগস্ট থেকে সবকিছু খুলে দেওয়ার পরও পরিবহণের ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগামী ১৯ আগস্ট থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলবে। পর্যটন এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোও ১৯ আগস্টের পর পুরোদমে চালু হবে। বাকি থেকে গেল কেবল শিক্ষাঙ্গন, একমাত্র খাত যা গত ১৫ মাস ধরে একটানা বন্ধ আছে। গত ৫ মাস ধরে লকডাউনের নামে যা কার্যত হয়েছে, তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার মতো নয়। এ নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে; কিন্তু সরকার খুব একটা মনোযোগী হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশেষজ্ঞ যারা পরামর্শক হিসাবে কাজ করছেন, তারাও অনেকখানিই হতাশ। তবে এ অবস্থায়ও করণীয় সম্পর্কে তারা মতামত দিয়ে যাচ্ছেন।

গত ১৫ মাসের অভিজ্ঞতায় আমরা যে বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম তা হলো, করোনাকে খুব সহসা নির্মূল করা যাবে না। আমাদের উচিত হবে, করোনাকে মেনে নিয়ে কীভাবে এর আক্রমণ থেকে নিজেকে ও অপরকে রক্ষা করা যায়, তার একটা বিহিত করা। সে ক্ষেত্রে একটি বিষয়ই পরিষ্কার হয়েছে যে, আমাদের জীবন প্রক্রিয়া বদলাতে হবে; স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে অক্ষরে অক্ষরে। যেভাবে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হয়েছে; তারপর যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানা হয়, তাহলে এর ভয়াবহতা হবে সাধারণ ভাবনার অতীত। মনে রাখতে হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ছিল-সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের কম হলেই সবকিছু খুলে দেওয়া যাবে। কিন্তু আমরা যে মুহূর্তে সবকিছু সচল করতে যাচ্ছি, সে মুহূর্তে আমাদের দেশে সংক্রমণের হার ২৪ শতাংশের কম নয়।

বাংলাদেশে করোনার আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। গত ১৫ মাসে একদিনের জন্যও কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা যায়নি। আমরা সীমিত আকারে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সরাসরি পাঠদান এবং পাঠ গ্রহণের কাছাকাছি বিকল্প অনলাইন নয়। এটাকে বলা যেতে পারে নিরুপায় বিকল্প। বাস্তব অবস্থা শ্রেণিকক্ষে পঠন-পাঠনের উপযোগী নয়। যে কারণে আমরা অনলাইন ক্লাসে যেতে বাধ্য হয়েছি। সেখানেও বিড়ম্বনা কম নয়। সব শিক্ষার্থীকে আমরা অনলাইনের আওতায় আনতে পারিনি। সুতরাং, শিক্ষার্থীরা অপূরণীয় একটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এর মানসিক চাপ বাংলাদেশের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর মনের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ১৯ আগস্ট থেকে যখন সবকিছুই চালু হবে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া, তখন এ মানসিক চাপের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই সরকারকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে ভাবতে হবে নিশ্চয়ই।

সেদিকে খেয়াল রেখেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং সমমানের পরীক্ষার একটি সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করেছে। নভেম্বরে এসএসসি ও সমমান এবং ডিসেম্বরে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ২৫ আগস্ট পর্যন্ত পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে হবে এবং ৩০ আগস্টের মধ্যে পরীক্ষার ফি জমা দিতে হবে। এসব প্রক্রিয়া এখন অনলাইনের মাধ্যমেই সম্পন্ন করতে হবে। তবে এখানে একটি কথা বলা হয়েছে, যদি করোনার প্রকোপ কমে আসে তবেই পরীক্ষা হবে। কতটা কমলে সেটাকে কমে আসা বলে ধরা হবে- তার কোনো হার নির্দেশ করা নেই। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, যদি সরাসরি পরীক্ষা নেওয়া না যায়, তাহলে ক্রিয়েটিভ অ্যাসাইনমেন্টের সাহায্যে পরীক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হবে; কোনোমতেই ‘অটোপ্রমোশন’ নয়। সরাসরি পরীক্ষা নেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হোক, সেটাই আমরা প্রত্যাশা করি। শিক্ষার্থীদের মনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসুক, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। কেননা, এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪১ লাখের কম নয়।

যদি সরকারের ভাবনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে থাকে, তবে তা পর্যায়ক্রমে করা উচিত। একযোগে সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াটা যথার্থ হবে না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে সচেতন অংশ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার। এ ৮ লাখ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে নিয়ে প্রাথমিক ভাবনাটা করা যেতে পারে। আমাদের যে পরিমাণ টিকার জোগান আছে, তাতে করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করা যায়। এরই মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ৯০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী টিকা গ্রহণ করে ফেলেছেন। কেবল শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিত করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার কাজ অনেকটাই নিরাপদ হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই পাঠদানের পরিবর্তে পরীক্ষাগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কেননা, পাঠদানের ক্ষেত্রে না হলেও পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা হয়। আস্তে আস্তে আমরা পাঠদানে ফিরে যেতে পারব। কিন্তু সমাধানটা অত সহজ ভাবাটা ঠিক হবে না। আগেই বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সচেতন; আবার একইভাবে তারাই সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল ও আবেগপ্রবণ। কোনো শিক্ষার্থীর কোনো ক্ষতি হলে তার প্রতিক্রিয়াটি অনেক সময়ই সীমার মধ্যে রাখা যায় না। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনকে বিপাকে পড়তে হয়। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব চিকিৎসা কেন্দ্রই সহায়তার জন্য পূর্ণাঙ্গ নয়। সেখানেও কিছুটা সংযোজন-সংস্কার প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোই হবে সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজটি সহজ হবে না; কিংবা সংক্রমিত হলে আইসোলেশনের কাজটিও হবে কঠিন। এখানে আইন কিংবা বল প্রয়োগ করে এর সমাধান করা যাবে না। তার জন্য হল প্রশাসনকে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হবে নজরদারি ও মোটিভেশনে। স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে পর্যাপ্ত। কাজটি সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়। একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে গেলে অনেকখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এসব নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে পর্যায়ক্রমে স্কুলগুলো খুলে দিতে হবে।

স্কুলের শিক্ষার্থীরা পরিণত বয়সের নয়। অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক আচরণ তাদের মনঃপুত হয় না। নিজেদের একটি খেয়ালখুশির বিষয় থাকে। সে ক্ষেত্রে মাস্ক কিংবা স্যানিটাইজেশনের কাজটি তাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের একটি বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাদের একটু ভিন্নধারার জীবনে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করা এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজেশনে তাকে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে; আর এক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকাই হবে প্রধান।

যখন সবাই বন্দি, তখন শিক্ষার্থীদের বন্দি থাকাটা মানসিকভাবে তুলনামূলক স্বস্তির। কিন্তু সবাই মুক্ত; কেবল শিক্ষার্থীরাই বন্দি-এটা মানসিকভাবে মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন। কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার বয়সি তারা নয়। জনসংখ্যার এত বড় অংশকে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। করোনা থেকে নিজেকে বা নিজেদের দূরে রাখা নয়; বরং করোনার সঙ্গে চলার মতো করে জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর সেই প্রয়োজনেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877