মো. জাভেদ হাকিম: বরিশাল, দেশের সবচেয়ে বিলাসবহুল নৌযানগুলো চলে এ রুটে। শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা আজকের প্রজন্মের অনেকেরই নৌডুবির ভয়ে পানিপথে তেমন ভ্রমণ করা হয়ে ওঠেনি। তাদের জন্য এ শীতকাল দক্ষিণবঙ্গের সমৃদ্ধ জেলা বরিশাল ঘুরে দেখার মোক্ষম সময়। কারণ শীতে নদী থাকে শান্ত, আকাশে থাকে না ঝড়ের পূর্বাভাস কিংবা হঠাৎ কালবৈশাখীর ঘনঘটা, সুতরাং নৌ-দুর্ঘটনার সুযোগ নেই বললেই চলে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এ রুটের নৌ-ভ্রমণে পরিবারের সব বয়সী সদস্যদের নিয়েই আরামদায়ক ঘোরার আনন্দের ষোলোকলা পূর্ণ করা যাবে। আমিও সে সুযোগে নদীপথে পরিবার নিয়ে বরিশাল জেলার দর্শনীয় জায়গাগুলো থেকে ঘুরে এলাম। আজকের আধুনিক বরিশালের আগের নাম চন্দ্রদ্বীপ। কালের পরিক্রমায় সেদিনের চন্দ্রদ্বীপই আজকের বরিশাল। ‘মুই বরিশাইল্লা পোলা, লঞ্চের পেছন ধইরা ঢাহা আইছি’ ভার্সিটি লাইফে বরিশাল অঞ্চলের বন্ধুদের মুখ থেকে এমন ভাষা শুনতে বেশ লাগত। সেই বেশ লাগা থেকেই মনের কোণে জমা হয়েছিল তাদের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা। আর ভালোবাসা থেকেই এবার যাই তিন কন্যা আর মাকে নিয়ে কীর্তনখোলা নদীর তীরে কবি জীবনানন্দ দাশের বরিশাল শহরে। ঢাকার লালকুঠি ঘাট থেকে বেলা ৩টার ওয়াটার বাসে চড়ে রাত ৯টায় গিয়ে নামি বরিশাল লঞ্চঘাটে। মাঝের কয়েক ঘণ্টা বিলাসবহুল ওয়াটার বাসে কেটেছে বেশ। তিন বছরের ভাগ্নি মাহাদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বোনজামাই ওয়াটার বাস পৌঁছার আগেই লঞ্চঘাটে হাজির। ঘাটে ভেড়ার পর নানু-মামুকে পেয়ে ভাগ্নিও বেশ উৎফুল্ল। অটোতে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সিএমবি ১ নং পুল এলাকায় তাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে যাই। প্রথম দর্শনেই ভালো লাগল ঘাট থেকে বাসা পর্যন্ত যেতে রিকশার কোনো জট না দেখে।
ঘরে গিয়ে সাফসুতর হতে হতেই ডাইনিংয়ে পরিবেশন করা হয় হরেক পদের খাবার। গোগ্রাসে সাবাড় করি বোনের হাতে রান্না করা যত সব ভিন্ন রকমের মজাদার খাবার। বোন আমার বিএসসি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু তাবলিগি বরের বাটে পড়ে এখন সে পুরোদস্তুর রান্নার কারিগর। ঢাবির ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্রী মাহবুবার এতে কোনো খেদ নেই মনে। ওর যখন নেই, তাহলে আমার কষ্ট থেকে লাভ কী বরং তার চেয়ে ঢের ভালো ওদের সঙ্গে আড্ডায় মাতি, অনেক রাত অব্দি জম্পেশ মুহূর্ত কাটিয়ে বিছানায় যাই। ফ্রেশ একটা ঘুমের পরে সকালে জানালা দিয়ে তাকাতেই রোদের তাপে ভড়কে যাই। আমি না হয় বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব, কিন্তু আজকের ঘোরাঘুরির সঙ্গী হবে শিশু, সঙ্গে আমার মা। তাই দিনের প্রথম প্রহর বাসায় কাটিয়ে দুপুরের পর বরিশালের জনপ্রিয় বাহন মাহেন্দ্রতে চড়ে ছুটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী দুর্গাসাগর দীঘি পানে। সুনসান নিরিবিলি পিচঢালা পথে মাহেন্দ্র চলে তার আপন গতিতে। এই প্রথম মাহেন্দ্রতে চড়ার অভিজ্ঞতা, তাও আবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, বেশ মজাই পাচ্ছি। চলতে চলতে একসময় আপন মনে গেয়ে উঠি ‘পিচঢালা ওই পথটাকে ভালো বেসেছি/ তার সাথে এই মনটাকে বেঁধে ফেলেছি।’ দূর থেকেই দেখা গেল জটলা, বুঝতে বাকি রইল না যে এসে গেছি দীঘির কাছাকাছি। দীঘির প্রবেশদ্বারের সাইনবোর্ডে লেখা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল গেট। শেওলা জমে এমন অবস্থা হয়েছে যে, পড়তে বেশ কষ্ট হয়। এমন এক কীর্তিমান মহাপুরুষের নামের সাইনবোর্ডের এমন বেহাল দেখে বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠল, যেন দেখার কেউ নেই। অথচ দীঘিটাকে পুঁজি করে মেলার নামে টাকা কামানোর ফন্দিফিকিরের নেই কোনো কমতি। দীর্ঘশ্বাস নেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। প্রচ- ভিড়ের কারণে পরিবারের সদস্যদের গেটের বাইরে নামাজঘরে বসিয়ে আমি আর ভগ্নিপতি দুর্গাসাগর দীঘির কম্পাউন্ডে ঢুকি। প্রথম দেখায় মন জুড়িয়ে যায়। শান বাঁধানো ঘাট, দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত সবুজের খেলা, স্বচ্ছ টলটলে পানি। তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ দক্ষিণবঙ্গের বৃহত্তম এ দীঘি খনন করান। তার স্ত্রী দুর্গা দেবীর নামে দীঘির নাম রাখেন দুর্গাসাগর। দীঘিটির মাঝখানে ৬০ শতাংশ জমির ওপর দ্বীপ রয়েছে, যা কি না দূর থেকে আসা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। দুঃখের বিষয়, সেখানে যাওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। তথ্যসূত্রে জানা যায়, দীঘিটি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে খনন করা হয়েছিল। রাজা শিবনারায়ণ বাংলারবারো ভূঁইয়াদের মধ্যে একজন ছিলেন। তার স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রমাণস্বরূপ তৎকালে রাজকোষ থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে দীঘিটি খনন করিয়েছিলেন। আবার কারো কারো মতে, প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য এ দুর্গাসাগর খনন করিয়েছিলেন।
তবে যা-ই হোক, সেদিনের খনন করা দুর্গাসাগর আজকের ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম পছন্দের জায়গা। শীতে দুর্গাসাগর পরিযায়ী পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া সারা বছরই দেশীয় পাখির কিচিরমিচির শব্দ দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে। স্থানীয় পর্যটকদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ প্রতিনিয়ত ঘুরতে আসে দুর্গাসাগরের সৌন্দর্য দেখতে। এবার যাই উজিরপুরের গুঠিয়া মসজিদে।
এখানেও উপচে পড়া ভিড়। পাহাড়-জঙ্গলের নিরিবিলিতে ঘুরে বেড়ানো মানুষ আমি, তাই হয়তো এসব জায়গায় ভিড়ের মাত্রাটা একটু বেশিই লাগছে। ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় এড়িয়ে মসজিদের সামনে যেতেই চোখ ছানাবড়া; সুউচ্চ মিনার, দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী, আকর্ষণীয় শান বাঁধানো পুকুর নিয়ে কয়েক একর জমির ওপর গড়া মসজিদটি দেখলে যে কেউ বিমোহিত না হয়ে পারবেন না।
ঘুরতে ঘুরতে সূর্যাস্ত। তাই আমরা মাগরিবের নামাজ আদায়ের জন্য অপেক্ষা করি। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই মসজিদ কমপ্লেক্সে রূপের পসরাও যেন জেঁকে বসে। পুরো মসজিদ আলোয় আলোকিত করা হয়, মসজিদ কমপাউন্ডে তখন অন্য রকম এক আবহ সৃষ্টি হয়। সুমিষ্ট কণ্ঠের ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে মনের মাঝে বেশ তৃপ্তি অনুভব করি। বর্তমানে মসজিদটি মুসলমানদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের পাশাপাশি সব ধর্মের মানুষের জন্যও অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
এবার ফেরার পালা। পরের দিন ঘুরে বেড়াই বরিশাল শহর। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পথ-ঘাট, যানজটের ভয়াবহ চিত্র নেই। এক কথায় বসবাসের জন্য আসাধারণ শহর। এ জন্যই হয়তো কবি জীবনানন্দ দাশ ‘আবার আসিব ফিরে’ কালজয়ী কবিতাটি লিখেছিলেন। বিকেলটা কাটাই কীর্তনখোলা নদীর তীরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ পার্কে, সন্ধ্যায় প্লানেট পার্ক, রাত ৯টা পর্যন্ত সিটি করপোরেশন পার্কে। সঙ্গের শিশুরা পার্কের রাইডে চড়ে বেশ আনন্দ উপভোগ করে। রাত ১০টার মধ্যে ঘরে ফিরি। পরদিন সকাল ৮টার ওয়াটার বাসে মনে গেঁথে থাকার মতো আনন্দময় স্মৃতি নিয়ে ঢাকায় ফিরি।