শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৭:০৮ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
জয়যাত্রায় হেলেনার চাঁদাবাজির জাল

জয়যাত্রায় হেলেনার চাঁদাবাজির জাল

স্বদেশ ডেস্ক: নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর এখন টক অব দ্য কান্ট্রি হেলেনা জাহাঙ্গীর। প্রিন্টিং, অ্যামব্রয়ডারি, প্যাকেজিং, স্টিকার এবং ওভেন গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের এ কর্ণধার পেয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পদও। কিন্তু ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ার পোস্টার ছড়িয়ে পড়ার পর ‘এলোমেলো’ হয়ে যায় জয়যাত্রা টেলিভিশনের প্রধান হেলেনা জাহাঙ্গীরের জীবন। বিতর্কিত কর্মকা-ের জন্য কিছুদিন আগে তাকে হারাতে হয় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদ। এখন গুলশান থানার হাজতে রয়েছেন পুলিশের জেরার মুখে। গতকাল শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে তাকে রাজধানীর গুলশান থানায় হস্তান্তর করে দুটি মামলা করে র‌্যাব-১।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী বলেন, র‌্যাব সদস্যরা বিকালে ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন। র‌্যাবের অভিযোগের ভিত্তিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয়। এ ছাড়া তার বাসা থেকে মদ, ওয়াকিটকি, ক্যাসিনোর সরঞ্জাম ও হরিণের চামড়া উদ্ধারের বিষয়ে বন্যপ্রাণী আইন, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারায় আরও একটি মামলা হয়।
এ ছাড়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় আরেকটি মামলা করার প্রস্ততির কথা জানান র‌্যাব এর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আল মইন। গত রাতে তিনি জানান, মিরপুরে এই ব্যবসায়ীর মালিকাধীন ‘জয়যাত্রা’ প্রতিষ্ঠানে যেসব সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতে মিরপুর থানায় মামলা করা হবে। এই মামলা হবে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে।
আদালত প্রতিবেদক জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গতকাল সন্ধ্যার দিকে হেলেনাকে আদালতে নিয়ে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেখ শাহানুর আলম। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে রাষ্ট্রপক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, আসামি ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে মন্ত্রী, এমপিদের নিয়ে কটূক্তি করেছেন। যারা ফেসবুক ব্যবহার করে তারা বিষয়টি শুনেছে। আসামি সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। একটা চক্র সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এর পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হেলেনা জাহাঙ্গীরের ফেসবুকের একটি বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করেন। সেখানে হেলেনা জাহাঙ্গীল বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাদে আর কাউকে তিনি গোনেন না। আসামিপক্ষে আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর সিআইপি। অযথা লাফ দিয়ে কেন তিনি বিপদে পড়বেন, হেনস্তা হবেন; খ্যাতি, সুনাম নষ্ট করবেন। সরকারের ক্ষতি হবে তার এমন কোনো বক্তব্য নেই।
এর পর আদালত হেলেনা জাহাঙ্গীরের বক্তব্য শুনতে চান। তিনি আদালতকে বলেন, আমি সরকারের লোক। সরকারের সঙ্গেই আছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেই রাজনীতি করি। আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ২৫টা দেশ সফর করেছি। আর আমাকে যে বহিষ্কার করা হয়েছে তার কাগজ আমি এখনো পাইনি। কাজেই আমি এখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গেই আছি। তিনি আরও বলেন, আমি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলিনি। বরং কেউ যদি আমেরিকা, কানাডা থেকে সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালায়, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে আমি তার প্রতিবাদ করেছি। হেলেনাকে হাজির করা উপলক্ষে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কোতোয়ালি জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মুহিত কবীর সেরনিয়াবাত বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আদালতে হাজির করা হবে। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার রাতে গুলশান ২-এর ৩৬ নম্বর রোডে ‘জেনেটিক রিচমন্ড’-এ হেলেনা জাহাঙ্গীরের ফ্ল্যাটে চার ঘণ্টা অভিযান চালায় র‌্যাব-১। পরে রাত ১২টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব সদর দপ্তরে নেওয়া হয়। বাসা থেকে জব্দ করা হয় ১৯ বোতল বিদেশি মদ, একটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া, একটি হরিণের চামড়া, ১৯টি চেক বই ও বিদেশি মুদ্রা, দুটি ওয়াকিটকি সেট এবং ক্যাসিনো (জুয়া) খেলার সরঞ্জাম ৪৫৬টি চিপস। ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিদের সম্মানহানির অপচেষ্টার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার দেখায় র‌্যাব। পরে রাত ২টায় মিরপুরে হেলেনার জয়যাত্রা টেলিভিশনের কার্যালয়ে অভিযানে যায় র‌্যাব। তারা জানায় চ্যানেলটির কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। রাত সোয়া ৪টায় অভিযান শেষে র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাদির শাহ জানান, তদন্ত করে বৈধ কাগজপত্র পাওয়া না গেলে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।
গতকাল বিকালে র‌্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, অপকৌশলের মাধ্যমে নিজেকে ‘মাদার তেরেসা’, ‘পল্লী মাতা’ ও ‘প্রবাসী মাতা’ হিসেবে পরিচিতি পেতে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন উচ্চাভিলাষী হেলেনা জাহাঙ্গীর। তার পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘবদ্ধ চক্রটি এসব ভুয়া খেতাবের অপপ্রচার চালাত। বিভিন্ন দেশি সংস্থা ও ব্যক্তি থেকে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে অর্থ সংগ্রহ করতেন। যা মানবিক সহায়তায় ব্যবহারের চেয়ে তার খেতাব প্রচারে বেশি ব্যবহার করা হতো।
র‌্যাব জানায়, হেলেনা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে অস্ট্রিয়া প্রবাসী আলোচিত বাংলাদেশি নাগরিক সেফুদার নিয়মিত যোগাযোগ ও লেনদেন ছিল। সেফুদা তাকে নাতনি হিসেবে সম্বোধন করতেন। হেলেনা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রেখে নিজের বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেন। প্রায় ১২টি ক্লাবে সদস্যপদ রয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান হেলেনা।
খন্দকার আল মঈন বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মানহানি ও সুনাম নষ্ট করেছেন। এ ছাড়া তিনি মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। তিনি খ্যাতি লাভের আশায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের বিব্রত করতেন। অনৈতিক পন্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে খ্যাতনামা হিসেবে উপস্থাপন করতে চতুরতার আশ্রয় গ্রহণ করতেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তিনি একটি সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ফেসবুক লাইভে এসে অযাচিত ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন সম্মানিত ব্যক্তিদের কটাক্ষ ও উত্ত্যক্ত করতেন। পরে ফোন করে তাদের হেয় করতেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে তার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেন।
বিটিআরসির সহযোগিতায় র‌্যাব-৪ অনুমোদনহীন আইপি টিভি জয়যাত্রা টেলিভিশনের স্টেশন সিলগালা এবং অবৈধ মালামাল জব্দ করা হয়েছে জানিয়ে খন্দকার মঈন বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর টেলিভিশনের কর্মী-সাংবাদিক নিয়োগের নামে চাঁদাবাজি ও প্রতারণা করতেন। তাদের কাছ থেকে ২০ হাজার, ৩০ হাজার, এমনকি লাখ টাকাও চাঁদা আদায় করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি ফোনালাপ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অভিযানে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত নথিপত্রও জব্দ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জয়যাত্রা টিভির একজন জেলা প্রতিনিধি চাঁদাবাজি সংক্রান্ত অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। যারা জয়যাত্রা টেলিভিশন ও জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, তাদের আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আসার পরামর্শ দেন কমান্ডার আল মঈন।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে হেলেনাকে গ্রেপ্তারের পর গুলশানের বাসায় তার মেয়ে জেসিয়া আলম সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। বাসা থেকে মদ উদ্ধারের বিষয়ে জেসিয়া বলেন, আমার ভাইয়া মদ পান করে। সেগুলোই বাসায় ছিল। তার মদপানের লাইসেন্স রয়েছে। পাসপোর্টও আছে। হরিণের চামড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাইয়ার বিয়ের সময় মায়ের সঙ্গে রাজনীতি করা নেতানেত্রীরা ওইটা গিফট করেছে। ক্যাসিনো সরঞ্জাম বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যাসিনোর চিপস ওগুলো। আমরা নিজেরাই খেলতাম আর সময় কাটাতাম। তবে ক্যাসিনো খেলতে যে বোট আর সরঞ্জাম লাগে তা নেই আমাদের। ধরেন, বাসায় তাস খেলে না কেউ? সে রকম একটা বিষয়। জাস্ট ক্যাসিনোর চিপগুলো ছিল বাসায়। মানুষ গেম খেলতে পারে না? ওরকম। জব্দ বিদেশি মুদ্রার বিষয়ে জেসিয়া বলেন, আমরা প্রায়ই বিদেশে যাই। একাধিক দেশে আমাদের নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। বিদেশ থেকে আসার পর যে মুদ্রাগুলো বেঁচে যায় সেগুলো তো রাস্তায় ফেলে দিতে পারি না।
হেলেনার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম একজন ব্যবসায়ী। ১৯৯০ সালে তারা বিয়ে করেন। দুজনে মিলে জয়যাত্রা গ্রুপের নামে প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান, এমব্রয়ডারি, প্যাকেজিং, স্টিকার এবং ওভেন গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। হেলেনা শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক এবং তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877