স্বদেশ ডেস্ক;
যুক্তরাজ্য থেকে আনুমানিক ৯০০ তরুণ সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি গ্রুপ ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং সমমনা অন্যান্য গোষ্ঠীতে যোগ দিতে একসময় দেশ ছেড়েছিল। যাদের প্রায় ১৪ হাজার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করা হয়। ব্রিটিশ সেই আইএসযোদ্ধাদের সিংহভাগেরই এখন কোনো পাত্তা নেই। এই তরুণদের মধ্যেই ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ মেহেদী হাসান। ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ থেকে যে ছয় তরুণ পালিয়ে সিরিয়া গিয়েছিল, মেহেদি তাদেরই একজন।
দ্য গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সিরিয়ার সীমান্ত শহর কোবানিতে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা পড়েন তিনি। কিন্তু এই বয়সী আট-দশজন সাধারণ তরুণের মতো একসময় শরীরচর্চাসহ নানা বিষয়ে আগ্রহ থাকা মেহেদী কেন আইএসের মতো ভয়ঙ্কর সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল, তা নিয়ে কৌতূহল থেকে গেছে অনেকের মধ্যে। সম্প্রতি মেহেদির মতো আরও তরুণরা কেন এবং কোন্ মোহে পড়ে আইএসে যোগ দিয়েছিল, তার.অনুসন্ধান করেছেন বিবিসি সাংবাদিক মোবিন আজহার। তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন, আইএস এসব তরুণকে দলে ভেড়াতে কোন্ কৌশল ব্যবহার করেছিল।
গত ১৫ জুলাই মোবিন আজহারের লেখা ‘বন্দুক এবং পুল পার্টি : আইএসের একটি স্মার্টফোনের গোপন কাহিনী’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিসি। সেখানেই অন্যান্য তরুণের মতো উঠে এসেছে মেহেদীর গল্পও। প্রতিবেদনে জানানো হয়, সিরিয়ায় আইএস তৎপরতা শেষ হওয়ার পর লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা লুইস কালাহান তার স্থানীয় অনুবাদকের সূত্রে একটি কম্পিউটার হার্ড ড্রাইভ হাতে পান। যেটির ভেতর একটি স্মার্টফোনের কতগুলো ফাইল ছিল। সেগুলো দেখে এবং বিশ্লেষণ করেই মোবিন আজহার বোঝার চেষ্টা করেছেনÑ কেন ব্রিটিশ মুসলিম তরুণরা ঘর ও দেশ ছেড়ে বহুদূরের ভিন্ন এক অঞ্চলে পাড়ি দিয়ে আইএসে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল। বোঝাই যায় এসব ছবি তারা অন্যদের দেখার জন্য তোলেনি। ফলে সেগুলো দেখে বোঝা যায়Ñ কেমন ছিল সিরিয়ায় তাদের সত্যিকারের জীবন।
যেভাবে তরুণদের টানত আইএস
শুকরি এল-খিলফি লন্ডনের এজওয়্যার রোড এলাকায় বড় হয়েছে। আইএসে যোগ দেওয়ার আগে নানা অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়েছিল। তার পর একদিন ২২ বছর বয়সে সে সিরিয়ায় চলে যায়। স্মার্টফোনের ফুটেজে দেখা যায়, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি সুইমিংপুলে শুকরি ডিগবাজি খাচ্ছে, হৈ হুল্লোড় করছে। এই বয়সের তরুণরা বন্ধুদের সঙ্গে স্পেন, গ্রিস বা পর্তুগালের কোথাও ছুটি কাটাতে গিয়ে যেভাবে হোটেলের সুইমিংপুলে ঝাঁপাঝাঁপি, হাসি-তামাশা করে, শুকরির ওই ফুটেজ অনেকটা তেমনই। পার্থক্য শুধু পুলের পাশে ওই পার্টি বা হৈ হুল্লোড়ে হাতে বন্দুক নিয়ে সে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছে। আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়Ñ শুকরি খাঁচায় আটক একটি শকুনের পাশে দাঁড়িয়ে ডেভিড-আ্যটেনবরার ঢঙে পরিবেশ নিয়ে ভাষ্য দিচ্ছে। বোঝা যায়, পৃথিবীর অনেক কিছু নিয়ে এখনো সে ভাবে না, বাস্তব অনেক কিছু নিয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা বা ধারণাই নেই।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক তরুণের কাহিনী
স্মার্টফোনে পাওয়া ছবিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণ মেহেদীকেও দেখা গেছে। কিন্তু শুকরির মতো মেহেদী আইএসে ভেড়ার আগে কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল না। পোর্টসমাউথে জন্ম নেওয়া এবং বড় হওয়া মেহেদীর মা জানান, তার ছেলে তাদের পরিশ্রমী, মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিল। কিন্তু এ-লেভেল পরীক্ষার পর ছেলের মধ্যে তারা পরিবর্তন দেখতে পান। মেহেদী খ্রিস্টান প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা করেছে। সবসময় পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে। কিন্তু এ লেভেলে আরও ভালো গ্রেডের জন্য সে নতুন করে পরীক্ষা দিতে পড়াশোনা শুরু করে। তার মায়ের মতে, তখন থেকেই হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করে মেহেদির ধ্যান-ধারণা।
চিন্তা-ভাবনায় সেই পরিবর্তন মেহেদীর সোশ্যাল মিডিয়া পেজে গিয়ে বোঝা যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার তার প্রথম দিকে পোস্টে দেখা যায় জিমের মধ্যে উদাম শরীরে তোলা সেলফি। প্রিয় জন্তু কোয়ালা নিয়েও বেশকিছু পোস্ট তার রয়েছে। এমনকি উগ্রবাদী আদর্শ যে তার অপছন্দÑ এমন সে একাধিক পোস্টে জানিয়েছে। এমন একটি পোস্টে মেহেদী লিখেছিল, ‘আমি একজন ব্রিটিশ মুসলিম, আমি এসব জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে।’ কিন্তু পরের দিকে একটি পোস্টে সে হতাশা প্রকাশ করে লিখেছে, লন্ডনে পাতাল রেলে মানুষজন তার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যে, সে যেন সবাইকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে। একপর্যায়ে, ধর্মীয় আচার পালন করতে শুরু করে মেহেদী এবং বিভিন্ন পোস্টে ‘পাপে ভরা’ অতীত নিয়ে অনুতাপ প্রকাশ করেছে। কয়েক সপ্তাহ পর সোশ্যাল মিডিয়ায় তার কোরান শিক্ষার অগ্রগতি নিয়ে সে পোস্ট দেওয়া শুরু করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে তার ঘৃণা প্রকাশ করেও পোস্ট দেয়।
এক সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় নাম বদলে ফেলে সে। মেহেদী হাসানের বদলে নিজের নাম দেয় আবু দুজানা। ঘরে বাংলাদেশি এবং বাইরে ব্রিটিশ সংস্কৃতির মধ্যে বড় হলেও হঠাৎ মেহেদী আরবদের মতো পোশাক পরে ছবি পোস্ট করা শুরু করে। কয়েক মাস পর কাউকে কিছু না জানিয়ে মেহেদী উধাও হয়ে যায়। পরে বিমানবন্দরের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বোঝা যায় সে দেশ ছেড়েছে। পরিষ্কার হয়, সে সিরিয়ায় চলে গেছে।
সিরিয়ায় গিয়েও মেহেদী সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়া অব্যাহত রাখে। কেন সে এই পথে গেল, তা নিয়ে যে কারও যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে পোস্ট দিয়েছিল ওই তরুণ। মোদ্দা কথা, যে তরুণ নিজেই উগ্রবাদে দীক্ষা নিয়েছিলÑ সে নিজেই অনলাইনে অন্যদের দীক্ষা দেওয়া শুরু করে।
তবে মেহেদী সিরিয়ায় থাকার সময় নিয়মিত পোর্টসমাউথে তার প্রিয় মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। সিরিয়ায় যাওয়ার ছয় মাস পর সে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে জানতে চায়, কেউ কি তাকে ইউকাসের (ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান) পাসওয়ার্ড দিতে পারে? তখন ধারণা তৈরি হয়, সে বোধহয় আইএস থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। মেহেদির একজন বন্ধু জানান, সে একজন ভালো আইনজীবীর নাম চেয়েছিল। ফেসবুকে এক মেসেজে বলেছিল, সে আমাকে ভালোবাসে। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি তাকে কী উত্তর দেব।
মেহেদী আর দেশে ফিরতে পারেনি। তুরস্কের সীমান্তের কাছে সিরিয়ার ভেতরেই সে মারা যায়। শেষ যে স্থানে সে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে বোঝা যায় সে পালানোর চেষ্টা করছিল।
গবেষক হাভিয়ের লেসাকা যিনি আইএসের তৈরি দেড় হাজারের মতো প্রোপাগান্ডা ভিডিও খুঁটিয়ে দেখেছেন। মেহেদীর মতো এমন অসংখ্য তরুণকে কিভাবে আইএস দলে ভেড়াতে আকৃষ্ট করত, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি। লেসাকা বলেন, অনলাইনে আইএসের অনেক প্রোপাগান্ডা ভিডিওতে সাধারণত চটক থাকে। অনেক সময় সেগুলো সিনেমার মতো করে তৈরি করা হয়। অনেক ভিডিওতে তরুণ-যুবকদের প্রিয় নানা বিষয়েরও অবতারণা করা হয়; যেমন- মর্টাল কমব্যাট নামে জনপ্রিয় ভিডিও গেম বা মুভি সিরিয়াল। তারা (আইএস) নতুন এই প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলেছে ভিডিও গেমস এবং জনপ্রিয় কিছু সিনেমার প্রতি তাদের আকর্ষণের কথা মাথায় রেখে। অথচ আইএসের তথাকথিত খেলাফত বা আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্রে যে জীবন হওয়ার কথা, এই ভিডিও ফুটেজে পাওয়া চিত্র অনেকটাই ভিন্ন।
স্নায়ুতন্ত্রের বিজ্ঞানী ড. নাফিস হামিদ, যিনি বেশ ক’জন উগ্রবাদীর মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, এসব তরুণ যুবকরা একটি অভিন্ন একো চেম্বারের মধ্যে থাকত। তাদের সব তথ্যের সূত্র ছিল একটাই। এসব উগ্রবাদী গোষ্ঠী যেটা করে তা হলোÑ সদস্যদের সঙ্গে বাকি দুনিয়ার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তারা ভয় পায় যদি সদস্যরা পরিবার-পরিজন, বন্ধু বা অভিভাবক গোত্রীয় কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, তা হলে তারা যে কোনো সময় মত-পথ বদলে ফেলতে পারে।