বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন

এশিয়ায় প্রথম, বিশ্বে চতুর্থ

এশিয়ায় প্রথম, বিশ্বে চতুর্থ

ডা. কেএম তৌহিদুর রহমান, ডা. শাহরিয়ার রোজেন, ডা. নাজিফ মাহবুব, ডা. নওরিন আহমেদ, ডা. মামুনূর রহমান:

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের দৈনিক শনাক্তের হার বিবেচনায় এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে আক্রান্ত রোগীর প্রতি ১০০ জনের আটজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে, অথচ এপ্রিলে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ছিল ৫ শতাংশ।

সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচক ১-এর বেশি হওয়ায় এবং দৈনিক শনাক্তের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামী দিনগুলোতে শনাক্ত ও মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ মুহূর্তে তাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর।

৭ জুলাই বিশ্বে নামিবিয়া, মেক্সিকো ও তিউনিশিয়ার পরই ছিল বাংলাদেশের অবস্থান। গত ১৫ দিনে বাংলাদেশে দৈনিক শনাক্তের হার বেড়েছে দুই গুণেরও বেশি। ২৬ জুন দেশে দৈনিক শনাক্তের হার ছিল ১৫.৭ শতাংশ, ১২ জুলাই সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.২৪ শতাংশে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। ১৩ জুন থেকে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচক (রিপ্রডাকশন রেট) ১.৩-এর বেশি, অর্থাৎ গত এক মাস ধরে সংক্রমণ প্রতি ১০০০ থেকে ১৩০০ জনে ছড়িয়ে পড়েছে।

দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক করোনা টেস্ট না হওয়ার কারণে দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝা যায় না। যেসব দেশে টেস্ট কম হয়, সেসব দেশের সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য উপযুক্ত সূচক হলো শনাক্তের হার এবং ‘রিপ্রডাকশন রেট’। রিপ্রডাকশন রেট (সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচক) ১-এর বেশি হওয়ায় এবং দৈনিক শনাক্তের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমরা এখনো সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছাইনি, অর্থাৎ আগামী দিনগুলোতে শনাক্ত ও মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।

নিকট ভবিষ্যতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনাও কম। এ মুহূর্তে তাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর। গত ২৩ জুন ও ৪ জুলাইয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে আইসিইউ শয্যায় ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১১ জুলাই ৭৬ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ নতুন আক্রান্ত রোগীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে মারাত্মক কোভিডজনিত জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একই রকমভাবে সাধারণ বেডে ভর্তিরত রোগীর সংখ্যায়ও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে গত ৩ সপ্তাহ ধরে।

১১ জুলাইয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অতি উচ্চ সংক্রমণের জন্য দেশে বর্তমানে ১ লাখ ৩০ হাজারেও বেশি সক্রিয় করোনা রোগী রয়েছে এবং সারা দেশে ১১ হাজারেরও বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এপ্রিলে দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় দিনে সক্রিয় করোনা রোগী ছিলেন প্রায় ১ লাখ।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে গুরুতর অসুস্থতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আক্রান্ত রোগীর প্রতি ১০০ জনের আটজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে, অথচ এপ্রিলে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ছিল ৫ শতাংশ। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানতে না পারলে আগামী দুই সপ্তাহ পর সব রোগীকে হাসপাতাল বা আইসিইউ সেবা না দিতে পারার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

পাশাপাশি আসন্ন ঈদে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জনসমাগম ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের গতিতে নতুন মাত্রা সংযোজন করতে পারে। ভারতে মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না হওয়া। দেশের হাসপাতাল/ আইসিইউতে সেবা দিতে হবে এমন রোগীর সংখ্যা হাসপাতালগুলোর সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

লকডাউন একটি স্বল্পমেয়াদি সমাধান। আর মহামারি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর সমাধান হলো টিকা। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে টিকা ও ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে প্রতিযোগিতায় টিকা জয়ী হচ্ছে। বাংলাদেশে করোনা মহামারির ভয়াবহ সংক্রমণের মূল কারণ হচ্ছে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অধিক সংক্রমণক্ষম, যা যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট থেকেও কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বেশি সংক্রামক এবং তা হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

তবে কিছুটা স্বস্তির বিষয় হলো, অধিকাংশ ভ্যাকসিন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে কার্যকর। ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ ভ্যাকসিন গুরুতর অসুস্থতা বা করোনাজনিত মৃত্যু থেকে প্রায় শতভাগ সুরক্ষা দেয়। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ৯২ শতাংশ কার্যকর।

অপরদিকে, ফাইজারের ভ্যাকসিনের দুই ডোজ গুরুতর অসুস্থতা থেকে ৯৬ শতাংশ সুরক্ষা প্রদান করে। মডার্না, সিনোফার্ম ও স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন সম্পর্কে গবেষণার ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানী আশা করছেন, মডার্না, সিনোফার্ম ও স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন করোনাজনিত গুরুতর অসুস্থতা থেকে প্রতিরক্ষা প্রদান করবে।

বাংলাদেশে খুব অল্প মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় আসায় (৪ শতাংশের কম) অধিকাংশ মানুষ প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে আছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এখন আর শুধু সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন বা শাটডাউন দিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, এ ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃত্ব ও জনসাধারণের অংশগ্রহণ জরুরি। দেশের ৯৬ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিনের আওতার বাইরে থাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।

লেখকরা সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের এপিডেমিওলজি বিভাগের চিকিৎসক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877