মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০৩:২৪ অপরাহ্ন

ঢাকা ছাড়তে মানুষের স্রোত

ঢাকা ছাড়তে মানুষের স্রোত

স্বদেশ ডেস্ক:

সরকারি বিধিনিষেধের কারণে চলাচল সীমিত করা হয়েছে। এটি ‘সর্বাত্মক’ পর্যায়ে উপনীত হতে পারে ১ জুলাই থেকে। এ অবস্থায় উপার্জনের পথ সীমিত হয়ে যেতে পারে। এমন আশঙ্কা থেকে ঢাকা ছাড়তে মানুষের চাপ বেড়েছে। সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আজ সোমবার থেকে সারাদেশে বিধিনিষেধ। কেউ কেউ মনে করতে শুরু করেছেন, এই লকডাউন ঈদ পর্যন্ত গড়াতে পারে। সে জন্য গতকাল ছিল মানুষের ঢাকা ছাড়ার হিড়িক।

গতকাল ভোর থেকেই মানুষ দলে দলে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। যান চলাচল বন্ধ থাকলেও কোনো সমস্যা মনে করছে না। যে কোনো মূল্যে বাড়ি ফিরতে হবে। টঙ্গী থেকে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ কিংবা নরসিংদী অঞ্চলের মানুষ ঢাকা খালি করছে। সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী এলাকা দিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুর অঞ্চলের মানুষ। গাবতলী দিয়ে ঢাকা ছাড়ছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ।

বেশির ভাগের একই মন্তব্য- জীবিকার তাগিদে তারা বাড়ি চলে যাচ্ছেন। এই শহরে তারা থাকেন কেবলই বাঁচার অবলম্বন হিসেবে। কঠোর লকডাউনের আশঙ্কা থেকে তারা বাধ্য হচ্ছেন ঢাকা ছাড়তে। বৃহস্পতিবার থেকে কঠোর লকডাউন হতে পারে এমন আশঙ্কায় তারা মনে করছেন, আগেভাগে বাড়ি না ফিরতে পারলে এই শহরে আপাতত জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। একে তো দীর্ঘ যানজট, তার ওপর সেই কষ্ট দূরে ফেলে রেখে হেঁটেই পথ পাড়ি দিচ্ছেন তারা।

সড়কে মানুষের চাপ অনেক বেশি। সবকিছু বন্ধ হওয়ার আগে মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেতে চাইছে। এ কারণেই সড়কে প্রচুর মানুষ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গাবতলী ও আমিনবাজার ঘুরে দেখা যায়, অন্যদিনের তুলনায় গতকাল রবিবার গ্রামে ফেরা মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। বিশেষত প্রথম তিন দিন ‘লকডাউন’ শিথিল করায় এ হার যেন আরও বেড়েছে।

শাহীন নামের এক যাত্রী রওনা হয়েছেন বগুড়ার পথে। কয়েক ধাপে বিকল্প যানবাহনে চড়ে তিনি যাবেন সেখানে। তিনি বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন থেকেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর ওপর আবার নতুন করে লকডাউন। এখন ঢাকায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন। তাই ভোগান্তি থাকলেও গ্রামে ফিরতে হচ্ছে।

সুলতান যাবেন নওগাঁর সাপাহারে। তার সঙ্গে আরও দুই বন্ধু। তারা সবাই পেশায় রাজমিস্ত্রি। এভাবে ভোগান্তির মধ্যে বাড়ি ফেরার ব্যাখ্যা দিলেন তারা- লকডাউনে ঢাকায় কোনো কাজ থাকবে না। মেসের বুয়াও থাকে না রান্নার কাজে। রুটিরুজি বন্ধ থাকলে ঢাকায় থেকে লাভ কী? পেট চালাতেই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরছেন বলে তারা জানালেন। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিকল্প যানবাহনে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা করছেন অনেকে। সেক্ষেত্রে বাড়তি টাকা যেমন খরচ করতে হচ্ছে, তেমনি পদে পদে ভোগান্তিরও শেষ নেই। এসব ঘরমুখো মানুষের যাত্রায় উপেক্ষিত করোনা ভাইরাসের স্বাস্থ্যবিধি।

ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট কার ছাড়াও পরিবহন হিসেবে এ রুটে চলাচল করছে মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। গাবতলী বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা যায়, এ এলাকায় ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ও সিএনজির সংখ্যাও কম নয়। তবে এ মাধ্যমে ভাড়া একটু বেশি। জনপ্রতি ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও সাইনবোর্ড এলাকায় দেখা যায়, মানুষের ভিড়। গাদাগাদি করে মানুষ সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। করোনার ভয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছেন না তারা। মুখে মাস্কও নেই অনেক যাত্রীর। যান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। সেদিকে নজর নেই- যেন ঈদ উদযাপনে বাড়ি ফেরার যুদ্ধে নেমেছেন যাত্রীরা।

কেউ হেঁটে, কেউবা রিকশায় পার হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড মোড়। মোড় পার হয়েই আবার তারা চড়ছেন ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহনে। অনেকে উঠে পড়ছেন ট্রাক ও পিকআপের পেছনে। সাইনবোর্ড মোড়ের দুই পাশেই যানবাহনের দীর্ঘ সারি। নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড সড়কেও একই পরিস্থিতি। যানজটের কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ যানবাহন থেকে নেমে হেঁটেই মোড় পার হচ্ছেন। ঢাকা থেকে কোনো বাসকে সাইনবোর্ড পার হতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে পিকআপ, ট্রাকসহ পণ্যবাহী যান ছাড়া হচ্ছে। রোগী, জরুরি সেবা, বিদেশগামী ব্যক্তিদের যেতে দেওয়া হচ্ছে।

দেখা গেছে, সাইনবোর্ড এলাকায় অনেক মানুষ বিভিন্ন যানের জন্য অপেক্ষা করছেন। অধিকাংশই বাড়ির পথ ধরছেন। কেউ কউ রাজধানীতে চিকিৎসক দেখানো, ব্যবসার কাজে এসে বাড়ি ফিরছেন। গতকাল দুপুরের দিকে মাতুয়াইল থেকে সাইনবোর্ড প্রায় চার কিলোমিটার সড়কে যানজট চোখে পড়ে। ঢাকা থেকে বের হতে সাইনবোর্ড থেকে যানগুলো ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই এই মোড়ে যানজট বেশি। একইভাবে ঢাকামুখী পথেও যানজট আছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর।

মুন্সীগঞ্জ থেকে নাদিম হোসাইন জানান, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গতকাল শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়ায় দক্ষিণবঙ্গগামী যাত্রীর ঢল নেমেছে। ভোর থেকেই হাজারও যাত্রী ফেরিতে পাড়ি দিচ্ছেন প্রমত্তা পদ্মা। সামনে কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় গেল কয়েক দিনের তুলনায় এদিন ফেরিতে যাত্রীর ভিড় বেড়েছে। ফেরিতে শুধু পণ্যবোঝাই ও জরুরি সেবার যানবাহনই পারাপার হচ্ছে।

সরজমিনে সকাল থেকে দেখা যায়, নৌরুটের প্রতিটি ফেরিতেই অল্পসংখ্যক যানবাহন সঙ্গে যাত্রীদের ভিড়। তবে সকাল থেকে দক্ষিণবঙ্গগামী যাত্রীর ভিড় ছিল। ঢাকামুখী যাত্রীর সংখ্যা ছিল কিছুটা বেশি। শুধু পণ্যবাহী ও জরুরি যানবাহন পারাপারের কথা থাকলেও ফেরিতে ব্যক্তিগত গাড়ি পারাপার হতেও দেখা যায়।

মাওয়া থেকে রুবেল ইসলাম তাহমিদ জানান, রাজধানীর কর্মস্থল ছেড়ে দক্ষিণবঙ্গগামী মানুষের ঢল নামে গতকাল মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে। শনিবার দিবাগত রাত ও রবিবার থেকে এ ঘাট হয়ে হাজার হাজার যাত্রীর ভিড় দেখা গেছে।

শিমুলিয়া ঘাট থেকে বাংলাবাজারমুখী ফেরিগুলোয় পণ্যবাহী ও জরুরি যানবাহন পারাপারে বেগ পেতে হচ্ছে যাত্রীর চাপে। এদিকে শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় আটকা পড়েছে কয়েকশ গাড়ি। সকাল ৬টা থেকে দেখা যায়, পুলিশের বসানো চেকপোস্ট উপেক্ষা করে বিভিন্ন পথে ছোট যানবাহনে করে যাত্রীরা ঘাট এলাকায় আসেন। অনেকের মুখেই মাস্ক দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) শিমুলিয়া ঘাটের মেরিন অফিসার মো. আহম্মেদ আলি বলেন, নৌরুটে বর্তমানে ১৫টি ফেরি সচল রয়েছে। যাত্রীদের প্রচুর পরিমাণে ভিড় রয়েছে।

মাদারীপুর থেকে শফিক স্বপন জানান, লকডাউন বাস্তবায়নে পুলিশ ও জেলা প্রশাসন কঠোর হলেও মানানো যাচ্ছে না সাধারণ মানুষকে। শহরে বেড়েছে ছোট যানবাহনের চাপ। মাদারীপুর-শরীয়তপুর আঞ্চলিক সড়ক ও মাদারীপুরের প্রধান সড়কে যাতায়াত করছে এসব যানবাহন। এ ছাড়া শহরের অন্য সড়কগুলো বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়ে আটকে দিয়েছে প্রশাসন। স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে না মানুষের মধ্যে। বাজারগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

ওদিকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় গতকাল সকাল থেকে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রী চাপ শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপ আরও বাড়ে। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় যাত্রীরা মোটরসাইকেল, থ্রি হুইলার, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন হালকা যানবাহনে ৩-৪ গুণ ভাড়া দিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে এসে ফেরিতে গাদাগাদি করে পদ্মা পাড়ি দেন।

মানিকগঞ্জ থেকে আশরাফুল আলম লিটনজানান, কঠোর লকডাউনের খবরে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার অন্যতম প্রবেশদ্বার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও যাত্রীদের চাপ কিছুটা বেড়েছে। শুধু রাজধানী ঢাকা থেকে আসা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী যাত্রীই নন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা রাজধানীগামী যাত্রীদেরও চাপ দেখা গেছে। যাত্রীরা প্রাইভেট কার, অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যানে করে ভেঙে ভেঙে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে তাদের গন্তব্যে যাচ্ছেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877