রবিবার, ২৬ মে ২০২৪, ০৮:৫১ অপরাহ্ন

ছাপাখানা বসিয়ে জাল স্ট্যাম্প তৈরি

ছাপাখানা বসিয়ে জাল স্ট্যাম্প তৈরি

স্বদেশ ডেস্ক:

শক্তিশালী সিকিউরিটি সিস্টেম না থাকায় খোদ রাজধানীতেই গোপন ছাপাখানায় তৈরি হচ্ছে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প। এগুলো ছড়িয়ে পড়েছে এখন সারাদেশে। ব্যবহার করা হচ্ছে আদালত-পোস্ট অফিসসহ সরকারি-বেসরকারি অফিসেও। আসল রেভিনিউ স্ট্যাম্পের মতো হুবহু তৈরি করায় সেটি যে নকল তা বোঝা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন। তা ছাড়া জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প পরীক্ষা করার মতো সব অফিসে ব্যবস্থা যেমন নেই, তেমনি নেই কঠোর নজরদারিও। এতে জাল স্ট্যাম্পের সহজ প্রচলন ও ব্যবহারে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

প্রথম তিন বছর ছোট পরিসরে ব্যবসা চালিয়ে মোটা লাভের আশায় রীতিমতো ছাপাখানা বসিয়ে খোদ রাজধানীতে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প এবং কোর্ট ফি-এর কারবার জমিয়েছিল একটি চক্র। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল শুক্রবার ভোর পর্যন্ত রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০ কোটি ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা সমপরিমাণের ১৩ লাখ ৪০ হাজার জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও এসব তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের মূলহোতা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পারভেজ ওরফে রানাসহ চারজনকে। সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলো- আতিয়ার রহমান সবুজ, নাসির উদ্দিন ও নুরুল ইসলাম ওরফে সোহেল।

অভিযান শেষে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন মাতুয়াইল দক্ষিণপাড়ায় কলেজ রোড এলাকার ৬৮/৩ নম্বর জননী হাউজের নিচতলায় আবিষ্কৃত জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি প্রস্তুতকারী গোপন ছাপাখানাটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। জব্দ করা হয় বিভিন্ন মূল্যমানের ১৩ লাখ ৪০ হাজার পিস জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের ১৯ হাজার ৪৮০টি জাল কোর্ট ফি, জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প বিক্রির নগদ ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ১১৪ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার, আটটি মোবাইল ফোন, একটি পেনড্রাইভ, ডাক বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১১টি সিল, দুটি স্ট্যাম্প পরীক্ষার ইলেকট্রিক মেশিন, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের রশিদের কপি ৩০০ পাতা, একটি বড় প্রেস মেশিন, দুটি কাটিং মেশিন, একটি ডাই কাটিং মেশিন, একটি পোলার পেপার কাটিং মেশিনসহ ১০০ কোটি টাকা সমপরিমাণের জাল স্ট্যাম্প তৈরির কাগজ, বিভিন্ন ব্যাংকের ১ কোটি ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার ১৮টি চেকের পাতা। শুক্রবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার।

এ দিকে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির সঙ্গে জড়িত ও তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি প্রস্তুতকারী সিন্ডিকেটের মূল হোতাসহ গ্রেপ্তার চারজনকে তিনদিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল চার আসামিকেই ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মতিঝিল থানায় করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের ১০ দিন করে রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. মঈনুল ইসলাম প্রত্যেকের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, ‘জালিয়াতি চক্রটি ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত কস্পিউটার এবং কালার প্রিন্টার ব্যবহার করে সীমিত পরিসরে অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। গ্রেপ্তারকৃতরা ২০১৯ সালে মাতুয়াইলের একটি গোপন ছাপাখানা বসিয়ে বড় পরিসরে জালিয়াতির ব্যবসাটি শুরু করে। এরা প্রথম পর্যায়ে সুদক্ষ অপারেটর দিয়ে গোপন কোন ছাপাখানায় বিভিন্ন মূল্যমানের জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ছাপায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ছাপানো রেভিনিউ স্ট্যাম্পগুলো ছাপাখানা থেকে জালিয়াতি চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে হোলসেলার ভেন্ডারদের কাছে পৌঁছে দেয়। তৃতীয় পর্যায়ে হোলসেলারদের থেকে রিটেইলারদের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছায়। চক্রটি মূলত বিভিন্ন গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি, সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন পোস্ট অফিস, আদালত, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ হাসপাতালে এ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি বিক্রি করে। এ ধরনের জাল স্ট্যাম্পের কারণে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।’

জাল ও আসল রেভিনিউ স্ট্যাম্পের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতদের জাল স্ট্যাম্প তৈরির স্টেপগুলো এতটাই নিখুঁত ছিল যে, খালি চোখে ধরার কোনো সুযোগ ছিল না। কাগজগুলো হুবহু একই রকম। তবে আসল স্ট্যাম্পে জিওভি লেখা স্পষ্ট দেখা যায়, যা নকল স্ট্যাম্পে যায় না। আবার জলছাপের কালো রেখা ইউভি মেশিনের নিচে জ্বলজ্বল করবে। নকল স্ট্যাম্পে তা করবে না। এ তথ্যগুলো জানা সাধারণ মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেকেই তা জানি না। সাধারণভাবে আসল ও নকল রেভিনিউ স্ট্যাম্প পার্থক্য করা কঠিন। এ জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ইউভি মেশিন রাখা। আর যারা ব্যবহারকারী তারা রেজিস্টার্ড রিটেইলারদের কাছ থেকে কিনলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রতারণা ঠেকাতে রেভিনিউ স্ট্যাম্প কোর্ট ফিগুলো ডাকঘর, ব্যাংক ও রেজিস্টার্ড কোনো জায়গা থেকে কিনতে হবে।’

পোস্ট অফিসের কেউ এই চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে কিনা জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক তদন্তে এখনো পোস্ট অফিসের কারও সংশ্লিষ্টতা পাইনি। গ্রেপ্তার চারজনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তাদের ব্যবহৃত মেশিনে ঘণ্টায় পাঁচ হাজার রেভিনিউ স্ট্যাম্প ছাপানো যেত। তবে হুবহু ও কালার ফরমেশন ঠিক রেখে ঘণ্টায় এক থেকে দেড় হাজার রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করতে পারে, যা সাধারণ মানুষ ধরতে পারবে না। তাদের তৈরি করা জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সারাদেশেই সরবরাহ হয়। আর এই স্ট্যাম্প হাতে হাতে নয়, অফিস টু অফিসে নগদ টাকায় বিক্রি ও সরবরাহ হতো।’ তিনি বলেন, ‘কেউ স্ট্যাম্পের দিকে বিশেষ খেয়ালও রাখে না। কোনো সংস্থার বা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ নজরদারিও নেই। আর এই সুযোগটাই নিত চক্রটি।’

জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহারকারীরা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কিনা জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, ‘জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহারের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। অবশ্য ব্যবহারকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কিনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়। আমরা প্রাথমিকভাবে চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করেছি। তবে অভিযানকালে যেহেতু শত কোটি টাকা সমমূল্যের জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির কাগজপত্র ও সরঞ্জাম পেয়েছি, সঙ্গে ২০ কোটি টাকা মূল্যের তৈরি করা স্ট্যাম্প পেয়েছি; তাই আমাদের ধারণা, এ চক্রের সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877