স্বদেশ ডেস্ক:
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভ্রান্ত ‘দ্বি-জাতিতত্ত্বে’র ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা। অতঃপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতন, চরম অবেহলা ও দুঃশাসনে নিষ্পেষিত এই অঞ্চলের মানুষ। পূর্ব বাংলা অর্থাৎ এই অঞ্চলের জনগণের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয়।
প্রতিশ্রুতিশীল নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। যার পরবর্তী নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এর পর দীর্ঘ এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয় দলটি। সুন্দর এক স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে স্রোতের বিপরীতে যাত্রা শুরু করে। পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেকে হয়ে ওঠেন বাঙালির পরীক্ষিত নেতা। এরই ধারাবাহিকতায় আসে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, ১৯৭১। অমোচনীয় এক
ইতিহাসের জন্ম দিয়ে বিশ্বদরবারে উদিত হয় সবুজ জমিনে লাল সূর্যের নিশান, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। এর নেতৃত্বে ছিল উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। একাত্তরের আগেই শুধু নয়, স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই ও সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে দলটি। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক বহন করে দলটি আজ ৭২ বছর পেরিয়ে ৭৩ বছরে পা দিয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; তার নেতৃত্বেই স্বাধীন দেশে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাও শুরু হয়েছিল। এর পর দীর্ঘসময় প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে জাতির জনকের স্বপ্নের পথ ধরে তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয় আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রা। ১৯৮১ সালে দলটির সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর চার যুগ ধরে দলটিকে পরিচালনা করছেন তিনি। তারই নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আছে দলটি। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের সময়ে অর্থনৈতিক তথা সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন বিশে^র আলোচনার বিষয়বস্তু।
এত অর্জনের পরও দলটি রয়েছে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সামনে। অতীতের তুলনায় তৃণমূল আওয়ামী লীগ খারাপ অবস্থায় আছে। জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়া নতুন নেতৃত্ব আসার পথ বন্ধ। এমপি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব অব্যাহত। ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে ঠাঁই দেওয়া হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। এভাবে বিশেষ ব্যক্তির বলয় তৈরি করাসহ নানা কারণে তৃণমূল-প্রধান দলটির সাংগঠনিক অবস্থা অতীতের তুলনায় দুর্বল। তৃণমূলের অনেক অভিযোগ জমা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে। অভিযোগের ভিত্তিতে নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থাও।
আওয়ামী লীগের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দলের সাংগঠনিক জেলা ৭৮টি। এর মধ্যে ২১তম সম্মেলনের পর এ পর্যন্ত ৩২টি জেলায় সম্মেলন হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে অন্য সাংগঠনিক জেলাগুলোর সম্মেলন বন্ধ আছে।
জেলা পর্যায়ের দুই দায়িত্বশীল নেতা বলেন, দল ক্ষমতা থাকায় এবং বিরোধী দলের নিষ্ক্রিয়তার কারণে জেলার দিকে আওয়ামী লীগের নজর নেই। ত্যাগী নেতাদের প্রয়োজনও যেন কম। এ কারণে কোনো সংকট দেখা দিলে মোকাবিলা করতে পারছে না তৃণমূল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তার বাবা বঙ্গবন্ধুর মতোই বারবার বলছেন, তৃণমূলই আওয়ামী লীগের প্রাণ। তৃণমূলই আওয়ামী লীগের শক্তি। তিনি দলীয় ফোরামের একাধিক বৈঠকে তৃণমূলের কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের ঠাঁই দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ময়মনসিংহ বিভাগের এক নেতা বলেন, তৃণমূল ঠিক না হলে সরকারের উদ্যোগের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হবে না। অন্যদিকে সংকট দেখা দিলে তা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। যেমনটি সম্ভব হয়নি হেফাজতসহ বেশকিছু জায়গায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার ইস্যুতে। ফলে দলের নেতৃবৃন্দের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা, করোনা মোকাবিলায় দলীয়ভাবে কাজ করে জনগণের বিশ^াস অর্জন করা এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিসহ সব অনাচারের বিরুদ্ধে লড়তে এখন তৃণমূলকে শক্তিশালী করাই ৭৩তম বছরে আওয়ামী লীগের বড় চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতৃবৃন্দের বিশ^াস, অতীতের মতোই সব বাধা উড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আরও এগিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। অতীতের মতোই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আলোর ঝা-া হাতে পথ দেখাবে দলটি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেন, অনেক বাধা অতিক্রম করে সাধারণ জনগণের ভালোবাসায় অত্যন্ত দক্ষতা, সততা ও সফলতার সাথে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রমাণ করেছেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের মানুষ নিরাপদে থাকে।
১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৫ সালের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধর্ম, বর্ণের প্রতিনিধি হিসেবে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। শুরু থেকেই মাঠপর্যায় থেকে উঠে আসা নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছেন দলটিতে। প্রভাবশালী বা অভিজাত হিসেবে পরিচিতরা সেভাবে আসেননি এই দলে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দলটির ২১টি জাতীয় সম্মেলন হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা
১৯৮১ সালের ১৩তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা। তিনি সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর ৬ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। সবশেষ ২০১৯ সালের ২০-২১ ডিসেম্বরের ২১তম সম্মেলনে নবমবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি
করোনার কারণে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘরোয়াভাবে উদযাপন করবে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ২৩ জুন সূর্যোদয় ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সব কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন। বেলা ১১টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার কবরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধি দল শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবে। বেলা ৩টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আলোচনাসভা। এতে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। দিনটি উপলক্ষে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআই বিশেষ ওয়েবিনার করবে।