শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১১:০৭ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
‘সুযোগের’ টানে ভাসানচর ছেড়ে উখিয়ায় রোহিঙ্গারা

‘সুযোগের’ টানে ভাসানচর ছেড়ে উখিয়ায় রোহিঙ্গারা

স্বদেশ ডেস্ক:

উখিয়ার ক্যাম্পের চেয়ে উন্নত জীবনের আশায় ভাসানচরে পাড়ি জমিয়েছিল রোহিঙ্গারা। কিন্তু কয়েক মাস পরই তাদের কেউ কেউ সাগর পাড়ি দিয়ে উখিয়ায় ফিরে যায়। উখিয়ার ঘিঞ্জি ঘনবসতির ঝুঁকিপূর্ণ জীবনই কেন তাদের ভালো হচ্ছে? কেন তারা সাজানো গোছানো ভাসানচর ছেড়ে পালিয়ে আসছে তা নিয়ে প্রশ্ন সবখানে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপরাধপ্রবণতাই কিছু কিছু রোহিঙ্গার উখিয়ায় ফেরার মূল কারণ। সেখানে অপরাধের বিভিন্ন সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, অবৈধভাবে অর্থ কামানোর অনেক সুযোগ আছে, নিয়ম-কানুনের বালাই নেই, কাউকে তোয়াক্কা করতে হয় না।

২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর উখিয়া থেকে প্রথম ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নেওয়া হয়। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতেই তাদের কেউ কেউ পুনরায় উখিয়ায় ফিরতে শুরু করে। আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরার সুযোগ না থাকায় তাদের কেউ কেউ টানা চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় মেঘনা নদী ও সাগর পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর উপকূলে পৌঁছে। অনেকে নৌকা ভাড়া করে সপরিবারে পালিয়েছে উখিয়ার উদ্দেশে। কেউ কেউ হয়েছে নিরুদ্দেশ। এ পর্যন্ত ভাসানচরে ১৯ হাজার রোহিঙ্গাকে নেওয়া হয়েছে। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার থাকার ব্যবস্থা আছে। তবে কত সংখ্যক লোক ভাসানচর ছেড়ে পালিয়েছে তার সঠিক তথ্য সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছে নেই।

সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ্ রেজওয়ান হায়াত আমাদের সময়কে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এক জায়গায় থাকার পর রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ভাসানচরে মানিয়ে চলতে পারছে না। পাশাপাশি তারা কিছু দুষ্ট লোকের কবলেও পড়েছে। তাই সেখান থেকে কিছু লোক পালিয়ে আসছে। বর্তমানে সেখানে নৌবাহিনীর সদস্যরা পাহারায় আছেন। তারা তো আর পুলিশিং করছেন না। তাই আমরা সেখানে এপিবিএন মোতায়েন করছি যাতে তাদের এ পালানো রোধ করা যায়।

জানা যায়, ভাসানচর থেকে উখিয়ায় পালিয়ে ফেরা ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের বর্তমানে উখিয়ায় অবস্থিত ট্রানজিট সেন্টারে রাখা হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) এ ট্রানজিট সেন্টার পরিচালনা করছে। বর্তমানে সেখানে ১৬৫ পরিবারের ৬২৮ জন রোহিঙ্গা আছে। এর বাইরে কিছু রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলা কারাগারে বন্দি আছে। আরআরআরসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসাকে সরকার অপরাধমূলক তৎপরতা হিসেবেই দেখছে। তাই তাদের জেলে রাখা হচ্ছে। এর বাইরেও অনেকে রোহিঙ্গা শিবির থেকে পালিয়ে আশপাশের বা দূর জনপদের গ্রামে মিশে যাচ্ছে। স্থানীয় জনগণ অনেককেই ধরিয়ে দিচ্ছে। তাদের স্থান হচ্ছে ট্রানজিট ক্যাম্পে।

জানা যায়, ভাসানচর থেকে পালানো সব রোহিঙ্গা শেষ পর্যন্ত উখিয়ায় ফেরেনি। কর্মকর্তাদের শঙ্কা, তারা হয় বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, নতুবা দেশেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় স্থাপিত একটি পুলিশ (এপিবিএন) ক্যাম্পের প্রধান বলেন, রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশিদের মতো করে চলাফেরা রপ্ত করেছে। তাদের আর দোভাষিও লাগে না। ফলে তারা দেশের যে কোনো এলাকায় গিয়ে বাঙালি পরিচয় দিয়ে সাধারণ লোকজনের সঙ্গে মিশে যেতে পারছে। তিনি দাবি করেন, ১৬ থেকে ২২ বছর বয়সী রোহিঙ্গাদের অনেকেই ক্যাম্প থেকে পালাচ্ছে।

গত ৩ মার্চ ভাসানচর যায় মোহাম্মদ সৈয়দ (১৫)। ২৮ এপ্রিল জোয়ারের সময় আরিফ মাঝি নামে একজনের সহায়তায় ভাসানচর থেকে চলে আসে। এখন তার স্থান হয়েছে ট্রানজিট ক্যাম্পে। কুতুপালং তিন নম্বর ক্যাম্পের ৯ নম্বর ব্লকের মৃত রশিদ আহম্মদের স্ত্রী হামিদা খাতুন (৬০), ছেলে এনায়েত উল্যা (৩২), ভাই কেফায়েত উল্যা (৩০) তাদের স্ত্রী জাহিদা বেগম (২৪) ও উম্মে রোমান (২০), এনায়েত ও কেফায়েতের সন্তান আতিক (৭), মো. সহিদ (৬), শামীম (২) ও মো. উবাইদ (২) গত ৩ মার্চ স্বেচ্ছায় ভাসানচর যান। তারাও ১৫ মে উখিয়ায় ফিরে আসে। ভাসানচর থেকে তারা জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা করে দালালকে দেয়। এর পর বোটে করে দালালরা তাদের চট্টগ্রাম উপকূলে ভিড়িয়ে দেয়। পরিবারটির সব সদস্য এখন ট্রানজিট ক্যাম্পে আছে।

ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা ৩৯ জন ধরা পড়ে সন্দ্বীপ উপকূলে। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। সন্দ্বীপ থানার ওসি বশির উদ্দিন আহম্মেদ আমাদের সময়কে বলেন, ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা অনেকে উখিয়ায় তাদের পরিবারের কাছে যেতে চায়। অনেকে বিদেশ পাড়ি দিতেও ভাসানচর ছাড়ে। আমাদের কাছে খবর এসেছে অনেকে নোয়াখালী ও কোম্পানীগঞ্জ দিয়েও পালাচ্ছে।

কী মধু উখিয়ায়

ইয়াবা কারবার ও বহনের সঙ্গে জড়িতদের একটি বড় অংশই রোহিঙ্গা। নিয়মিতই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়ছে তারা। র‌্যাব নিয়মিতই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করছে। গত ১৫ জুন চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাপুলিশ তিন হাজার ইয়াবাসহ আজিম, গোলবাহার আক্তার, সাইফুল ইসলাম, নিজাম খান ও রবিউর হোসেন নামের পাঁচ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে। জেল থেকে বের হয়ে তারা সবাই আবারও ইয়াবা পাচারে যুক্ত হয় বলে জানান কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন।

ভাসানচরে কৃষিকাজের সুবিধা আছে। কিন্তু নগদ অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ নেই। আরআরআরসি কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বলেন, উখিয়ার রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। অনেকে শ্রমিক হিসেবে উখিয়া, টেকনাফ, রামু ও আশপাশের এলাকায় কাজ করে। বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘোরাঘুরি করতে পারে।

বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকাও আসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয়। ভাসানচরে সেই সুবিধা নেই। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসে টাকা। এ টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোনে পৌঁছে যায়। সেই টাকা তুলতে তারা অবাধে উখিয়া উপজেলা সদরে যেতে পারে। কোনো ধরনের বাধা নেই।

উখিয়া-টেকনাফে জীবনযাপনে রোহিঙ্গারা সীমাহীন স্বাধীনতা ভোগ করে। ক্যাম্পে কোনো সমাজ ব্যবস্থাই নেই। ফলে সব পরিবারই নিজেদের মতো করে স্বাধীন। অর্থ আয় ও লেনদেনের ব্যাপারেও তারা স্বাধীন। কীভাবে অর্থ আসছে, কিসে খরচ হচ্ছে জিজ্ঞেস করারও কেউ নেই।

শরণার্থী শিবিরে দায়িত্ব পালন করা একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, রোহিঙ্গাদের গড়ে তিন পরিবারের মধ্যে দুই পরিবারই স্বচ্ছল। বিদেশ থেকে তাদের কাছে টাকা আসে। রোহিঙ্গা শিবিরের বাজারে সব কিছুর দাম চড়া। রোহিঙ্গারাই চড়া দামে সেসব পণ্য কিনে নেয়। এতেই তাদের আর্থিক অবস্থা বোঝা যায়।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বরেন, কিছু দুষ্ট লোকের চক্র এখানে কাজ করছে। আমরা সেই চক্র ভেঙে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877