শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৪০ অপরাহ্ন

বিদ্যমান পরাশক্তি নতুনের ভয়ে থাকে সন্ত্রস্ত

বিদ্যমান পরাশক্তি নতুনের ভয়ে থাকে সন্ত্রস্ত

শাহাবুদ্দিন খালেদ চৌধুরী:

যুক্তরাষ্ট্রই সারা বিশ্বের নেতৃত্বে রয়েছে, আর চীন বিশ্বের পরবর্তী নেতৃত্ব গ্রহণের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রখ্যাত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন যুক্তরাষ্ট্র কেমন করে বিনামূল্যে প্রকৃতির দয়ায় বিশ্বের সব আক্রমণ থেকে নিরাপদে রয়েছে তার একটি সুন্দর বিবরণ দিয়েছিলেন। তা জ্ঞানের জগতে অবিস্মরণীয় এবং রোমাঞ্চকর হয়ে থাকবে। তিনি বলেছিলেন, ‘Shall we expect some trans-Atlantic military giant to step the ocean and crush us at a blow? Never! All the armies of Europe, Asia and Africa combined with all the treasure of all the earth in their military chest with a Bonaparte for a commander could not by force take a drink from the Ohio or make a track on the blue ridge in a trial of thousand years’. অর্থাৎ আমরা কি ভাবতে পারি, যে আটলান্টিকের ওপার থেকে কোনো অসাধারণ সামরিক শক্তি এসে আমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে? অসম্ভব। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার সমস্ত সামরিক শক্তি এক হয়ে, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ নিয়ে এবং নেপোলিয়নের মতো কমান্ডারের নেতৃত্বে হাজার বছর ধরে চেষ্টা করলেও জোর করে ওহিও রাজ্য থেকে এক ফোঁটা পানি পান করতে বা নীল পর্বত শ্রেণীতে পদচিহ্ন রাখতে পারবে না।’

বিশ্বের শুরু থেকে দেখা যায়, প্রত্যেক শতাব্দীতে একটি দেশের আবির্ভাব ঘটে যার যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি, সামরিকশক্তি এবং মেধাশক্তি থাকে যা সবসময় প্রচলিত ব্যবস্থাকে তাদের মূল্যবোধের ভিত্তিতে নতুন করে সাজিয়ে নেয়। স্বভাবত তখন উপস্থিত শক্তির পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সমন্বয় করা একটি অসহনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এটিই বিধির বিধান।

১৮০০ শতাব্দীতে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হয়ে ওঠে গ্রেট ব্রিটেন। বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তির ভারসাম্য বা ‘balance of power’ ধারণার গোড়াপত্তন করেছিল এবং তখন থেকে গ্রেট ব্রিটেন প্রায় ২০০ বছর সময় ধরে বিশ্বের কূটনীতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।

তখন ইউরোপের অস্ট্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মেটারনিক, তিনি ক্ষমতাসীন হয়ে ইউরোপের ধারণাতেই আমূল পরিবর্তন আনেন। কিন্তু জার্মানির নেতৃত্বে থাকা বিসমার্ক তার ধারণা চুরমার করে দেন। বিসমার্ক ইউরোপের কূটনীতিকে ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধের রাজনীতি’তে রূপান্তরিত করেন। কূটনীতি আর কূটনীতি রইল না, ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হলো। অবশেষে, ১৯১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলো। গ্রেট ব্রিটেন উপলব্ধি করল যে, ইউরোপে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করা তার পক্ষে আর কিছুতেই সম্ভব হবে না। কাজেই বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের পর স্বাভাবিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নই ইউরোপের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে আর কোনো দ্বিমত পোষণ করার প্রশ্নই আসে না। তখন ব্রিটিশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতার দিক দিয়ে তদানীন্তন বিশ্ব নেতাদের সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। তিনি বুঝলেন রাশিয়াকে যদি বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্পই নেই। কাজেই সে মুহূর্ত থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চার্চিল ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নেতাদের একমত করতে সক্ষম হন। তবে এ কথা সত্য, তখনকার সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল না হয়ে যদি অন্য কেউ হতেন, তাহলে এই নিবিড় বন্ধুত্ব দুই রাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে উঠত না বলে সে সময়ের অনেক ঝানু নেতাই বলেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের কৌশলগত দিকগুলো এক এবং অভিন্ন। এটা আশ্চর্যজনক মনে হয় যে, বিংশ শতাব্দীতে লিগ অব নেশন থেকে আরম্ভ করে বর্তমানের জাতিসঙ্ঘ পর্যন্ত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমেরিকান মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে এই ব্যাপারে দীর্ঘ এই সময় ধরে কোনো অশোভন আলোচনা হয়েছে বলে শোনা যায়নি।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির পর দেখা গেছে, বিশ্বের ৩৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রেরই অবদান। ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘোষণা করলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার স্বাধীনতার সাফল্য নিশ্চিত করতে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু মাত্র তিন দশক পর যুক্তরাষ্ট্রের সে অবস্থা রইল না।

বিশ্ব সভ্যতার শুরু থেকেই দেখা গেছে, বিশ্বের উপস্থিত পরাশক্তি কোনোদিন নিজের ক্ষয়িষ্ণু শক্তির কথা স্বীকার করে তখনকার বিশ্বের উদীয়মান শক্তিকে সহজেই স্বীকার করে নিতে দেখা যায়নি। এটাই ছিল বিশ্ব সভ্যতার রীতি এবং এটি কোনো না কোনো স্থানে যুদ্ধ অব্যাহত থাকার কারণ।

বর্তমান বিশ্বে চীন হলো যেন বাইবেলের ও সাধু জীবনের অলৌকিক ঘটনাবলম্বনে রচিত একটি নাটক বা একটি অলৌকিক ঘটনা। প্রায় দুই শ’ বছর আগে বিশ্বের অন্যতম মহাবীর নেপোলিয়ন চীন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘There lies a sleeping giant. Let him sleep. For, when he wakes he will move the world.’ অর্থাৎ, এখানে একটি দানব ঘুমাচ্ছে, তাকে ঘুমাতে দাও। কারণ যখন সে জেগে উঠবে তখন বিশ্বকে সে আন্দোলিত করবে।

বিশ্বের সভ্যতার শুরু থেকেই এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, একটি বিশ্বশক্তির যখন শুরু হয় তখন সেই শক্তিশালী দেশটি অনুধাবন করতে পারে না যে, বিশ্বশক্তি হিসেবে তার দিন শেষ হয়েছে, এখন নতুন শক্তি তার পরিবর্তে আবির্ভূত হবে। এর বাইরে অন্য কিছু ঘটার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এটিই বিধির বিধান। ১৯৬০-এর দশকে দুই কমিউনিস্ট দেশ চীন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে মতপার্থক্য মারাত্মকভাবে শুরু হয়েছিল। তখন চীনের উত্তর সীমান্তে সোভিয়েত মিসাইল চীনের শহরগুলোকে টার্গেট করে বসেছিল। এ অবস্থায় চীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুং এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের নিমন্ত্রণে তদানীন্তন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন (১৯৭২) রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে গিয়েছিলেন।

তখন থেকেই চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের শুরু। তারপর থেকে চীন ও আমেরিকার মধ্যে শুধু যে পরিমাণ বাণিজ্য হয়েছে বিশ্বের সৃষ্টির পর থেকে কোনো দু’টি দেশের মধ্যে এত পরিমাণ ব্যবসায় হয়েছে বলে কেউ বলতে পারবে না। বিশ্ব সভ্যতার শুরু থেকেই দেখা গেছে, যখনই বিশ্বের বিদ্যমান শক্তির পতন আরম্ভ হয়েছে এবং বিশ্বের উঠতি শক্তির চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করা শুরু হয়ে গেছে, তখনই উভয় দেশের মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি হয়। তাতে সারা বিশ্বের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং শান্তির চরম অভাব দেখা দেয়। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে নিয়ে একই সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ইংরেজি সাহিত্যে এটাকেই বলা হয় Fait-Accompli অর্থাৎ যে কাজ শেষ হয়েছে তা নিয়ে তর্ক করা নিরর্থক। পরিতাপের বিষয় হলো- সারা বিশ্ব প্রায় একই রকম বিবাদে জড়িয়ে রয়েছে, যা কোনো দিন শেষ হবে না এবং যার সমাধানও আশা করা যায় না।

১৯৩০-এর দশকে চীন জাপানের কঠোর সেনা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষপর্যায়ে জাপানের সেনা প্রায় ২২ মিলিয়ন চীনের নাগরিককে হত্যা করেছিল। এ মহাযুদ্ধের পরও চীনে গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছিল, সে যুদ্ধেও চীনের পাঁচ মিলিয়ন অধিবাসী হত্যার শিকার হয়েছিল।

বর্তমান বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোতে যারা ক্ষমতায় রয়েছেন এবং যে শ্রেণীর লোক বারবার ক্ষমতায় আসেন, আসলে নিজ নিজ দেশের সামরিক বাহিনীগুলো তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, না তারা নিজেরাই সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে? এটি সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার না হলে আমরা যতই লিখি না কেন, তা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার চেয়ে বেশি কিছু নয়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877